হাসান মোরশেদ

২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ১৬:৩৪

সিলেটে পর্যটন: সমস্যা ও সম্ভাবনার নানা দিক

সিলেট অঞ্চলে পর্যটনের শুরু কবে?
এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আপাতঃ ভিন্ন কিছু বিষয় ভাবা যেতে পারে।

হজরত শাহজালাল (রঃ) তাঁর অনুসারীদের নিয়ে, শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ’র সেনাবাহিনীর সাথে সিলেট আসেন ১৩০৩ খ্রীষ্টাব্দে। এর পরপরই এই অঞ্চলে তুর্কী, আরব, পার্সিয়ানদের আগমন ঘটতে থাকে। ১৩৪৫ সালে বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা সিলেট আসেন হজরত শাহজালালের সাথে দেখা করতে। বৃহত্তর সিলেট পরে মোঘলদের দখলে আসে এবং মোঘল সংস্কৃতিও এখানে বিকশিত হয়।

এভাবে স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে তুর্কী, আরব, পার্সিয়ান ও মোঘল সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটে সিলেটে। হজরত শাহজালাল(রঃ) ও তার প্রধান সহচর শাহপরান(রঃ) এর মাজার হয়ে উঠে পূন্যার্থীদের প্রধান আকর্ষন। গত কয়েকশো বছর ধরেই মাজার জিয়ারতের জন্য সিলেট ভ্রমনে এসেছেন সিলেটের বাইরের মানুষ। এখন আমরা জানি, এটাও পর্যটনের একটা বিশেষায়িত ধারা বলে স্বীকৃত- ‘রিলিজিয়াস ট্যুরিজম’।

হযরত শাহজালাল যে সময় সিলেট আসেন তার পরের শতাব্দীতে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায় জন্ম নেন এক শিশু- যিনি পরে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভূ নামে পরিচিত লাভ করেন এবং সনাতন ধর্মে বৈষ্ণব ধারার সূচনা করেন। শ্রী চৈতন্যের পিতা জগন্নাথ মিশ্র, সিলেট শহরের অদূরে ঢাকা দক্ষিনের মানুষ। পরে শ্রীচৈতন্যের পিতৃভূমিও হয়ে উঠে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এক তীর্থস্থান।

হযরত শাহজালাল(রঃ) ও তার সঙ্গীদের হাত ধরে সিলেটে বহুজাতিক সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে, আবার সিলেটের সন্তান শ্রীচৈতন্যের হাত ধরে ভারতে বিকশিত হয়েছে অপর সংস্কৃতি। এরই সাথে উল্লেখ করা যেতে পারে, বৃটিশ আমল থেকেই নানা সূত্রে সিলেটের মানুষেরা ছড়িয়ে পড়েছেন ইউরোপে। এইভাবে সিলেট যেমন গ্রহণ করেছে বহিরাঙ্গনকে, সিলেটও তেমনি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে।

সংস্কৃতি, শিক্ষা ও জীবনধারার এই আদান প্রদানও পর্যটনের বহুমুখী বৈশিষ্ট্যের একটি।
মুলতঃ বহুবছর ধরেই সিলেট অঞ্চলে অনানুষ্ঠানিক পর্যটন চালু আছে হযরত শাহজালাল (রঃ) ও হজরত শাহপরান(রঃ) এর মাজার ঘিরে। এর সাথে সিলেট বেড়াতে আসা মানুষজনের প্রিয় গন্তব্য হয়ে ছিলো প্রাকৃতিক শোভামন্ডিত জাফলং ও মাধবকুন্ড- সেই ষাটের দশক থেকেই। চা বাগানের সবুজ সৌন্দর্য্য ঘেরা শ্রীমঙ্গলও ভ্রমনের উল্লেখযোগ্য গন্তব্য অনেক বছর থেকেই।

শুধু সিলেটে নয়, সারা বাংলাদেশেই আনুষ্ঠানিক পর্যটনের শুরু বেশী দিনের ঘটনা নয়। ইউরোপে তো বটেই পাশের দেশ ভারতেও পরিবার পরিজন মিলে পুজোর ছুটিতে কোথাও ঘুরে আসার সংস্কৃতি চালু আছে। ঈদের ছুটিতে কিংবা স্কুল বন্ধ হলে বাচ্চাদের নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার চর্চা আমাদের এখানে থাকলে ও ‘অন্য কোথাও’ বেড়াতে যাবার প্রবণতা খুব কমই ছিলো। ২০১০ সালের দিক থেকে এই পরিস্থিতি বদলে যাওয়া শুরু করে।

এর সাথে অবশ্যই মধ্যবিত্তের আয় পরিসীমা বৃদ্ধি এবং সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী , তরুণ চাকুরীজীবিরা কেউ সপ্তাহান্তে, কেউ মাসের শেষে ছুটছেন- নগরীর কোলাহল ব্যস্ততা পেছনে ফেলে প্রকৃতির সান্নিধ্যে। ঈদ, পুজো ছাড়াও যে কোন ছুটিতে সপরিবারে বেড়িয়ে পড়ছেন কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেটের উদ্দেশ্যে।  

বৃহত্তর সিলেট এমনিতেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, জনবৈচিত্র, ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি নিয়ে পর্যটন বিকাশের সকল সম্ভাবনা ধারনা করে।

দক্ষিন পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত ঘেঁষে হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলা, উত্তরপূর্বে মেঘালয়ের পূর্ব খাসিয়া হিলসের সীমান্ত জুড়ে সিলেট জেলা এবং উত্তর পশ্চিমে পশ্চিম খাসিয়া হিলস ও গারোহিলসের প্রারম্ভ পর্যন্ত সুনামগঞ্জ জেলা নিয়ে বৃহত্তর সিলেটের সীমানা। এই দীর্ঘ সীমাস্তজুড়ে রয়েছে পাহাড়, ঝর্ণা, পাহাড়ি নদী, পায়ে চলা পথ সমন্বয়ে অসামান্য সব প্রাকৃতিক গন্তব্য- লোভাছড়া, লালাখাল, জাফলং, বিছনাকান্দি, ভোলাগঞ্জ, ডলুরা, জাদুকাটা নদী, বারিকের টিলা, টেকেরঘাট। হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেটজুড়ে শতাধিক চা বাগানের সবুজ হাতছানি। বৃহত্তর সিলেটেই রয়েছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সংরক্ষিত বনাঞ্চল রেমা কালেংগা। শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া রেইনফরেস্ট প্রকৃতি বান্ধব পর্যটকদের পছন্দের গন্তব্য। টাঙ্গুয়ার হাওর সহ সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জুড়ে বিশাল হাওরাঞ্চল যোগ রয়েছে অন্যরকম আকর্ষন।

বৃহত্তর সিলেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠির যেমন রয়েছে নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য তেমন অন্যান্য জনগোষ্ঠী খাসিয়া, মনিপুরী, গারো, হাজং, ত্রিপুরারা নিজ নিজ স্বাতন্ত্র নিয়ে বৈচিত্র যোগ করেছেন সিলেটের পর্যটন সম্ভাবনায়। এর মধ্যে খাদ্যাভাস, পোষাক, গহনা, জীবনধারা সবকিছুই রয়েছে।

২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশে পর্যটনের যে প্রাথমিক সম্ভাবনা শুরু হয়েছে সেটা একেবারেই আভ্যন্তরীন পর্যটকদের ঘিরে। নানা কারনেই এখানে বিদেশী পর্যটকদের সমাগম হয়নি, হওয়ার সম্ভাবনাও অদূর ভবিষ্যতে নেই। কিন্তু চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে, বিদেশী পর্যটক নির্ভরতা বাদ দিয়ে আভ্যন্তরীন পর্যটকদের নিয়ে ভাবলেই এখানে বিশাল একটা বাজার চোখে পড়ে। আমাদের ষোল কোটি মানুষের শতকরা ১ ভাগ ও যদি বছরে একবার দেশের ভেতরে ভ্রমন করেন- সেই সংখ্যাটা বিশাল। এ ছাড়া রাজধানী শহর ঢাকায় আন্তর্জাতিক ও বেসরকারী সংস্থাগুলোতে প্রচুর বিদেশী কাজ করেন। সাধারণ ছুটিগুলোতে তারাও বাইরে না গিয়ে দেশের ভেতরেই ছুটি কাটাতে পছন্দ করেন।

গত ছয়বছরে সিলেটের পর্যটনখাতে উল্লেখযোগ্য কিছু ব্যাপার ঘটেছে।
 শ্রীমঙ্গল, মাধবকুন্ড, জাফলং- বহু বছর ধরে এই তিনটিই ছিলো ভ্রমনের গন্তব্য। গত ছয়বছরে আরো অনেকগুলো নতুন নতুন গন্তব্য পর্যটক প্রিয় হয়েছে। নীল জলের সারি নদীর পাড়ে লালাখাল, সোয়াম্প ফরেস্ট রাতারগুল, বিশাল ঝর্ণার গ্রাম পান্তুমাই, মেঘ পাহাড়ের বিছনাকান্দি, ভোলাগঞ্জ হয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বাঁশতলা, ডলুরা পেরিয়ে আরেক মায়াবী নদী জাদুকাটার পাড়ে বারিকটিলা হয়ে টেকেরঘাট পর্যন্ত যাচ্ছেন পর্যটকরা। টেকেরঘাটে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ সিরাজুল ইসলামের স্মৃতি বিজড়িত ‘ শহীদ সিরাজ লেক’ আর টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরে বেড়ানো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এ সময়ে।


পর্যটন সম্ভাবনাকে ঘিরে এসময় সিলেটে হোটেল-রিসোর্ট খাতে প্রচুর বিনিয়োগও হয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম লাক্সারী রিসোর্ট নাজিমগড় রিসোর্ট- তাদের প্রথম রিসোর্ট চালু করেছে ২০০০ সালে সিলেটের খাদিম নগরে, দ্বিতীয় রিসোর্টটি ২০১৩ সালে গড়ে উঠেছে লালাখালে। এ সময়ের মধ্যে শ্রীমঙ্গলে গড়ে উঠেছে- গ্র্যান্ড সুলতান রিসোর্ট,মৌলভীবাজারে দুসাই এবং হবিগঞ্জের বাহুবলে লাক্সারী রিসোর্ট- প্যালেস। সিলেট শহরের কাছাকাছি শুকতারা নেচার রিসোর্টও উল্লেখযোগ্য। কোটি থেকে শতকোটি টাকা বিনিয়গ হয়েছে এসব রিসোর্টে। এ ছাড়া সিলেট, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার হোটেল ব্যবসায় প্রাণ এসেছে পর্যটকদের কল্যানে। এমনকি সুনামগঞ্জ শহরে, কালেংগা জঙ্গলেও অতিথিশালা গড়ে উঠেছে। এই সেক্টরে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে এই বছরগুলোতে।

কর্মসংস্থানের সুফল তৈরী হয়েছে প্রান্তিক পর্যায়ে। একটা উদাহরন হতে পারে, রাতারগুল গ্রাম। ২০১১ সাল পর্যন্ত এই গ্রামের মানুষের একমাত্র পেশা ছিলো মাছধরা। ২০১২ থেকে পর্যটক সেবায় তারা জড়িত হয়েছেন এবং এই গ্রামের মানুষদের এখন ৪০টি নৌকা আছে। বিছনাকান্দিতে শতাধিক নৌকা জড়িত হয়েছে পর্যটক সেবায়।
সিলেট ও শ্রীমঙ্গলে রেন্ট এ কার ব্যবসার প্রায় পুরোটাই এখন পর্যটক নির্ভর। এভাবে পর্যটন সরাসরি ভূমিকা রাখছে শতকোটি টাকার রিসোর্টের বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে রাতারগুলের একজন নৌকাচালকের জীবন জীবিকা পর্যন্ত।

