বদরুল আলম

১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:২৬

চলো, বদলে যাই-২

মাস দুয়েক আগে কলেজের ইন্টারমিডিয়েট বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হল। আমি একটি হলের দায়িত্বরত ছিলাম। পরীক্ষা শেষের দিকে। খুব অবাক হয়ে দেখলাম, একটা ছেলে মোবাইল ব্যবহার করছে। আমি ভাবছিলাম ছাত্রটি আরও কিছু লেখার চেষ্টা করছে (খাতাটি সমৃদ্ধিশালী করার জন্য আরও কিছু তথ্য যোগ করছে)। কিন্তু না। সে চ্যাট করছিল। চোখ কপালে তুলে বললাম, হায়! এ প্রজন্ম। আমরা কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখব! বদল এখন-ই জরুরি।

বাংলাদেশে এখন দিন বদলের প্রত্যাশা। এমন প্রত্যাশা বাংলাদেশের মানুষের নতুন নয়, বহু দিনের। তবে প্রত্যাশা প্রাপ্তিতে রূপায়িত হয় না বলে প্রত্যাশা জেগে থাকে। এখন যে আবার নতুন প্রত্যাশা তাকে বলা যেতে পারে বহু পুরাতন যেন নতুন দিগন্তের সংযোজন। তবে প্রত্যাশা পূরণ না হলে, মানুষের যাপিত জীবনের দিনগুলোর বদল না হলে যে হতাশা তৈরি হবে তার মরুভূমিতে কি আশা-প্রত্যাশা হারিয়ে যাবে? হতাশাবাদীরা যাই বলুক না কেন, একজন বাস্তববাদী কবি গিরিশচন্দ্র সেন বলেছিলেন-
"সংসার সাগরে দুঃখ তরঙ্গের খেলা,
আশা তার একমাত্র ভেলা।"
আমরা বদলের আশা করি। আমরা আশায় বেঁচে আছি।

বদলের জন্য প্রয়োজন মানুষের মত মানুষ । মনুষ্যত্বহীন , মেধা-মনন,প্রজ্ঞা-সংজ্ঞাহীন মানুষ মানুষের দিনবদলের অনুঘটক হতে পারে না। এমন মানুষ মানুষের যে বদলের অনুঘটক হয় বা হবে তা ধ্বংসের দ্যোতক। তার প্রমাণ বাংলাদেশের নিকট অতীত। সুতরাং দিন বদলের প্রথম ও প্রধান শর্ত মানুষের বদল। চাই মানুষ , মনুষ্যত্বের সম্পদ সমৃদ্ধ মানুষ। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন,
"মানুষ চাই,মানুষ চাই,
তাহা হইলেই সব হইয়া যাইবে।"

একবার প্রিয় মানুষ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, মানুষের চেতনাজগতে নাড়া বা হৃদয়সম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কাজটা করছেন কিভাবে? শুধু বই পড়িয়ে?

তিনি বলেছিলেন, হ্যাঁ। বইয়ের দিকে আমাদের এত যেতে হল কেন? আমাদের সমাজ অনেক পিছিয়ে গেছে। আমাদের ছোট বেলা যদি জিজ্ঞেস করা হত, তুমি কার মত হবে? তখন নাম আসত বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি সুভাষ বোস, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের। আজকে আমরা চোখের সামনে কাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরব? কার নাম বলব?

শিক্ষকদের দেখে ছাত্রছাত্রীরা অনুপ্রাণিত হবে, বড় স্বপ্নে উদ্দীপ্ত হবে। আজকে শিক্ষকদের কাছ থেকে ছাত্রছাত্রীরা তো সেটা পাচ্ছে না। অথচ মনে রাখতে হবে জৈবিকভাবে যেমন, আত্মিকভাবে তেমনি, মানুষ মানুষের কাছ থেকেই জন্মায়। এখন আমাদের নতুন প্রজন্ম আগের যে মানুষের কাছ থেকে জন্মাবে সেই মানুষটা তো নেই। তাই আমাদের চলে যেতে হল বইয়ের কাছে। অতীতের যারা শক্তিমান মানুষ, সম্পন্ন মানুষ, আলোকিত ও গভীর মানুষ, তাদের ফলবান জীবনই তো এইসব বই। তাদের উদ্যম, কাজ, স্বপ্ন, উপলব্ধির ভাণ্ডার সব রয়েছে এসব বইয়ে। কাজেই এসব বই পড়া মানে তাদের ভেতরকার দামী অনবদ্য জিনিসগুলোকে নিজের ভেতর নিয়ে নেওয়া, তা দিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করা। ছাত্রছাত্রীরা যদি এসব বই পড়ার ভেতর দিয়ে ঐ মানুষদের সম্পন্ন ভুবনে বাস করতে থাকে তাহলে যে নিঃস্ব বাস্তবজগত তাকে গ্রাস করে রেখেছে সে তার অভিশাপের স্পর্শ থেকে কিছুটা ওপরে থাকতে পারবে। তাকে প্রতিরোধ ও পরিবর্তন করতে পারবে। এইজন্য আমরা বইয়ের ওপরে খুবই গুরুত্ব দিয়েছি। "আচ্ছা , আমরা বই পড়ে নিজেকে বদলাই।

"অসমাপ্ত আত্মজীবনী" গ্রন্থে রবার্ট জেকিন্স কর্তৃক Poet of Politics খ্যাত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) উল্লেখ করেছেন "রেণু কয়েকদিন আমাকে খুব সেবা করল। যদিও আমাদের বিবাহ হয়েছে ছোটবেলায়। ১৯৪২ সালে আমাদের ফুলশয্যা হয়। জ্বর একটু ভাল হল। কলকাতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী । লেখাপড়া তো মোটেই করি না। দিনরাত রিলিফের কাজ করে কূল পাইনা। আব্বা আমাকে এ সময় একটা কথা বলেছিলেন, "বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ এ তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রেখ, 'Sincerity of purpose and honesty of purpose' থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না। এ কথা কোনোদিন আমি ভুলি নাই। "বর্তমান প্রজন্মের কাছে এ বার্তাটুকু পৌঁছে দিয়ে বলি, 'রাজনীতির কবি'র দেখানো পথে বদলে যাই। এখনই বদলের শ্রেষ্ঠ সময়।

শেষ করি মাদার তেরেসাকে (১৯১০-১৯৯৭) স্মরণ করে -
"The fruit of silence is prayer
The fruit of prayer is faith
The fruit of faith in love
The fruit of love is service
The fruit of service in peace "

নীরবতাই প্রার্থনা, প্রার্থনাতেই বিশ্বাস জন্মায়, নিবিড় বিশ্বাস ভালোবাসার উৎস, গভীর ভালোবাসাই সেবার ভিত্তি, সেবাতেই শান্তি। নিজেকে সেবার পথে বদলাই।আবার বলি, চলো বদলে যাই।

  • বদরুল আলম: প্রভাষক, তাজপুর ডিগ্রি কলেজ, সিলেট; এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত