ডা. সাঈদ এনাম

০৭ ডিসেম্বর, ২০১৮ ২৩:৪৭

অধ্যাপক জেড খাঁন স্যার: আমাদের মার্জনা করবেন

অধ্যাপক 'জেড খাঁন' স্যার আমাদের বেশ ক'জন কে দ্বিতীয় পেশাগত পরীক্ষায় কমিউনিটি মেডিসিন সাবজেক্টের ক্লিয়ারেন্সে আটকে দিলেন। একেবারে কঠিন ভাবে আটকা। অভিভাবক নিয়ে দেখা করতে বললেন প্রত্যেককে।

এতদিন চলে গেলো স্কুল-কলেজে পড়ালেখা করে, কোথাও কখনো অভিভাবকের প্রয়োজন হয়নি, আজ এই বুড়ো বয়সে মেডিকেল কলেজে এসে অভিভাবক সহ শো'কজ। বিষয়টা রীতিমত অপমানের।

দ্বারস্থ হলাম সেঁজুতির। ও এক সিলেটি ঢাকা ভার্সিটির। অভিভাবক খালা সেজে বিপদ পার করে দেবার প্রস্তাব পাড়াতে সে রেগেমেগে বললো, 'আমাকে দেখতে কি তর খালার বয়সী লাগে। খবরদার আর কোনদিন আসবিনা'। ঘটনার পর থেকে আজঅবধি সেঁজুতির সাথে আমার আর দেখা নেই। মেয়েদের সাথে বয়স নিয়ে কথা বলে।

নিরুপায় হয়ে গুমরো মুখে মেডিকেল হোস্টেলের মেইন বিল্ডিংয়ে রুমে ফিরছি। এক বড় ভাই ডেকে পরামর্শ দিলেন 'অভিভাবক' বিষয়টি সুন্দর সুরাহার।

প্রাপ্ত বয়সে অভিভাবক সহ ডিপার্টমেন্টে দেখা করাটা আমাদের অনেকের জন্যে লজ্জাজনক লাগলো। তথাপি অভিভাবক নিয়ে যেতেই হলো। আমিও গেলাম। অভিভাবকদের একটা রেজিস্টার খাতা তৈরি হয়ে গেলো।

স্যার অভিভাবকদের সাথে খারাপ তেমন কোন আচরণ করেন নি। সবাই বেরিয়ে স্যারের পক্ষ নিয়েই বললেন, "ঠিকই'তো, তোমরা ক্লাস করোনা কেন ঠিকমতো?", "একশো'টি ক্লাসে কেউ চল্লিশ, কেউ পঞ্চাশটিতে প্রেসেন্ট। চিকিৎসাবিদ্যায় এরকম করলে হবে..."?!

সিদ্ধান্ত নিলাম কমিউনিটি মেডিসিন গ্যাপ দিবো, বাকি সব সাবজেক্ট গুলোতে বসে যাবো। কিন্তু কিভাবে জানি কথাটা 'জেড খাঁন' স্যার জানলেন।

একদিন সকালে দুজন ক্লাসমেট হোস্টেলের রুমে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, 'স্যার ডেকেছেন'।

মাই গড, ভয়ে হাত পা কাঁপতে থাকলো। স্যার আমাদের সামনেই 'ম' ম্যাডামকে ডেকে বললেন, "যে কয়টারে আটকেছি ওগুলার একটা ক্লিয়ারেন্স পরীক্ষা নেন। সব প্রশ্ন আমি করবো। পাস করলে পরীক্ষায় বসতে দিবো। না হয় দিবো না"।

পড়লাম বিপদে। মনস্থির করেছিলাম পরের টার্মে ধীরেসুস্থে বসবো, কিন্তু স্যারের দেয়া শর্তে এ যেনো 'শাঁখের করাত'। মাথা ভনভন করে ঘুরতে থাকলো। ক্লিয়ারেন্স নিতে হলে পরীক্ষা দিতেই হবে, নাহলে পরের টার্মের ক্লিয়ারেন্সও অনিশ্চিত।

স্যারের নির্দেশে 'ম' ম্যাডাম আমাদের ক'জনের পরীক্ষা নিলেন। একেবারে রুদ্ধদ্বার পরীক্ষা। পরীক্ষার হলেই ম্যাডাম পড়িয়ে দিলেন, বুঝিয়ে দিলেন.....! আমরা গটগট করে লিখে পরীক্ষার পাতা ভরিয়ে ফেললাম।

স্যার খাতা দেখলেন চিলের চোখ নিয়ে। ক্লিয়ারেন্স পরীক্ষায় কিভাবে কিভাবে পাস করে ফেললাম।

"ইয়া হু...." তার মানে আমি এ টার্মেই বসতে পারছি...! হোস্টেলে আমার রুমে রীতিমত দু তিনজন বন্ধুর পার্টি চললো।

স্যার আমাদের কয়েকজনকে ফের ডেকে নিয়ে বললেন, "দেও পরীক্ষা। দেখি কিভাবে পরীক্ষায় পাস করো"। স্যারের মুখে বাংলার ভিলেন 'ডিপজলের' হাসি।

দিনরাত কেবল কমিউনিটি মেডিসিন পড়ি। আর নামাজ পড়ে দোয়া করি, স্যারের মাথায় যেনো আল্লাহর গজব পড়ে। অসুস্থ হয়ে স্যার যেনো পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকেন, পরীক্ষা নিতে না পারেন। একপ্রাতে স্বপ্নে দেখলাম, অজানা কারণে স্যার এবারের ভাইবা বোর্ডে থাকছেন না।

কথায় বলে, শকুনের দোয়ায় গরু মরে না। গরু বলদের মতো আরও মোটাতাজা হয়।

টপাটপ দিন পেরিয়ে সব রিটেন শেষ। কমিউনিটি মেডিসিন পরীক্ষার ভাইবা চলছে। ইন্টারনাল 'অধ্যাপক জেড খাঁন' স্যার। আর এক্সটারনাল দেশ সেরা স্বনামধন্য শিক্ষক 'অধ্যাপক বড় ভুঁইয়া' স্যার। পরীক্ষা দিয়ে এক এক করে প্রায় সবাই কেঁদেকেটে বের হচ্ছে রুম থেকে।

আমার পালা। 'জেড খান' স্যার হেসে হেসে বললেন, "আসেন আসেন, আপনার অপেক্ষাই তো করছি। বসেন"।

শুরু হলো ভাইবা, 'আরে আপনি তো বেশ ফাঁকিবাজ, ফাঁকিবাজের লিডার। গার্জিয়ান গ্রুপের মেম্বার না? ক্লিয়ারেন্স পাননি। শেষ মুহূর্তে কেমনে কেমনে জানি ক্লিয়ারেন্স পেয়েছেন তাইনা"? আমার চোখ দিয়ে পানি আসার মতো অবস্থা। সাক্ষাৎ পরীক্ষা হলেই অপমান...! তবুও ধৈর্য ধরে ভাইবা ফেইস করছি।

এক্সটারনাল স্যারের প্রশ্নের উত্তরগুলো তেমন খারাপ না করলেও, ইন্টারনাল স্যার, মানে 'অধ্যাপক জেড খাঁন' স্যারের প্রশ্নে ভীষণ অপমানিত বোধ করতে থাকলাম।

তিনি পুতুপুতু করে "বাবা, কমিউনিটি মেডিসিন বানান করতো", "কমিউনিটি মেডিসিন মানে কী বলতো?" এসব সহজ অপমানজনক প্রশ্ন করতে থাকলেন। এক পর্যায়ে এক্সটারনাল স্যারকে টিপ্পনী কাটলেন, "দেখছেন দেখছেন, আপনার দেশি ছেলে, সোনার টুকরা সিলোটির পড়াশুনা"।

সব সহজ ও অপমানকর প্রশ্ন হলেও আমি ধৈর্য হারা না হয়ে ধরে ধীরে ধীরে হেসে হেসে উত্তর দিচ্ছিলাম স্যারের সব প্রশ্নের। ভয় কী। বড় জোর ফেইল হবে, আর কিছুনা তো।

ভাইবা শেষ হলো। জানি নিশ্চিত ফেল। কিন্তু এভাবে অপমান করে ফেল করানোর কোন মানে হয়না। অপমানে চোখ, নাক-মুখের পানি সব একাকার।

সকল পরীক্ষা শেষে বিশ্রাম না নিয়েই সময় নষ্ট না করেই ধীরে ধীরে আবার কমমেড নিয়ে বসলাম। পরের টার্মে বসতে হবে।

তিন মাস পর রেজাল্ট পেয়ে আমি বাকরুদ্ধ। তরতর করে চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আমি কমিউনিটি মেডিসিনে পাস করেছি। ও মাই গড....! কেমনে কি...? এ আমার কাছে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের মতো লাগলো।

কেউ কেউ বলাবলি করলো আমি নাকি জ্যাক লাগিয়েছিলাম। তৎকালীন সবচেয়ে দাপুটে মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের জ্যাক। তা নাহলে হোস্টেল থেকে ডেকে নিয়ে ক্লিয়ারেন্স দান, অত:পর পাসও।

দুই.
আজ একটা সত্য কথা বলি। আল্লাহর কসম, সেদিন আমি কোন জ্যাক লাগাইনি।

আরেকটি সত্য কথা বলি, সেদিন যাদের গার্জিয়ান হিসেবে যাদের উপস্থিত করি, উনারা আসলে আমার আসল গার্জিয়ান ছিলেন না। নিউমার্কেট থেকে ভাড়া করা একজন পুরুষ এবং মহিলা ছিলেন। ১০০০ + ১০০০ = ২০০০/- টাকা দিয়ে উনাদেরকে ভাড়া করে চুক্তি করে আনি, জাস্ট গার্জিয়ানের অভিনয়টা করতে হবে বলে। প্র্যাকটিসও করাই, স্যারের কী প্রশ্নের উত্তরে কী বলতে হবে। উনাদের অভিনয়টা ভালো ছিলো।

স্যার, আপনি গুরু। গুরুরাই সঠিক। সার্জারির অধ্যাপক সেলিম ভুঁইয়া স্যার বলতেন, ছাত্রের মাথা শিক্ষকের পায়ের নীচে নয়, পায়ের তলার মাটির এক লক্ষ মাইল নীচে'।

'জে খাঁন' স্যার, আমাদের ক'জনকে ক্ষমা করবেন, সেদিন নকল গার্জিয়ান নেওয়ার জন্যে। এছাড়া আমাদের যে আর কোন পথ খোলা ছিলোনা। গার্জিয়ান যারা তারা হয় সিলেটে নয় বিদেশে। তাছাড়া ইজ্জতের সওয়ালও বটে, বুড়ো বয়সে গার্জিয়ান শোকজ।

'ম' ম্যাডাম আপনি মায়ের মতো স্নেহ করতেন আমাকে, আমাদের সবাইকে। রুদ্ধদ্বার পরীক্ষায় সেদিন প্রায় সব উত্তর ঈশারা ইঙ্গিতে বলে দিয়েছেন। আপনাকেও ধন্যবাদ।

  • ডা. সাঈদ এনাম: সাইকিয়াট্রিস্ট

আপনার মন্তব্য

আলোচিত