অসীম চক্রবর্তী

১৬ ডিসেম্বর, ২০১৮ ২১:১৭

ওরা বলে খামোশ

১৪ ডিসেম্বর ঘুম থেকে উঠেই দেখি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে খামোশ শব্দটি ভাইরাল হয়ে গেছে।কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখি কেঁচো খুঁড়তে সাপ।যে কালসাপ নিজের জীবনের আশিটি বছর সযতনে লুকিয়ে রেখেছিলেন ডক্টর কামাল।হটাৎকরেই সেই সাপটি নিজের ভেতর থেকে খামোশ শব্দের মাধ্যমে বেরিয়ে এলো শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের প্রভাতে।

হ্যাঁ শুক্রবার ছিলো শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। যেদিনে বাংলাদেশের তৎকালীন জাময়াতে ইসলামী নামক রাজনৈতিক দলের কর্মীদের সহায়তায় গুনেগুনে বেছেবেছে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করেছিলো পাকিস্তানী জান্তারা।সেই দলে ছিলেন প্রথিতযশা শিক্ষক, ছিলেন ডাক্তার, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিককর্মীসহ বিভিন্ন পেশার সবচেয়ে মেধাবী মানুষগুলো।লক্ষ্য একটাই স্বাধীনতার প্রাক্কালে দেশকে মেধা শূন্য করা।  তারা সেটা পেরেছিলো আমাদের দেশীয় রাজাকার, আলবদর বাহিনীরকর্মীদের সহায়তায়।

এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে আটচল্লিশটি বছর পদ্মা মেঘনা যমুনায় গড়িয়েছে অনেক জল।আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচার হয়েছে শীর্ষ মানবতা বিরেধী অপরাধীদের, এখনো চলমান আছে বাকি রাজাকার আলবদরদের বিচারিককার্য, হয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, একুশে অগাস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার।বিচার করে দোষীদের সাজা দেওয়া যায়। তবে মানসিক ভাবে দেউলিয়া এবং যাদের মনের মধ্যে পাকপন্থী কালসাপ ঘাপটি মেরে আছে সেটাকে কি বিচারিক কার্যের মাধ্যমে বের করে আনা সম্ভব? সম্ভব নয়।

ডক্টর কামাল হোসেনকে দেশের মানুষ বহু বছর ধরে চেনে। প্রথিতযশা আইনবিদ,  বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য এবং গন্ততন্ত্র প্রতিষ্ঠার সৈনিক হিসাবে। আজ পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে জয়লাভ না করলেও তিনি হয়েছেন সংবিধানপ্রণেতা, বঙ্গবন্ধুর বদৌলতে দায়িত্ব পালন করেছেন আইন, পররাষ্ট্র ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসাবে। জনপ্রিয়তা এবং লিডারশিপ কোয়ালিটি না থাকলেও নেতৃত্ব দ্বন্দে ত্যাগ করলেন আওয়ামীলীগ এবং  গঠন করলেন গণফোরাম যা প্রায় সকলকর্মেই ছিলো অসফল। তবে তাঁর বর্তমান পরিচয়টি খুবই মজার।  যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের পৃষ্টপোষক বিএনপির সাথে নির্বাচনী জোট করেছেন। অথচ মুখেমুখে  বলছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা।  ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট  এবং নৈরাজ্যের কারণে ভরাডুবি হওয়া বিএনপিজোটের সাথে আলিঙ্গন করে বলছেন দুর্নীতি বিরুধী কথা। এইতো গত বছর, জিয়া অরফানেজ মামলায় দন্ডপ্রাপ্ত বেগম জিয়ার মামলা চলাকালীন সময়ে তাঁকে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ করলো বিএনপি। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করলেন। কিন্তু আজকে মাঠে ময়দানে দাঁড়িয়ে গলা ফাঁটিয়ে আদালতকতৃক দন্ডপ্রাপ্ত বেগম জিয়ার মুক্তির কথা বলছেন। একজন নেতার রাজনৈতিক পঁচনের জন্য এই উদাহরণই কি যথেষ্ট নয়?

মজার কথা হলো ইদানিং ঐক্যফ্রন্টে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াত এবং যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত রাজাকারদের সন্তানদের নমিনেশন দেওয়া এবং এক প্রতীকে নির্বাচন করার কথা জিজ্ঞেস করলেই ডক্টর কামাল এবং তাঁর ফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা তেড়ে আসছেন। সাংবাদিকদের ব্যাক্তিগত আক্রমণও  করছেন। কিছুদিন আগে নোংরাভাষী ব্যারিস্টার মইনুল সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টিকে অশালীন ভাষায় আক্রমণ করে শ্রীঘরে গেলেন। এর কিছুদিন পরে আরেক নেতা আ স ম আব্দুর রব মাছরাঙা টিভির বার্তা প্রধান নজরুল কবিরকে ব্যাক্তিগত আক্রমণ করেব ললেন, আ স ম রব যখন রাজনীতি শুরু করেছেন তখন নাকি সাংবাদিক নজরুল কবিরের বাপেরও জন্ম হয়নি।

সর্বশেষ যে ঘুমন্ত কালসাপটি বেরিয়ে এসেছে ডক্টর কামাল হোসেনের মুখ দিয়ে। বুদ্ধিজীবী দিবসে শহীদের বেদিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে ডক্টর কামাল বলছিলেন তাদের ঐক্যফ্রন্ট স্বাধীনতার চেতনাকে সমুন্নত রাখতে চায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়তে চান এবং গনতন্ত্র প্রতিষ্টা করতে চান। এই মুহূর্তে যমুনা টিভির সাংবাদিক ভাস্কর ভাদুড়ীর ঐক্যফ্রন্টে জামায়াত বিষয়ক প্রশ্নে ডক্টর কামাল  রাগেক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠেন। চুপ করতে বলেন উপস্থিত সাংবাদিকদের। প্রশ্ন তোলেন সাংবাদিকদের নৈতিকতা নিয়ে। সাংবাদিকদের টাকার বিনিময়ে বিক্রি হবার কথা বলেন এবং চিনে রাখছেন বলে হুমকি দিলেন। এক পর্যায়ে তিনি আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের ভাষায় বলেন "খামোশ"
অর্থাৎ যে লোক একটু আগে গণতন্ত্রের কথা বললো সেই লোকই সাংবাদিকদের চুপ করিয়ে দিচ্ছে, বলছে চুপ থাকো, খামোশ। অথবা স্বাধীনতার চেতনায় দেশ গড়ার কথাবলে তৎক্ষণাৎ স্বাধীনতাবিরুধী জামায়াতে ইসলামীর সাথে সখ্যতার প্রশ্ন তুলতেই সাংবাদিকের চরিত্র হননের চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে।  

নৈতিকতা কতটা লোপ পেলে অথবা ক্ষমতার মোহে কতটা অন্ধ হলে মানুষ এমন তাৎক্ষণিক দ্বিচারিতা করতে পারে? ডক্টর কামাল আজকে যে সব সাংবাদিকদের টাকা খেয়ে বিব্রত কর সত্য প্রশ্নগুলো করছে বলে দুর্ব্যবহার করছেন অথবা চুপ করিয়ে দিতে চাচ্ছেন সেই কামাল সাহেব কিন্তু  টাকা খেয়ে দেশের স্বার্থবিরুধী এশিয়ান এনার্জির পক্ষ্যে মামলা লড়েছেন। সুতরাং টাকা খেয়ে কাজ কেমনে করতে হয় সেটা নিশ্চয়ই ডক্টর কামাল হোসেন সবার থেকে বেশিই জানবেন।

একজন রাজনীতিবিদ দল বদল করতে পারেন। যে আদর্শের বিরুদ্ধে সারাজীবন বক্তব্য দেন, ক্ষমতার লোভে সেই আদর্শকে আলিঙ্গন করতেই পারেন। তবে সাংবাদিকের মুখবন্ধ করে দেওয়া, চুপ করিয়ে দেওয়া, চিনে রাখলাম বলে হুমকি দেওয়া অথবা খামোশ বলে উদ্যত আচরণ করা একজন স্বৈরাচারী শাসকের আচরণ হলেও কখনোই একজন গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক নেতার বৈশিষ্ট হতে পারে না।  সাধারণ মানুষ নেতাদের কাছে যেতে পারে না বিধায়  জনগণের হয়ে নেতাকে প্রশ্ন করার কাজটা সাংবাদিকরাই করেন। ডক্টর কামাল এই প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। কিন্তু সাংবাদিকদের সাথে অশালীন ব্যবহার কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। এ ধরণের অশালীন ব্যবহারের জন্য ডক্টর কামালের উচিত প্রকাশ্যে জাতির কাছে  ক্ষমা চাওয়া। সাংবাদিকদের কাজ হলো প্রশ্ন করা। আদর্শিকভাবে একটি সৎ রাজনৈতিক নেতা কখনোই নির্ভিক উত্তর দিতে পিছপা হন না।

অনলাইনে একটা কথা খুব প্রচলিত আছে। ল্যাঞ্জা ইজ ডিফিক্যাল্ট টু হাইড।২০১২/২০১৩সালে আমরা দেখেছি ডক্টর কামাল হোসেনের জামাতা যুদ্ধাপরাধী নিজামী, মুজাহিদ সাকা দের বাঁচাতে ডেভিড বার্গম্যান হেনো কোনো কাজ বাকি রাখেনি।  তখনি ডক্টর কামাল হোসেনের স্খলনের আভাস পেয়েছিলাম।  এখন পেলাম সেই স্খলনের সচিত্র বিবরণ।
গত কয়েক মাস ধরেই দেশের জনগণ দেখছে পঁচে যাওয়া কতিপয় তথাকথিত সুশীল, আইনবিদ এবং বিশিষ্ট নাগরিকের পংকিল রাজনৈতিক নীতিহীনতার কালসাপ এবং সেই সাপের লেজ।যা তাঁরা বহু বছর সযতনে লুকিয়ে রেখেছিলেন নিজেদের মধ্যে। প্রমানসহ এক প্রবন্ধে বরেণ্য সাংবাদিক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী  ডক্টর কামাল সম্পর্কে বলেছেন. কামাল হোসেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করতেন না, যিনি সবসময়ই নিজের আখের গুছানোয় ব্যাস্ত থাকলেও রাজনৈতিকভাবে তিনি একজন সর্বৈব ব্যর্থ একজন নেতা।

বুঝলাম ডক্টর কামাল একজন খুবই উচ্চশিক্ষিত মানুষ, খুবই উচ্চপর্যায়ের আইন বিশেষজ্ঞ তবে সাংবাদিকদের সাথে গতদিনের ব্যবহারে তাকে রাজনৈতিকভাবে খুবই স্বল্পশিক্ষিত এবং খুবই ক্ষুদ্র মানুষ বলেই মনে হয়েছে। মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও ভিতরের অটোক্রেটিক কামাল হোসেনকে দেখা গেলো। যিনি নিজে দলের ভেতরে গণতন্ত্র চান, মাইনাস টু চান তাঁর নিজের দলের ভেতরেই গণতন্ত্র নেই প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে।  যার পরমতে শ্রদ্ধা নেই, নেই সত্যকে মোকাবেলা করার সৎ সাহস। এমন নীতিহীন পঙ্কিল রাজনীতিবিদরা যখন মুক্তমতের কথা বলেন, গণতন্ত্রের কথা বলেন, স্বাধীনতার চেতনার কথা বলেন তখন হাস্যকর শোনায়। আজকের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে ডক্টর কামাল তাঁর অতীতের সব রাজনৈতিক অর্জনকে বিষিয়ে তুলেছেন।তাঁর আজকের কর্মকান্ড এবং জামায়াত বিএনপির সাথে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন, আসন বন্টন এবং এক প্রতীকে নির্বাচন করার পরেও জামায়াত প্রশ্নে ক্রোধান্বিত হওয়া দেখে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে ডক্টর কামাল হোসেন "কতো টাকা পেয়েছেন? কতো টাকার বিনিময়ে জীবনের সকল নীতি আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে  জামায়াতে ইসলামীর যুদ্ধাপরাধের মতো জঘন্য অপরাধকে জায়েজ করার মিশনে নেমেছেন?


আপনার মন্তব্য

আলোচিত