হাসান মোরশেদ

২৪ অক্টোবর, ২০১৮ ১৫:৪৩

সুলতান মনসুরের ‘মুজিব কোট’ ও নরেন্দ্র মোদীর ‘সুভাষ টুপি’

গতকাল রাতে সিলেট শহরে সুলতান মনসুরের গা থেকে জোর করে মুজিব কোট খুলে নেয়া হয়েছে। না, এটা আওয়ামী লীগ বা এর অঙ্গ সংগঠনের সাংগঠনিক কাজ নয়- ছাত্রলীগ থেকে বহিস্কৃত এক ব্যক্তির একক মিশন। হতেই পারে, বহিস্কৃত সে ব্যক্তি দলে নিজের অবস্থান করে নেয়ার জন্য এমন চরম সুযোগ নিতে চেয়েছে। হয়ই তো এরকম।

সুলতান মনসুর আওয়ামী লীগ নেতা বা ছাত্রলীগ সভাপতি কিংবা ডাকসুর ভিপি হিসাবে যতোটুকু, আমার কাছে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অন্য একটা ভূমিকার জন্য। ’৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যে আবেগী তরুণেরা অস্ত্র হাতে প্রতিরোধ গড়েছিলেন সুলতান তাঁদের একজন। ’৭১ এর মুক্তিযোদ্ধা এবং ’৭৫ এর প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সমস্ত মানবিক স্খলনের পর ও তাদেরকে প্রত্যেককে আমি অনন্য সম্মানের মানুষ বলেই মনে করি।

তাকে ঘিরে সিলেট অঞ্চলের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটা গভীর আবেগ ছিলো। দীর্ঘদেহী সুলতান দেখতে অনেকটা বঙ্গবন্ধুর মতো, এই অঞ্চলের বহু নেতাকর্মীর রাজনৈতিক গুরু তিনি। আব্দুস সামাদ আজাদ, দেওয়ান ফরিদ গাজী, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত’র মতো জাতীয় নেতাদের পর সুলতান মনসুরেরই কথা ছিলো জাতীয় রাজনীতিতে সিলেট অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করার। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হওয়ায় সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের চিহ্ন ও দেখা যাচ্ছিলো।

কিন্তু ১/১১ এ শেখ হাসিনা যখন কারাগারে তখন আওয়ামী লীগের যে নেতারা তাঁর প্রতি অবিশ্বস্ত হয়েছিলেন সুলতান হয়ে গেলেন তাদের একজন। অবিশ্বস্ত প্রায় সকলকেই শেখ হাসিনা দলে ফিরিয়ে নিলেও সুলতানের সেই সুযোগ আর হয়নি, অনেক অনুনয়ের পরও। সুলতানের অবিশ্বস্ততা কতোটা গভীর সে কেবল শেখ হাসিনাই জানেন।

সুলতান চুপ ছিলেন দীর্ঘদিন, তারপর আস্তে আস্তে ড. কামাল, মাহমুদুর রহমান মান্না’র সাথে ভিড়তে থাকলেন কিন্তু মুজিব কোট ছাড়লেন না। একবার সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণাও দিলেন- আওয়ামী লীগ তাকে ফিরিয়ে না নিলেও তিনি বঙ্গবন্ধুর সৈনিক থাকবেন, মুজিব কোট ছাড়বেন না।

সেই মুজিব কোট তার গা থেকে খুলে নিলো সিলেট ছাত্রলীগের এক বহিস্কৃত কর্মী!

অবশ্য এর মধ্যে আরও বহু ঘটনাই ঘটে গেছে। ড. কামাল, মান্নার সঙ্গী হয়ে সম্প্রতি ‘ঐক্যফ্রন্ট’ নামে বিএনপি জামায়াতের সাথী হয়েছেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুরও। মঞ্চে তাকে দেখা গেছে একই সাথে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন সহ বিএনপির মহাসচিবের পাশে। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে ধরা হয় সেই ‘জিনিয়াস ডেভিল’দের একজন হিসাবে- যারা ’৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যার বুদ্ধিবৃত্তিক ইন্ধন জুগিয়েছিলো, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পর এই ব্যারিস্টার খুনি মুশতাকের সাথে রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলো এবং ১/১১ এ শেখ হাসিনাকে কারাগারে পাঠিয়েছিলো।

ইতিহাসের অনেক ধুলো সরিয়ে এখন প্রমাণিত হয়ে গেছে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বেনিফিশিয়ারি শুধু নয়- খুনি মেজরদের প্রশ্রয়দাতা এবং অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী। এই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আদালতের রায়ে একুশ আগস্ট শেখ হাসিনা হত্যা মামলার দণ্ডিত অপরাধী। একদিকে ১৫ আগস্টের খুনি ও একুশে আগস্টের খুনি, সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধের জেনোসাইডের প্রধান অপরাধী জামাতে ইসলামীর রাজনৈতিক সহযোগী বিএনপির ত্রাতা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ড. কামাল হোসেন এবং তার সাথে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। সুলতান তার প্রৌঢ়ত্বে সেই খুনিদের সাথে এক মঞ্চে, যে খুনিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলেন তারুণ্যে।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, প্রায়শই উঠে- বঙ্গবন্ধু কি শুধুই আওয়ামী লীগের? অবশ্যই না!

আওয়ামী লীগ কখনো সে দাবি করতে পারবেনা। বঙ্গবন্ধু নিজে সমন্বয়বাদী নেতা ছিলেন। স্বাধীনতার পরের সরকার শুধু আওয়ামী লীগকে নিয়ে করেননি, তার জোট ছিলো ন্যাপ ও সিপিবির সাথে। বাকশাল করেছিলেন, আওয়ামী লীগকে বিলুপ্ত করে দিয়ে সকল দলকে নিয়ে।

সমন্বয়বাদী বঙ্গবন্ধু কিন্তু জামায়াতে ইসলামিকে নেননি বরং নিষিদ্ধ করেছিলেন। সেই জামায়াতে ইসলামিকে কোন অবস্থাতেই ছাড়বেনা বলে ঘোষণা দিলো যারা, যারা ১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্ট খুনের প্রত্যক্ষ/পরোক্ষ দায়ী- বঙ্গবন্ধু কী তাদেরও? তাদের সহযোগী হয় যারা তাদের কি নৈতিক অধিকার থাকে বঙ্গবন্ধুকে, বঙ্গবন্ধুর চিহ্নকে ধারণ করার?

এদিকে গত ২৩ আগস্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, নেতাজী সুভাষ বসুকে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ঘোষণা দিয়েছেন। ২৩ আগস্ট সুভাষ বসু দখলদার ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। নরেন্দ্র মোদী সুভাষ বসু’র বিখ্যাত টুপি মাথায় চড়িয়ে সুভাষ বন্দনায় মেতেছেন।

সুভাষ মূলত কংগ্রেস নেতা ছিলেন। নেহেরু-প্যাটেলের সাথে দ্বন্ধে গান্ধীজী তার বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন, সুভাষকে বহিস্কার করা হয়েছিলো কংগ্রেস থেকে। ভারতের কমিউনিস্টরা সুভাষ বসু’র রাজনৈতিক মিত্র ছিলেন। ভারত থেকে আফগানিস্তান গিয়ে প্রথমে সোভিয়েত দূতাবাসে ধর্না দিয়েছিলেন বৃটিশদের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধে সহযোগিতা করার জন্য। সোভিয়েত পাত্তা দেয়নি বলে তিনি জার্মানি গিয়ে হিটলারের সাথে দেখা করেছিলেন, তারপর জাপানিদের সাথে নিয়ে সিঙ্গাপুরে বন্দি বৃটিশ ভারতীয় সৈনিকদের ন্যাশনাল আর্মি গঠন করে ভারত আক্রমণ করেছিলেন ইংরেজ তাড়াতে।

কংগ্রেস তো বটেই, কমিউনিস্ট পার্টি তার সমালোচনায় মুখর ছিলো দীর্ঘদিন। সেই সমালোচনা ছিলো ফ্যাসিস্ট জার্মান-জাপানের সহযোগী হবার। তার উদ্দেশ্য যতো মহৎই থাকুক তিনি ফ্যাসিস্টদের সহযোগি হয়েছিলেন। তাকে ফিজোর’কুকুর বলে ও গালিগালাজ করতেন কমিউনিস্টরা। জনমানস থেকে, সাধারণ বাঙালিদের আবেগ থেকে সুভাষ হারিয়ে যাননি বলে- ধীরে ধীরে কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট পার্টি সুভাষ বসুকে মেনে নিয়েছে, শ্রদ্ধার জায়গায় ফিরিয়ে এনেছে।

কংগ্রেস এবং কমিউনিস্টদের সাথে সুভাষের রাজনৈতিক মতবিরোধ ছিলো- শত্রুতা ছিলো না, শত্রুতা ছিলো বিজেপির আদি সংগঠন আরএসএস-এর সাথে। কলকাতায় আরএসএস-এর নেতা শ্যামাপ্রসাদকে পিটিয়েছেন সুভাষ বসু। হিন্দুত্ববাদকে ভারতের মানুষের স্বাধীনতার প্রধান শত্রু বলে গণ্য করতেন সুভাষ। আরএসএস-এর প্রকাশনায় সুভাষ রাবণ বানিয়ে কার্টুন আঁকা হয়েছে যেখানে শ্যামা প্রসাদ আর সাভারকার তার মুখে তীর ছুঁড়ছে।

কংগ্রেস ও কমিউনিস্টরা যখন সুভাষকে গ্রহণ করে তখন সেটা মেনে নেয়া যায়। কিন্তু আরএসএস এর সহযোগি, হিন্দুত্ববাদের এজেন্ডাধারী বিজেপি যখন সুভাষ বন্দনায় মাতে- গুজরাট গণহত্যার খুনি নরেন্দ্র মোদী যখন সুভাষ টুপি মাথায় তুলে তখন বুঝে নিতে হয়- এরা সুভাষকে সম্মান করছেনা, সুভাষকে ব্যবহার করছে নিজেদের ধান্দায়।

কেউ যদি তখন নরেন্দ্র মোদীর মাথা থেকে সুভাষ টুপি ছিনিয়ে নেয়, আমি একে অঘটন ভাববো না।

হয়তো তাই হওয়া উচিত।

  • হাসান মোরশেদ: লেখক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত