আজমিনা আফরিন তোড়া

২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ১৯:৫৬

চিকিৎসা সেবা না ব্যবসা?

আমি পেশাজীবী হিসেবে চিকিৎসক নই। দেহ ঘড়ির কল-কবজা ঠিক করা মিস্ত্রির সাথে আমার পরিচয় রোগিণী হিসেবে। রোগিণী হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা খুবই নিম্নমানের। নিম্নমানের বলছি কারণ কখনো কোন গুরুতর অসুখে ডাক্তারের শরণাপন্ন আমাকে হতে হয়নি।

নিজের ব্যাপারে সৌভাগ্য ধরা দিলেও ডাক্তারখানার (হাসপাতাল) গণ্ডি মাড়াতে হয়নি এমন লোক কিন্তু খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য। এই যে আজকাল চিকিৎসাশাস্ত্রের  চারিদিকে এত জয়জয়কার, এর শুরুটা কিন্তু ছিল একান্তই ধর্মের উপর ভিত্তি করে।

ইতিহাসে যতটুকু পাওয়া যায়, হাসপাতাল ধারণাটা আমাদের সমাজে পরিচিত হবার আগে ইউরোপের দিকে কিছু নাপিত সম্প্রদায় ছিল যারা কেবল দাঁত তোলা, ফোঁড়া কাঁটার মত ছোটখাটো চিকিৎসা সেবাগুলো দেয়ার চেষ্টা করত, সাথে ভেষজ কিছু চিকিৎসাও করত তারা। এদের মুল পেশা যে কেবল চিকিৎসা দেয়াই ছিল তা নয়। এরা বিভিন্ন যাদু বা হাতের খেলা দেখিয়ে চোখের ভেল্কি লাগিয়েও টাকা হাতিয়ে নিত। এদের জীবন এক জায়গায় থিতু না হয়ে বরং আমাদের দেশের বেদেদের মত আজ এখানে তো কাল সেখানে দিন কাটত। হাসপাতাল বা ডাক্তার বলতে তখন কিছু ছিল না।
 
এরপর ইউরোপের মূল উপাসনালয় অর্থাৎ চার্চগুলো হাসপাতালের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল সাধারণ মানুষদের। চার্চগুলো ছিল এই নাপিত সম্প্রদায়ের ঘোরবিরোধী। কারণ ধর্ম মতে শরীরের ভেতর বাস করে পরমাত্মা। আর শরীরে কাটা ছেঁড়া মানে সেই পরমাত্মাকে কষ্ট দেয়া। তাই চিকিৎসা চলত শরীরের উপরে উপরে। ভেতরে যত ব্যথা কিংবা সমস্যাই থাক না কেন, ছুরি কাঁচি চালানো যাবে না শরীরে। তাই পানি পড়া, শরীর শুদ্ধ এইসবই ছিল মূল চিকিৎসা।

সেই সময়ের হাসপাতালগুলো ছিল পুরোপুরি চার্চের অধীন। মজার ব্যাপার হল সেখানে কেবল অসুস্থ লোকজন থাকত না। অসুস্থ লোকজনের পাশাপাশি পর্যটক থেকে শুরু করে তীর্থযাত্রী, এমন কি এলাকার পাগল পর্যন্ত থাকার অধিকার পেত। হসপিটাল ল্যাটিন শব্দ ‘হসপিটালিস বা অতিথি’ থেকে এসেছে। এই হসপিটালগুলো আদতেই ছিল অতিথিশালা। এই অতিথিশালায় এক দিকে চলত ধর্ম প্রচার, আর এক দিকে রোগীদের চিকিৎসা চলত কেবল আধ্যাত্মিক উপায়ে যা ছিল সম্পূর্ণ ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। এর বাইরে কোন পথ্য বা বৈজ্ঞানিক কিছু ওই হাসপাতালগুলোতে রোগীদের প্রদান করা হত না।

পরবর্তীতে ইউরোপে যখন রেনেসাঁ বিপ্লব হয়, মানুষ যখন জীবনপ্রণালিতে যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করতে শুরু করে তখনই প্রথম চিকিৎসা শাস্ত্রও যুক্তিনির্ভর হয়ে উঠতে শুরু করে। পরবর্তীতে রোগীকে পথ্য ও সেবা দিয়ে এবং প্রয়োজনে রোগীর শরীর কেটেকুটে অস্ত্রোপচার করার রেওয়াজ শুরু হয়। পরবর্তীতে রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করার দায়িত্ব আসে হাসপাতালের কাঁধে তা মূলত ঘটে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের হাত ধরে। ফ্লোরেন্স তাঁবু থেকে তাঁবুতে ঘুরে ঘুরে যুদ্ধে আহত সৈনিকদের খোঁজ খবর নিয়ে বেড়াতেন। একজন অপেশাদার সেবিকা সেই সময়ে যেই মমতা নিয়ে রোগীদের সেবা দিতেন আজকের দিনে বড় বড় পাশ দেয়া বেতনভুক্ত নার্সদের মাঝে তার সিকি ভাগ আন্তরিকতা দেখি না!

চিকিৎসকদের নিয়ে আর একটা মজার গল্প পাড়া যাক। একবার ইউরোপে হঠাৎ এক মহামারি দেখা দিল। কেউ বলতে পারে না কি রোগ! এদিকে শয়ে শয়ে লোক মরছে। রোগের উপসর্গ খুবই বিদঘুটে। দুর্গন্ধযুক্ত দাস্ত আর সাথে বমি। ইংরেজ সাহেবি ডাক্তাররা যখন এ রোগের চিকিৎসা না দিতে পেরে নাস্তানাবুদ, তখন হাসপাতালগুলোতে লম্বা হচ্ছে লাশের মিছিল যা দিনকে দিন আরও বড় হচ্ছে। তখনো আবিষ্কার হয়নি খাবার স্যালাইন, বড় রোগের ছোট সমাধান। রোগটা ছিল কলেরা।

বিস্ময়করভাবে এই কলেরার জীবাণু কোটি কোটি ক্রোশ পাড়ি দিয়ে ইউরোপ পৌঁছেছিল এই বাংলা থেকেই। ইউরোপীয়রা তখন বড় বড় নৌকা নিয়ে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আসত বাংলার দিকে। এমনই এক নৌকায় করে কলেরার জীবাণু সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে পৌঁছায় বিলাতে। ইউরোপীয়রা বাংলার এই দাস্ত বমি রোগকে চিনতে না পেরে চালাতে লাগল বিভিন্ন চিকিৎসা। বলাবাহুল্য কোন চিকিৎসাই কাজে দিলো না।

অবশেষে দীর্ঘ দীর্ঘ গবেষণায় দেখা গেল এ রোগ ছড়িয়েছে পানি থেকে। কলেরার জীবাণু সরবরাহকারী নালা-নর্দমার দূষিত পানি পাইপ লিকেজের কারণে মিলেছে খাওয়ার পানির সাথে। সেই থেকে এই রোগ। রোগের কারণ জানতে পেরে বিজ্ঞজনেরা পড়ে গেলেন চিন্তায়। আবার ঢেলে সাজানো হল ইউরোপের সকল স্থাপনার পরিকল্পনা। সেদিক থেকে ধরে নেয়াই যায় আধুনিক ইউরোপের ভিতের সাথে বাংলায় রয়েছে ওতপ্রোত যোগাযোগ!

এ তো গেল বিদেশের গল্প। এবার দৃশ্যপট বদল করে দেশের গল্প বলি। সেদিন দেখা হল এক গ্রাম্য চিকিৎসকের সাথে। গ্রাম্য চিকিৎসক বলছি কারণ ওনার প্রেসক্রিপশনে লেখা 'পল্লী চিকিৎসক'। আদতে উনি এসএসসি পাশ। কোন এক বৃটিশ আমলে (৩০ বছর আগে) মেডিকেল কলেজে কি একটা ডিপ্লোমা কোর্স করেছিলেন। তারপর থেকে শরহতলীতে রোগী দেখা শুরু। তার ঘরভর্তি প্রমাণ সাইজের আধুনিক টিভি, ফ্রিজ, কাপড় ধোয়ার যন্ত্র, ওভেন আরও নাম না জানা কত কী! খুব গর্ব করেই উনি বললেন, একটাও আমার নিজের টাকায় কেনা না। সব ওষুধ কোম্পানি দিয়ে গেছে।

তার ওষুধের দোকানটায় দেখলাম গ্রাম্য রোগীর ভিড়। অভ্যস্ত হাতে তিনি সাধারণ জ্বর থেকে শুরু করে এপেন্ডিসাইটিসের চিকিৎসা দিচ্ছেন। কোন পরীক্ষা ছাড়াই কি করে তিনি নিশ্চিত হলেন ব্যথাটা এপেন্ডিসাইটিসের তা বুঝলাম না, শুধু দেখলাম পরপর কয়েকটা ইনজেকশন তিনি রোগীর গায়ে পুশ করলেন আর পরামর্শ দিলেন ইনজেকশনগুলো কাজ না করলে তাঁর কাছে না গিয়ে রোগিণী যেন সরকারি হাসপাতালে যায়!

বুঝলাম ঔষধ কোম্পানির তাকে খুশি করার কারণ! শহরের ডাক্তারদের কথা না হয় বাদই দিলাম। তারা কেমন, সেই বিচার জনগণই করবে। পল্লী চিকিৎসককে খুশী করার নমুনা যদি এই হয় তাহলে স্বনামধন্যদের কি অবস্থা বোঝাই যাচ্ছে। গাড়ি, ফ্ল্যাট কোনটা না পায় তারা কোম্পানি থেকে। রোগীর চিকিৎসা করে এক দফা টাকা তো পানই, তারপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে কমিশন, বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধ প্রেসক্রাইব করার জন্য আবার উপরি কমিশন, বিভিন্ন পদের উপঢৌকন কি নেই এই পেশায়! সব দেখে শুনে প্রশ্ন জাগে চিকিৎসা সেবা আজ কতটা মানবিক আর কতটা ব্যবসায়িক?

হতাশা এই নিয়ে, দেশে প্রতি বছর হাজার হাজার চিকিৎসক পাশ করে বের হচ্ছে। সরকার বিসিএসে হাজার হাজার ডাক্তার নিয়োগ দিচ্ছে। এত সংখ্যক চিকিৎসক যাচ্ছে কোথায়? এখনো কেন গর্ভবতীর মৃত্যুর হার কমছে না? এখনো পল্লী চিকিৎসকরা কিভাবে গ্রামের সহজ সরল লোকগুলোকে ঠকিয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে? বিসিএস দিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সরকারি ডাক্তারগুলো যাচ্ছে কোথায়!

যেখানে সারা বিশ্ব এমনকি প্রতিবেশী দেশটাতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জয়জয়কার সেখানে আমার দেশটাতে বেড়েই চলেছে রোগ আর রোগীর সংখ্যা! এখনো আমার দেশে প্রতিবছর হাজার হাজার লোক মরছে ভুল চিকিৎসায়। সংখ্যাটা পত্রিকার প্রথম পাতায় আসছে না, কারণ ভুল চিকিৎসায় মরছে সব নিম্ন আর মধ্যবিত্ত আয়ের লোকেরা। উচ্চবিত্ত আর বিত্তবানেরা ঢের আগেই বুঝে গেছেন দেশের চিকিৎসা খাতের হালচাল। তাই সামান্য জ্বর বা আমাশয় হলেও তারা দেশের বাইরেই যান রোগ সারাতে। হাওয়াবদল আর রোগমুক্তি এক সাথে ঘটলে বরং লাভই হয় তাদের। জানি না হাজার সমস্যার এই দেশে লাশের মিছিল কবে সংক্ষিপ্ত হবে! কবে চিকিৎসা ব্যবসা না হয়ে চিকিৎসা সেবা হিসেবে নাম ছড়াবে।

সব শেষে আশার আলোর সন্ধান পাই যখন দেখি জমজ জোড়া সন্তান, বৃক্ষ মানবের মত বিরল রোগের চিকিৎসা সফলতার মুখ দেখে। মুক্তা-মণির চিকিৎসা হয় বিনা খরচে। স্বপ্ন দেখি হাজার হাজার সেবিকা নাইটিংগেল হয়ে জন্ম নিচ্ছে বাংলার ঘরে ঘরে। মুমূর্ষু মৃতপ্রায় দেশটি আমার একটু একটু করে বড় হচ্ছে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নিজের পায়ে হাঁটছে...

  •     আজমিনা আফরিন তোড়া:  শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
  •     [প্রকাশিত লেখায় মতামত, মন্তব্য ও দায় লেখকের নিজস্ব]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত