শিল্পী রহমান

০৩ নভেম্বর, ২০১৮ ১৬:৪৩

দেশ আমার, দিন আমার, রাতও আমার

তখনও তেমন একটা রাত হয়নি, সন্ধ্যের একটু পরই হবে, কিংবা আরেকটু দেরি হলে হতেও পারে, তবে ১০টার পরে তো অবশ্যই নয়। আমি তখন মাত্র এসএসসি দিয়েছিলাম বোধহয়, ঠিক মনে নেই তবে তেমনই একটা বয়স হবে। আমি, আমার খালাতো বোন এবং উনার হাসবেন্ড, সঙ্গে আরেক বোনের মেয়ে আমরা হাঁটতে বের হয়েছিলাম। আমিই সবার মধ্যে ছোট ছিলাম। ভাগ্নিটা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করছিলো। খালাতো বোন ইডেন কলেজ থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স পাশ করেছিলো এবং উনার হাসবেন্ড ময়মনসিংহ এগ্রিকালচার ইউনিভারসিটি থেকে পাশ করে চাকরী করছিলেন তখন। পরে উনি পিএইচডি করেছেন লন্ডনে গিয়ে। যাইহোক যে কথা বলছিলাম...

খুব সুন্দর একটা রাত ছিল। ভরা জোছনায় ডুবে যাওয়া, ফুরফুরে বাতাসে মাতাল করা একটা রাত। এতো সুন্দর রাতে ঘরে বসে আড্ডা দিতে মন চাইছিল না বলে বেরিয়ে পড়েছিলাম আমরা।

হাঁটতে হাঁটতে জিয়া উদ্যানের লেকটার ধারে চলে এসেছিলাম। গান করছিলাম, গল্প করছিলাম, খুব ভালো লাগছিলো। কিছুক্ষণ পর দুইজন পুলিশ এসে আমাদের প্রশ্ন করা শুরু করলো। আমরা কে, কেন বের হয়েছি ইত্যাদি ইত্যাদি। আপা বলল, দুলাভাই উনার হাসবেন্ড। পুলিশটা বলে, “সার্টিফিকেট আছে?”। দুলাভাই বললেন, “মানুষ কি সার্টিফিকেট নিয়ে ঘোরে নাকি? আপনি চলেন আমার সঙ্গে বাসায়, দেখাবো”। এমন আরও কিছু উদ্ভট প্রশ্ন, এখন অতো মনে নেই। প্রশ্নগুলো বেশ বিব্রতকর ছিল সেটা বড়দের ভাব ভঙ্গিতেই বুঝেছিলাম। কিন্তু ওইসময় আমার কোন ধারনাই ছিলোনা ওরা আমাদের কী ভাবছিল সেদিন। সেই পুলিশ দুজন চলে যাওয়ার পরে জানতে পারলাম, একজন পুরুষ মানুষ, সাথে ৩ জন মেয়ে থাকার একটা ভিন্ন অর্থ তৈরি করেই ওরা আমাদের প্রশ্ন করা হচ্ছিল। এটা শুনে তখন রাগে অপমানে আমার কান্না পাচ্ছিলো খুব। ইচ্ছে হচ্ছিল ওদের খুঁজে এনে খুব করে বকে দেই। মনের মধ্যে একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঘরে ফিরেছিলাম আমরা। সুন্দর রাতটাতে কালিমা ঢেলে দিয়েছিলো সেদিন ওরা।

রাতে মেয়ে মানুষ বের হওয়া মানেই কেন ব্যাপারটাকে সন্দেহের চোখে দেখতে হবে এ আমার এখনো অজানা। এই যে সেদিন আমার ভাবী আর ভাস্তিটা রাত দেড়টার সময় আমার মা কে হাসপাতালে রেখে বাড়ি এসেছিলো কিছু কাপড় চোপড় নিয়ে যাবে বলে, ওই সময় যদি ওদেরকে থামিয়ে কেউ এসব প্রশ্ন করে হেনস্থা করতো তাহলে কেমন লাগতো? আমি হলফ করে বলতে পারি এমন পরিস্থিতি সবার জীবনে আসে। রাত বিরেতে আমাদের যে কোন জায়গায়, যে কোন সময় যেতে হতে পারে। ব্যাপারটা মোটেও অস্বাভাবিক কিছু নয় । মানুষকে এমন অপমানজনক ভাবে জাজ করার কি মানে? দুঃখজনক হলেও কিছু না জেনেই জাজ করা, ধারনার ওপরে নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেয়া আমাদের মজ্জাগত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

একজন পুলিশের হাতে ক্ষমতা আছে বলেই সে তার এমন অপব্যবহার করবে এটা চলতে দেয়া যায়না। আমি জানি সবাই এমন না। অনেক দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন পুলিশও আছে আমাদের সমাজে, তাদের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই লিখেছি, আমার যদি ১৯৮০/৮১ সালে এমন অভিজ্ঞতা হয়, এতদিনে এটার একটা পরিবর্তন হওয়া উচিৎ, সেই প্রত্যাশা কি অবাঞ্ছিত? আমরা কি বেশি চাইছি?

অস্ট্রেলিয়াতে আমাকে অনেকবার পুলিশ ধরেছে, একবার স্পিডিং এর জন্যে, একবার ভুল জায়গায় ইউটার্ন নেবার জন্যে, একবার ড্রাইভ করবার সময় ফোনে কথা বলবার কারণে, বেশ কয়েকবার random breathe test ও হয়েছে (আমার রক্তে এলকোহল আছে কিনা দেখবার জন্যে অর্থাৎ আমি ড্রিঙ্ক করে বা ড্রাগ নিয়ে ড্রাইভ করছি কিনা সেটা যাচাই করবার জন্যে)। যখন পেছন থেকে গাড়ির মাথায় লাল নীল লাইট জ্বালিয়ে পুলিশের গাড়ি আসতে থাকে আর ইশারা করতে থাকতে গাড়ি থামানোর জন্যে। তখন বুকের ভেতর থেকে হৃদপিণ্ড বেড়িয়ে আসবার জোগাড় হয়, অন্তত প্রথম প্রথম তো তাই হোত। নার্ভাস হয়ে গাড়ি থামিয়ে জানালা নামাতে যেয়ে ওয়াইপার চালিয়ে দিয়েছি, অথবা সিডিতে গানের আওয়াজ কমাতে যেয়ে রেডিও চালিয়ে দিয়েছি এমন টুকটাক কাণ্ড করেছি প্রথম প্রথম, পরের দিকে অবশ্য সাহস হয়ে গিয়েছিলো কারণ ততদিনে জেনে গিয়েছিলাম, ওরা শুধুই ওদের দায়িত্ব পালন করছে। আমি অন্যায় করলে তার শাস্তি পাবো, না করলে কোন চিন্তা নেই।

এই যে এতবার পুলিশ আমাকে রাস্তায় থামিয়েছে কোনদিন আমাকে একটা বাজে কথা তো দুরে থাক 'ম্যাম' ছাড়া সম্বোধনই করেনি। প্লিজ, থ্যাংক ইউ, সরি, কাইন্ডলি জাতীয় ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষা ব্যবহার করেনি। প্রথমে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে বর্ণনা করেছে কেন আমাকে থামিয়েছে। "ম্যাম, আপনি একটা ‘ইউটার্ন’ নিয়েছেন যেখানে ‘ইউ টার্ন’ নেওয়ার নিয়ম নেই। অথবা “ ম্যাম আমাদের রেকর্ডে দেখাচ্ছে আপনি একটু আগে স্পিডের মাত্রা ছাড়িয়ে গাড়ি চালিয়েছেন”। আমি তখন আমার অ্যাকশন জাস্টিফাই করার জন্যে বলেছিলাম, “আমি বুঝি নি ইত্যাদি ইত্যাদি”। সে মন দিয়ে শুনে বলেছিল, "জী বুঝতে পারছি আপনি কেন করেছে কাজটি, কিন্তু ব্যাপারটা আসলে ইল্লিগাল হয়েছে এবং আমিউ দুঃখিত যে আপনাকে পেনাল্টি দিতেই হবে। আপনার ‘থ্রি পয়েন্টস’ কাঁটা যাবে আর ফাইন দিতে হবে", তারপর একটা কাগজ বের করে সেটা লিখল, আর ফাইনের জন্যে একটা স্লিপও ধরিয়ে দিলো। বলল "হ্যাভ অ্যা নাইস ডে ম্যাম" আমি থ্যাংকস বলে চলে এলাম। ফোনে কথা বলছিলাম যেদিন, সেদিনও তাই, খুব ভদ্রভাবে, গলার স্বরে সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে বলল, আমি কি অন্যায় করেছি এবং সেটার জন্য আমি কতো নাম্বার আইন ভঙ্গ করেছি তাও বলল, তারপর আমার গল্পটা শুনল, কিন্তু ওর যা যা করার তাই করলো। আমার বিরক্ত হবার কোন অবকাশই ছিল না। টাকা যাচ্ছে, পয়েন্ট যাচ্ছে কিন্তু আমি তা রক্ষার জন্যে চেষ্টাও করছি না। কোন জায়গাই কিছু বলবার বা করবার নেই, কারণ অন্যায় তো আমিই করেছি।

অন্যায় করিনি তবু ধরেছে এমন ঘটনা অবশ্য কখনো ঘটেনি। ব্রেথ টেস্টের সময়, সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছে কিভাবে টেস্টটা নিতে হবে, টেস্ট হয়ে গেলেই ছেড়ে দিয়েছে, এটা সাধারণত উইকেন্ডেই বেশি হয়। নিয়ম থাকলে কোন ঝামেলা হওয়ার কথা না আসলে।

একজন নারী রাতে বাড়ির বাইরে বের হবে তা প্রয়োজনে হোক বা অপ্রয়োজনে, এটা তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বা অধিকার। এর কারণে তাকে রাস্তায় হেনস্থা করার অধিকার কারোরই নেই। সাধারণ মানুষ বা পুলিশ, কারুরই না। উদ্দেশ্যমূলক অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন যেমন “আপনাকে আপনার বাবা মা কি শিখাইসে?” “আপনি কার মেয়ে, কোন মিনিস্টারের মেয়ে?” ইত্যাদি ধরণের প্রশ্ন সত্যি অবান্তর। অন্যায় করেছে কিনা জানবার আগেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেবার মতো অবস্থা। এতো দীর্ঘ সময় ধরে একটার পর একটা উল্টা পাল্টা প্রশ্ন করে হেনস্থা করে আবার সেটার ভিডিও করে বিখ্যাত হবার স্বপ্ন। ওরা হয়তো ভেবেছিল এই ভিডিও দেখে ওদের সবাই বাহবা দেবে অথবা পুরস্কৃত করা হবে। আমি অত্যন্ত গর্বিত যে মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে।

মেয়েটার সাহস দেখেও আমি খুবই মুগ্ধ। সাবাস, এভাবেই সত্যকে স্থাপন করতে হবে।

পুলিশের দায়িত্ব দেশকে রক্ষা করা, মানুষকে রক্ষা করা, কিন্তু সেটা করতে যেয়ে ব্যবহার খারাপ করবার কোন প্রয়োজনই নেই। সেটা একজন অপরাধীর সাথেও না। কেউ অপরাধী হলে, বিচার হবে, তারপর তার শাস্তি হবে। মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে মনে, এদের ট্রেইনিংয়ে কী শেখানো হয়। এই ঘটনার পর কি ট্রেইনিং এর কোন পরিবর্তন হবে? এমন কি হয় যে, প্রয়োজন বুঝে বা অভিযোগ শুনে ট্রেইনিং এর মধ্যে নতুন কিছু সংযোগ করা হবে? হওয়া উচিৎ, প্রয়োজন বুঝেই তো শিক্ষা নিতে হবে মানুষকে। যে কোন শিক্ষা ব্যবস্থাই প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হতে পারে প্রয়োজন অনুযায়ী।

আমি বুঝি উনাদের কাজটা কঠিন, অনেক ধরণের অপরাধীদের সঙ্গে কাজ করতে হয়... কিন্তু উনাদের কাজের ধরনটাই তো এমন, এটা জেনেই তো এই কাজ নিয়েছেন উনারা। যেহেতু বিভিন্ন রকমের মানুষদের সাথে কাজ করতে হয় তাহলে সেই দক্ষতাও অর্জন করতে হবে। উনাদের জন্যে ধৈর্যটা খুব জরুরী।

একটা বিষয় প্রশংসার দাবি রাখে , এই ভিডিওর নীচে মানুষের মন্তব্য দেখে খুব ভালো লেগেছে। এটা যে একটা অন্যায় কাজ হয়েছে তাতে বেশির ভাগ মানুষই একমত হয়েছে। মেয়েটার সম্বন্ধে কেউ খারাপ কিছু বলেনি, উল্টো পুলিশদের এহেন কাজের নিন্দা করেছে সবাই। পুলিশ দুজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে সেটাও যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে। আমার মনে হচ্ছে, যে নিরাপত্তার স্বপ্ন দেখেছে সমাজের প্রতিটি নারী এতদিন। তা হয়তো এখন আর স্বপ্ন থাকবে না, বাস্তবে পরিণত হবে।

আর হেনস্থা নয়, দিনে কিংবা রাতে নারীদের নিরাপদ এবং অবাধ চলাচল সুনিশ্চিত হোক। এই দেশ আমার, দিন আমার এবং রাতও আমার।

শিল্পী রহমান: কাউন্সেলর এবং ‘দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলছি’র প্রবর্তক

আপনার মন্তব্য

আলোচিত