পর্যটন কোন একক বিষয় নয়, এটি একটি সমন্বিত ও সামগ্রিক  ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে বহু ধরনের স্টেকহোল্ডার এই পদ্ধতির সাথে সম্পৃক্ত থাকেন এবং এরা প্রত্যেকেই গুরুত্বপুর্ণ। আন্তর্জাতিক মানের রিসোর্টে দশহাজার টাকা রুম ভাড়া দিয়ে যে পর্যটক থাকছেন, তাকেই আবার ছুটে আসতে হচ্ছে রাতারগুল, বিছনাকান্দি- এখানকার স্বল্পশিক্ষিত নৌকাচালকের পর্যটন সেবাটাও জরুরী।

এখন সারা বাংলাদেশে এবং সিলেটে যা হচ্ছে সেটা হলো সামগ্রিক পর্যটনের একেবারেই প্রাথমিক একটা ধাপ। এই ধাপে মুলতঃ নতুন নতুন পর্যটন গন্তব্য তৈরী, পর্যটকদের ঘুরাঘুরি, বিকাশের সম্ভাবনাকে কাজ অবকাঠামো তৈরী এবং সরকারী বেসরকারী পুঁজি বিনিয়োগ ঘটতে থাকে। এই ধাপ স্থিত হবার পর আরেক ধাপে প্রবেশ করবে আমাদের পর্যটন চক্র- শুধু প্রাকৃতিক গন্তব্য নয়, কেবল ঘুরাঘুরি নয়- মানুষের জীবন যাত্রা, ইতিহাস ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ধর্মীয় অনুষঙ্গ এগুলোও যোগ হতে থাকবে। পর্যটকরাও আরো পরিনত হতে থাকবেন, আরো নতুন নতুন বিষয় তাদেরকে আগ্রহী করতে থাকবে। পর্যটন ব্যবস্থা মুলতঃ এভাবেই কাজ করে একটা অনন্তঃ সম্ভাবনাকে ঘিরে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যে প্রচুর জাতিগত বাঙালি আছেন যাদের পূর্বপুরুষের ভিটা সিলেটে। সিলেটের প্রতি তাদের সহজাত আবেগ রয়েছে। মেঘালয়ের রাজধানী শিলং থেকে সিলেটের সড়ক দূরত্ব মাত্র তিনঘন্টা। সিলেটকে যদি সেখানে প্রমোট করা যায় এবং যথাযথ দায়িত্ব নেয়া যায় তাহলে তাদেরকে সিলেট বেড়াতে নিয়ে আসা যায়, তাদের পুর্বপুরুষের ভিটে দেখানো যায় এবং সিলেটের পাশাপাশি কক্সবাজারের প্রতি তাদের ব্যাপক আগ্রহ আছে কারণ উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষদের সমুদ্র দর্শন করতে যেতে হয় অন্ততঃ পশ্চিমবঙ্গ অবধি।

এ ক্ষেত্রে আরেকটি উদাহরণ মনে করা যেতে পারে। ২০১৬ সাল সরকার ‘পর্যটন বর্ষ’ ঘোষনা করেছিলো- একটা বিশাল সংখ্যাক বিদেশী পর্যটক দেশে নিয়ে আসার টার্গেট দিয়ে। ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে আমাদের সুযোগ হয়েছিলো মাননীয় বিমান ও পর্যটন মন্ত্রীর সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারের। পর্যটন কর্পোরেশজনের প্রধান নির্বাহী এবং মন্ত্রনালয়ের সচিব সহ গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তিরা ছিলেন। আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম পর্যটন বর্ষকে সামনে রেখে সিলেটকে শো কেস করে আমরা যাবো ইংল্যান্ডে । সেখানে ৫ লক্ষ মানুষ রয়েছেন আমাদের, তৃতীয় পরজন্মের এই সিলেটী বাঙালিরা সেখানে আর্থিকভাবে খুবই প্রতিষ্ঠিত কিন্তু দেশের সাথে তাদের যোগাযোগ কমে যাচ্ছে। তারা ছুটি কাটাতে যাচ্ছেন আফ্রিকার মরক্কোসহ নানা দেশে, দেশে আসছেন না। সরকার তাদেরকে পুরো বছরজুড়ে অতিথি হিসাবে আমন্ত্রন জানাবে। বিমান স্পেশাল ডিসকাউন্টে টিকেট দেবে তাদের জন্য। সিলেটের নানা আন্তর্জাতিক মানের রিসোর্টে তারা থাকবেন দুই সপ্তাহ, এখান থেকে সরকারী তত্বাবধানে তাদেরকে বেড়িয়ে আনানো হবে নিজ নিজ গ্রামের বাড়ি থেকে। সিলেট থেকে কক্সবাজার ও ঢাকা ঘুরে তারা চমৎকার গোছানো অভিজ্ঞতা এবং দেশের অতিথি- এই বোধ নিয়ে ফিরে যাবেন ইংল্যান্ডে। তৃতীয় প্রজন্মের বৃটিশ বাংলাদেশিদের কাছে দেশকে রিব্রান্ডিং করার এ এক অনন্য সুযোগ বলে আমরা মনে করেছিলাম।

দুঃখজনকভাবে প্রস্তাবটি কার্যকর হয়নি। সরকার ব্যস্ত ছিলো বৌদ্ধিজ হেরিটেজ প্রমোট করে চীন ও জাপান থেকে পর্যটক সমাগম ঘটাবে। পর্যটন বর্ষ জুড়ে ঠিক কতোজন বিদেশী পর্যটক এসেছিলেন- সেই তথ্য অবশ্য আর জানা যায়নি।

দ্বিতীয় উদাহরণটি হতে পারে- পর্যটনকে ঘিরে আমাদের অসীম সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর পথে সংকটগুলো উপলব্ধি করতে।

আবারো মনে করা জরুরী, পর্যটন একটা সামগ্রিক বিষয়। এখানে সরকারী ও বেসরকারী খাতের সমন্বয়ের প্রয়োজন আছে। কিছু কিছু উদ্যোগ আসবে বেসরকারী খাত থেকে- যেমন গত কয়েকবছরে সিলেটে আন্তর্জাতিক মানের হোটেল রিসোর্ট গড়ে উঠেছে, সিলেটে সুরমা নদীতে রিভার ক্রুজিং হচ্ছে, এডভেঞ্চার পার্ক গড়ে উঠেছে, থিম পার্ক হবে- বেসরকারী খাতে বিনিয়গের এরকম নানা দিক রয়েছে। কিন্তু আরো কিছু জরুরী দিক রয়েছে যেগুলো বেসরকারী খাতে হবে না, সরকারের সংস্থাগুলোকে পর্যটন বান্ধব হয়ে উঠে এই কাজগুলো করতে হবে।

রাস্তাঘাট নির্মান ও রক্ষনাবেক্ষন বেসরকারী খাত করতে পারবে না, এটা সরকারের দায়িত্ব। সিলেটের প্রতিটি পর্যটন গন্তব্য শহরের বাইরে- ২০ থেকে ৫০ কিমি পর্যন্ত যেতে হয়। প্রতিটি দিকেই রাস্তাঘাটের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ, প্রতিবছর খারাপ থেকে আরো খারাপ হচ্ছে। পর্যটনের বিকাশ ও উন্নয়ন নিচ্ছে কথাবার্তা হচ্ছে অর্ধযুগ ধরে, সরকারী পর্যায় থেকে অনেক উচ্চাশা শুনা যায়, কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে সিলেটের রস্তাঘাটের অবস্থা অসহনীয় রকম খারাপ।

রাস্তাঘাটের এই দুর্দশার জন্য পর্যটক কষ্ট পান- শুধু তাই নয় মনে রাখা জরুরী পর্যটনকে ঘিরে রেন্ট এ কার ব্যবসায় এখানে ভালো বিনিয়োগ আছে। ভয়ংকর খারাপ রাস্তায় গাড়ি চালানোর কারনে তাদের মেইনটেইনেন্স খরচ অনেক বেড়ে যায়। ভালো রাস্তা হলে হয়তো আরো কম খরচে তারা পর্যটকদের সেবা দিতে পারতেন।

সিলেটের পর্যটন পুরপুরিই প্রকৃতি ও পরিবেশ কেন্দ্রিক। পর্যটকরা এখানে আসছেন- প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে। পর্যটন টিকিয়ে রাখা ও বিকাশের ক্ষেত্রে তাই পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষনের প্রশ্নটি একেবারেই মৌলকভাবে জড়িত। বহুকাল থেকে ভীষন জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য জাফলংকে শেষ করে ফেলা হয়েছে পরিবেশবিরোধী কার্যকলাপে। পাথরের লোভে বোমা মেশিন ব্যবহার করে জাফলং কে নরক বানিয়ে ফেলা হয় প্রতিবছর। সর্ব্বোচ্চ আদালতের স্পষ্ট নির্দেশ থাকার পর ও এই পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রম প্রশাসন বন্ধ করতে পারেনি।

নীল জলের অসামান্য সুন্দর সারি নদীর পাড় ধরে পর্যটনের চমৎকার সম্ভাবনা রয়েছে। বালু এবং ভারত থেকে ভেসে আসা কয়লা গুঁড়োর লোভে এই নদীও ক্ষতবিক্ষত হয়। এখানেও আদালতের নিষেধাজ্ঞা আছে কিন্তু কার্যকারীতা নাই। একই অবস্থা বিছনাকান্দি, ভোলাগঞ্জ, ডলুরা ও জাদুকাটা নদীতে। পাহাড়ি নদীকেন্দ্রিক পর্যটন সম্ভাবনা এখানে, নদীগুলো হত্যা করা হচ্ছে অথচ সরকার নদী হত্যা বন্ধ করতে সফল হতে পারছেনা।

সিলেট শহরের ভেতরের চমৎকার ফুটপাত রয়েছে, ফুটপাতগুলো দখল করে রেখেছে ভ্রাম্যমান হকারেরা। এটা নিয়ে সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও রাজনৈতিক শক্তির টানাপোড়ন আছে- কিন্তু ফলাফল এই, একজন পর্যটক পায়ে হেঁটে সিলেট শহর বেড়াতে পারেন না।

শহরের ভেতরে এখনো গড়ে উঠেনি সিলেটের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে কোন জাদুঘর, যেখানে একজন কৌতুহলী পর্যটক অল্প সময়ে সিলেটকে জানতে পারবেন। পর্যটন বিকাশের পথে এগুলো একেবারেই প্রাথমিক পদক্ষেপ।

পর্যটকদের নিরাপত্তার প্রয়োজনে ‘পর্যটন পুলিশ’ এর একটা ইউনিট কাজ করলেও প্রয়োজনের তুলনায় সেটা একেবারেই প্রতুল। সারা বছর জুড়েই পর্যটন গন্তব্যগুলোতে পুলিশী নিরাপত্তা এবং ঝুঁকি সংক্রান্ত তথ্য নির্দেশিকা  থাকা প্রয়োজন। এই মনিটরিং নেই বলেই প্রতিবছরই পর্যটকদের প্রাণহানীর ঘটনা ঘটে জাফলং, বিছনাকান্দি, মাধবকুন্ডে।

উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হোটেল/রিসোর্ট গড়ে উঠলেও- এসবে যথাযথ সার্ভিস নিশ্চিত করতে পেশাদার কর্মীবাহিনী গড়ে তোলার জন্য এখনো প্রশিক্ষন কেন্দ্র গড়ে উঠেনি আমাদের। প্রশিক্ষিত গাইড তৈরী করার বিষয়টিও জরুরী।

সবথেকে জরুরী বিষয়টি হলো- পর্যটন বিষয়ে সরকারের নানা পর্যায়ে দায়িত্বশীল যারা আছেন তাদেরকে এর বিশাল পরিসীমা ও বৈচিত্র অনুধাবন করতে হবে। মাননীয় পর্যটন মন্ত্রী মহোদয়ের উপস্থিতিতে সিলেট বিভাগীয় প্রশাসনের পর্যটন সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা শুনার সুযোগ হয়েছিলো। তারা বৃহত্তর সিলেটের ১৯ টি পর্যটন গন্তব্য চিহ্নিত করে প্রতিটিতে ‘আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র’ স্থাপন করতে চান। রেমা কালেঙ্গার জঙ্গলে কিংবা টাঙ্গুয়ার হাওরে ‘আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র’ স্থাপনের চেয়ে এই জঙ্গল যেনো জঙ্গল থাকে, হাওর যেনো হাওর থাকে তার সব জীববৈচিত্র নিয়ে সেটা বুঝতে পারাটা জরুরী। এই বুঝতে পারা শুধু পর্যটন মন্ত্রনালয় বা পর্যটন কর্পোরেশনের জন্য নয়, বনবিভাগ ও পরিবেশ মন্ত্রনালয়ের জন্য। বনবিভাগ প্রায়ই উৎসাহী হয়ে উঠেন পর্যটন নিয়ে।

রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টে পর্যটন উন্নয়নের জন্য তারা ছয়কোটি টাকার প্রজেক্ট প্রপোজাল তৈরী করেছিলেন। পরিবেশ কর্মী ও সচেতন মানুষদের প্রবল প্রতিবাদের মুখে সেই বিলাসী প্রজেক্ট পুরোপুরি বাস্তবায়িত না হলেও গাছ কেটে ঝুঁকিপূর্ণ একটি টাওয়ার তারা নির্মান করেছেন জঙ্গলের ভেতরে। পর্যটন নিয়ে চিন্তাভাবনা তো বনবিভাগের কাজ নয়, তাদের দায়িত্ব হচ্ছে বন সংরক্ষন। রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট প্রায় তিন হাজার একর থেকে এখন তিনশো একরে কেনো এসে ঠেকলো- সে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার দায়িত্ব তাদের।

প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে পর্যটনের বিকাশ কিভাবে সম্ভব সেটা জানার জন্য, খুব দূরে নয়- সিলেটের সীমান্তের ওপারে মেঘালয় হতে পারে ভালো উদাহরণ। একসময় মেঘালয়ে ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে পর্যটকের আগমনের হার ছিলো খুবই নিম্ন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো ছিলো না। এই কয়েক বছরে তারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটিয়েছে, প্রধান শহর থেকে পাহাড় জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গ্রামগুলো পর্যন্ত ভালো রাস্তাঘাট তৈরী করেছে, পর্যটন কেন্দ্রগুলোর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে স্থানীয় মানুষেরা- তারাই চমৎকার পরিস্কার রাখছেন সবকিছু।

ডাউকি বীজের উত্তরে স্নোয়েনপেডেং গ্রাম আর এপাড়ে আমাদের জাফলং, ওপাড়ে মাউলিনং এশিয়ার সবচেয়ে পরিস্কার গ্রাম আর এপাড়ে আমাদের বিছনাকান্দি। পার্থক্যটা খুবই স্পষ্ট। মাধবকুন্ড ঝর্ণার পথে টাইলস লাগিয়ে সিঁড়ি বানালে যে প্রতিবেশ নষ্ট হয় সেই অনুভূতি কর্তৃপক্ষের আসতে হবে।

সামগ্রিকভাবে এইসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে সিলেটের জন্য টেকসই পর্যটন বিকাশের একটা বিশদ পরিকল্পনা জরুরী। সরকারের সাথে বেসরকারী স্টেকহোল্ডার্স এবং এই খাতে যারা কাজ করছেন, চিন্তাভাবনা করছেন, পড়াশুনো করেছেন তাদের সবাইকে গুরুত্ব দিয়ে সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়ার কোন বিকল্প নেই।

হাসান মোরশেদ : লেখক, পর্যটনকর্মী

আপনার মন্তব্য

আলোচিত