ডা. এস. এম. হাবিবউল্লাহ সেলিম

২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ১৮:০৪

আমাদের হার্ট আমাদের অঙ্গীকার

হৃদরোগজনিত রোগ যার মধ্যে রয়েছে করোনারী হার্ট ডিজিজ অথবা ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ এবং স্ট্রোক যা বিশ্বের এক নম্বর ঘাতক হিসাবে চিহ্নিত। হৃদরোগের অনেক কারনের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও রক্তনালীতে চর্বি জমে যাওয়া প্রাধান কারণ।

সাথে সাথে বয়সের সাথে হৃৎপিন্ড ও ধমনীর গঠনগত পরিবর্তনও হৃদরোগের জন্য অনেকাংশে দায়ী। বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রতি বৎসর প্রায় ১কোটি ৭৩ লক্ষ মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটছে এই রোগে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা বেড়ে ২কোটি ৩০ লক্ষে দাড়াবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও এই রোগ  ক্রমেই বেড়ে চলছে। বাংলাদেশ হেলথ বুলেটিন ২০১৩ অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের হৃদরোগের মৃত্যুর হার প্রায় ১২.২%।

এজন্য প্রতি বছর ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশন এর উদ্যোগে ২৯ সেপ্টেম্বর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একই সাথে হৃদরোগ প্রতিরোধ বিষয়ক সচেতনতামুলক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এ বৎসর প্রতিপাদ্য হলো  Make Your Promise  (আমাদের হার্ট আমাদের অঙ্গীকার)।

এই মরনঘাতী রোগের কারন, লক্ষন ও প্রতিরোধে করনীয় সম্পর্কে জানতে  হবে আমাদের সকলকে।

হৃদরোগের ঝুঁকি সমূহ:
‘ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ’ (IHD) তথা হৃদরোগের প্রধান কারণ হল ‘কোলেষ্টেরল’ এবং অন্যান্য চর্বিজাতীয় পদার্থ’ রক্তবাহী করোনারী ধমনীর অভ্যন্তরে মধ্যে জমা হওয়া যার ফলে অবরোধের সৃষ্টি এবং ঐ ধমনীগুলি দিয়ে রক্ত প্রবাহে বিঘ্ন ঘটে। কতগুলি অবস্থ্যা এবং জীবনধারণ প্রণালীগত কয়েকটি অভ্যাসকে চিহ্নিত করা হয়েছে এই কোলেষ্টেরল এবং চর্বি রক্তবাহী নালীর মধ্যে জমা হওয়ার জন্য এবং উচ্চ হারে সঞ্চয় বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য। এগুলিকে ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান (Risk Factors) বলা যায়।

পরিবর্তনশীল ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান
এই শ্রেণিতে সেই উপাদানগুলি আসতে পারে, যেগুলিকে পরিবর্তন করা যায় এবং প্রতিরোধ করা যায়। যার ফলে হৃদ্রোগের বৃদ্ধিকে থামিয়ে রাখা যায় এবং সম্পূর্ণ সুস্থ করা যায়।
    ধুমপান বা তামাকজাত দ্রব্য সেবন
    উচ্চ রক্তচাপ
    ডায়াবেটিস
    মেদাধিক্য বা দৈহিক উচ্চতা অনুসারে বাড়তি ওজন
    রক্তের মধ্যে উচ্চ কোলেষ্ট্রলের মাত্রা

অপরিবর্তনীয়  ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান :
এই শ্রেণিতে তিনটি উপাদান আছে, যেগুলিকে পরিবর্তন করা যায় না এবং যারা আগেভাগেই ব্যক্তি বিশেষকে হৃদরোগপ্রবণ করে তোলে। ১. বয়স, ২. লিঙ্গ ৩. বংশগত বৈশিষ্ঠ্য।

হৃদরোগের লক্ষণ:
    ‘এ্যাঞ্জাইনা’ বা হৃদরোগজনিত বুকে ব্যাথা হচ্ছে একটা ভারী চাপ অথবা ব্যথার অনুভুতি, যা বুকের মধ্যখানে অথবা বাম দিকে অনুভূত হয় এবং বিশেষ তাৎপর্য সহকারে বাম হাতে প্রসারিত হয়। তবে হার্ট এ্যাটাকের ব্যথা খুবই  তীব্র হয়।

    শ্বাসহীনতা বা স্বল্পশ্বাস (শ্বাস কষ্ট)।
    ঘর্মাক্ত হওয়া।
    বমি-বমি ভাব এবং বমি করা।
    মাথা ঘোরা এবং অজ্ঞান হওয়া।
    অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণের পর বুকে ব্যথা বা চাপ।
    গলায় অনুভূতি হারানো।
    বুকে কিংবা ওপরের দিকের পেটে চাপ অথবা টানটান ভাব।
    দুর্বলতা এবং সহজে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়া।
    দৈহিক অসাড় ভাব ।

উপরোক্ত যেকোন লক্ষণে অবহেলা না করে নিকটস্থ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং ইসিজি করুন।

হার্ট এ্যাটাক:
বুকের ব্যথা বা ‘এ্যাঞ্জাইনা’-র ব্যথা সেই সময় প্রকাশ পায়, যখন ধমনীর অভ্যন্তরের ফাঁকা অংশের ৭০% অবরুদ্ধ (Block) হয়ে পড়ে। এই অবরোধগুলি (Block) বেড়ে ওঠে শতকরা ১০০% ভাগ হয়ে গেলে শুরু হয় তীব্র যন্ত্রণা, ঘাম দেওয়া এবং শেষ পর্যন্ত হৃদপিন্ডের কিছু অংশের পেশী অকেজো হয়ে স্থায়ী ভাবে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। যাকে হার্ট এ্যাটাক বা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় মায়োকার্ডিয়াল  ইন্ফারক্সন (MI) বলা হয়। হৃদরোগ সব বয়সেই হতে পারে। তবে সাধারনত বয়স্ক ব্যক্তিরাই এ রোগের জন্য বেশি ঝুকিপূর্ণ।

প্রজননে সক্ষম নারীর তুলনায় পুরুষদের হৃদরোগ হবার ঝুকি বেশি।

হৃদরোগ (IHD) চিকিৎসা ও প্রতিরোধঃ
হৃদরোগ চিকিৎসার প্রধান উদ্দেশ্য ঝুঁকিসমূহ প্রতিকার করা যা ঔষধ ও জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে সম্ভব। জটিল হৃদরোগের ক্ষেত্রে ঔষধের পাশাপাশি কখনো রিং (Stenting) অথবা বাইপাস (CABG) অপারেশনের প্রয়োজন পড়তে পারে। এই ব্যয়বহূল চিকিৎসা প্রতিরোধ করা সম্ভব যদি নিজে সচেতন হই এ পরিবার ও সমাজকে সচেতন করে তুলি।

নিজ ঘর থেকে শুরু করি - হৃদবান্ধব পরিবেশ গড়ি
    ঘরে স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য নিশ্চিত করুন। যেমনঃ ফাষ্ট ফুড, প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য, তেল-চর্বি জাতীয় খাদ্য,অতি লবন ও অতি মিষ্টি খাদ্য পরিহার করবেন।
    তাজা ফল-মূল, শাক-সবজী বেশী খাবেন।
    অফিস এবং স্কুলের জন্য বাসায় তৈরী স্বাস্থ্যসম্মত খাবার দিন।
    বাসগৃহে সব ধরনের ধুমপান, তামাক, জর্দা-গুল বন্ধ করুন ।
    প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০মিনিট হাটুন- ব্যায়াম করুন। ঘরে নিজের কাজ নিজে করতে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করবেন।

    পরিবারের সকলের রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তের চর্বি, শরীরের ওজন বিষয়ে নজর রাখুন- নিয়মিত পরীক্ষা করান। যে কোন অসঙ্গতির জন্য হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এর পরামর্শ নিন।

নিজে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে জানুন  

ইতিমধ্যে যদি কোন হৃদরোগে আক্রান্ত না হয়ে থাকেন তবে পরবর্তী ১০ বছরে নিজের হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি (Risk scoring) সম্পর্কে একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এর তত্ত্ববধানে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষার (যেমন- দৈহিক পরীক্ষা, ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাম, ইটিটি, বায়োকেমিক্যাল টেষ্ট, করোনারী এনজিওগ্রাম) মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে। ঝুঁকি অনুসারে (Risk category) সুনির্দিষ্ট চিকিৎসার মাধ্যমে হার্ট এটাক জনিত মৃত্যু প্রতিরোধ করা যেতে পারে।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি নির্ধারনী পর্যায়ে সচেতনতা তৈরী করা

    সকলের জন্য স্বাস্থ্যকর হৃদবান্ধব পরিবশ সৃষ্টি করা।

    রেডিও - টেলিভিশনসহ সকল প্রচার মাধ্যমে স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রচার-প্রচারনা বৃদ্ধি করা। ধুমপান, ফাষ্টফুড, কৃত্রিম ও পক্রিয়াজতকৃত খাদ্যের বিজ্ঞাপন সীমিত করন এবং এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সকলকে সচেতন করা।

    পাঠ্যসূচিতে হৃদরোগের ভয়াবহতা ও সচেতনতা মূলক স্বাস্থ্য বিষয়ক কার্যক্রম অন্তর্ভূক্ত করা।

    হৃদরোগ চিকিৎসা সহজলভ্য করার লক্ষে সকল সরকারী বেসরকারী হাসপাতালে হৃদরোগ চিকিৎসার সকল ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

এই বিশ্ব হার্ট দিবসে কিভাবে হার্টকে সুস্থ ও গতিময় রাখা যায় সে ব্যপারে এক অন্যের সাথে আলোচনা করি এবং হৃদবান্ধব হিসেবে গড়ে উঠতে সচেষ্ট হই। এই রোগ প্রতিরোধ শুধুমাত্র হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বা সাধারণ চিকিৎসকদের মাধ্যমে সম্ভব নয়। সমন্বিতভাবে সকলে চেষ্টা করলে আমরা ২০২৫ সালের  মধ্যে হৃদরোগ অকাল মৃত্যুর সংখ্যা কমপক্ষে শতকরা ২৫ ভাগ কমিয়ে আনতে পরি।

তাই বিশ্ব হার্ট দিবস আসুন প্রতিজ্ঞা করি-

    স্বাস্থ্যকর উপায় খাবার খাব
    ধুমপান কে  না বলব
    কর্মঠ থাকব।

এই অঙ্গীকার আমার, আপনার, সকলের হার্টের জন্য।
আসুন আমরা সবাই মিলে ব্যক্তিগত সামাজিক এবং জাতীয় উদ্যোগের মাধ্যমে হৃদরোগ প্রতিরোধ কাজ শুরু করি।
                “ Make Your Promise”
                            
ডা. এস. এম. হাবিবউল্লাহ সেলিম: সাংগঠনিক সম্পাদক  বাংলাদেশ কার্ডিয়াক সোসাইটি, সাধারন সম্পাদক,  সিলেট হার্ট এসোসিয়েশন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত