চয়ন চৌধুরী

১০ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:৪১

ধানের শীষের ‘মালিক’ কে হবেন?

উচ্চ আদালতের নির্দেশে নির্বাচন কমিশন সংশোধিত গঠনতন্ত্র গ্রহণ না করায় নেতৃত্ব সঙ্কটে পড়েছে বিএনপি। দুর্নীতির মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আট মাস ধরে কারাগারে। ‘ভারপ্রাপ্ত’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। লন্ডনে ‘পলাতক’ তারেক রহমান একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত। দুর্নীতির মামলায়ও তিনি সাজাপ্রাপ্ত। এমন অবস্থায় নির্বাচন কমিশন বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র গ্রহণ না করায় তাদের দু’জন দলের নেতৃত্বে থাকতে পারবেন না। অন্তত নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বা ভোট সংশ্লিষ্ট কোন কার্যক্রমেই তাদের রাখতে পারবে না বিএনপি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বেগম খালেদা ও তারেকের বদলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কঠিন এই সময়ে কে বিএনপিকে নেতৃত্ব দেবেন? নতুন জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ড. কামাল হোসেন নেতৃত্ব দিলেও এখানে বিএনপির দলীয় বিষয় জড়িত। বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি হলেও গঠনতান্ত্রিকভাবে চেয়ারপারসন বা সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে ‘ভারপ্রাপ্ত’ চেয়ারপারসন হবেন ভাইস চেয়ারম্যানরা। ২০১৬ সালের গঠিত সর্বশেষ গঠিত জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে প্রথম সহ-সভাপতি হিসেবে সাবেক বিচারপতি এইচটি খান এখন ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান’ হওয়ার কথা। কিন্তু বয়োবৃদ্ধ এইচ টি খানের পক্ষে দলকে নেতৃত্ব দেওয়া অসম্ভব। এরপর তালিকায় থাকা সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান স্ত্রীসহ দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত।

বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে তারপর ভাইস চেয়ারম্যানদের তালিকায় ক্রমান্বয়ে আছেন হারুন আল রশীদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, আবদুল্লাহ আল নোমান, সাদেক হোসেন খোকা, মিসেস রাবেয়া চৌধুরী, অধ্যাপক আবদুল মান্নান থেকে ৩৫তম শওকত মাহমুদ পর্যন্ত। এই ৩৫ জনের মধ্যে কাউকে কি বিএনপি ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান’ করবে? একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গেলে বিএনপিকে এই কঠিন কাজটুকু করতেই হবে! নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক দলের প্রধান দলীয় প্রতীক বরাদ্দের চিঠি দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মনোনয়ন দিয়ে থাকেন। অবশ্য দলীয় প্রধানের অনুমতিক্রমে বিভিন্ন দলের সাধারণ সম্পাদক/মহাসচিব বা অন্য কেউ মনোনয়নে সাক্ষর করার সুযোগ রয়েছে। এই হিসেবে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বা অন্য কেউ বিএনপির হয়ে এই দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।

কিন্তু এমন কাউকে এই ‘দায়িত্ব’ দলীয় প্রধানকে লিখিতভাবে দিতে হবে; যিনি নির্বাচন কমিশনে পার্টির প্রধানের নিয়োজিত প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত হবেন। বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিরোধিতা করে আসা বিএনপি নতুন এই চ্যালেঞ্জ কিভাবে মোকাবেলা করবে; তা দেখার বিষয়। আবার দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট (আসলে প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়েছিল) করে নিবন্ধন হারানোর ঝুঁকিতে থাকার আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণেরও বাধ্যবাধকতা রয়েছে তাদের। একাদশ জাতীয় সংসদের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ১৯ নভেম্বরের মধ্যে মনোনয়নপত্র দাখিল করতে হবে। ফলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হলে বিএনপিকে এখন দ্রুত কাগজে-কলমে হলেও একজন চেয়ারম্যান নির্ধারণ করতে হবে।

কিন্তু বেগম খালেদা বা তারেকের অবর্তমানে ‘নতুন নেতা’ নির্ধারণও বিএনপির জন্য সহজ হবে না। জাতীয় নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যানদের যে ক্রমানুসার, তাদের যে কারও জন্যই দলের নেতৃত্বের হাল ধরা কঠিন হবে। শেষপর্যন্ত পরিস্থিতির প্রয়োজন মেটাতে একজনকে বেছে নেওয়া হলেও তিনি দলকে কতটা ঐক্যবদ্ধ করতে বা রাখতে পারবেন; তাও প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচনের ঠিক আগে ভোটের হিসেবের পাশাপাশি এই হিসেবও মেলাতে হবে বিএনপিকে। রাজশাহীতে সমাবেশে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন নিয়ে অবস্থান স্পষ্ট করবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু ড. কামাল হোসেনের অনুপস্থিতিতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তথা বিএনপি এ পথে হাঁটেনি। শনিবার বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট করতে পারে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর রয়েছে।

একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩১ অক্টোবর বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র গ্রহণ না করতে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। পাশাপাশি এক মাসের মধ্যে বিষয়টি সুরাহা করার নির্দেশ দেন আদালত। নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ জানিয়ে দিয়েছেন, আদালতের নির্দেশের পর কমিশন বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র গ্রহণ করবে না। এতে বাহ্যত কোন সমস্যা না হলেও দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত বেগম খালেদা ও তারেক রহমানকে বিএনপির চেয়ারপারসন বা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে এখন মানতে পারবে না নির্বাচন কমিশন। বেগম খালেদার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার রায় ঘোষণার ১০ দিন আগে তাকে বা তারেককে শীর্ষ পদে রাখতে গিয়ে দলের গঠনতন্ত্রের ৭ ধারা বিলুপ্ত করে এখন উল্টো তাদের নেতৃত্ব সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে বিএনপি।

বিএনপির গঠনতন্ত্রে ৭ নম্বর ধারায় ‘কমিটির সদস্যপদের অযোগ্যতা’ শিরোনামে বলা আছে, ‘নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণ জাতীয় কাউন্সিল, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, জাতীয় স্থায়ী কমিটি বা যেকোনো পর্যায়ের যেকোনো নির্বাহী কমিটির সদস্যপদের কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থীপদের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।’ তারা হলেন: (ক) ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ৮-এর বলে দণ্ডিত ব্যক্তি। (খ) দেউলিয়া, (গ) উন্মাদ বলে প্রমাণিত ব্যক্তি, (ঘ) সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ বা কুখ্যাত বলে পরিচিত ব্যক্তি।

এমন পরিস্থিতির মধ্যে বিএনপি এবারে নির্বাচনে যাওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। এখন প্রশ্ন, কার নেতৃত্বে নির্বাচনে যাচ্ছে বিএনপি?

চয়ন চৌধুরী: সাংবাদিক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত