আব্দুল হাই আল-হাদী

০৫ জানুয়ারি, ২০১৯ ১৮:৩৬

‘এক ডিমের’ মসজিদ

সামনে ইমাম, পেছনে নামাজীদের সারি মাত্র একটি। সে সারিতে মাত্র সাতজন মুসল্লি দাঁড়াতে পারেন। ইমামসহ মসজিদের ধারণক্ষমতা মোট আটজন । মসজিদটি ছোট্ট হলেও তার পরতে পরতে লেগে আছে আভিজাত্যের ছাপ। দৃষ্টিনন্দন, সে মসজিদের স্থাপত্যশৈলী অপূর্ব। স্থানীয়দের কাছে মসজিদটি ’গায়েবী মসজিদ’ নামে পরিচিত। অবশ্য অনেকেই মসজিদটিকে ‘এক ডিমের মসজিদ’ নামে ডেকে থাকেন।

মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত আজান হয়, জামাতও হয় নিয়মিত। বর্তমানেও গ্রামবাসী নামাজের জন্য এ মসজিদটি-ই ব্যবহার করছেন। দুনিয়াতে ছোট এরকম মসজিদের আরও নিদর্শন আছে; কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেগুলো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। তাই নামাজ পড়ার উপযোগী বিশ্বের ক্ষুদ্রতম মসজিদ যে ‘এক ডিমের মসজিদ’, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

সিলেটের পর্যটনখ্যাত গোয়াইনঘাট উপজেলায় রহস্যময় অথচ দৃষ্টিনন্দন সে মসজিদটির অবস্থান। সিলেট থেকে গোয়াইনঘাট হয়ে পর্যটনস্পট পান্তুমাই  যাওয়ার পথে আরকান্দি বাজার। সে বাজার থেকে প্রায় দু’কিলোমিটার মেঠোপথ ধরে পশ্চিম দিকে গেলেই কালাইউরা গ্রাম। সে গ্রামের মধ্যেই প্রাচীন আমলের অপূর্ব স্থাপত্যশৈলীর ক্ষুদ্রাকার মসজিদটির অবস্থান। মাত্র আটজন মানুষের ধারণক্ষমতার ব্যতিক্রমী এ মসজিদটি দেখার জন্য প্রতিদিন অনেক মানুষ এখানে এসে থাকেন।

মসজিদটির বহিরাবরণ পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, উত্তর-দক্ষিণে দেয়ালের দৈর্ঘ্য ৩.৮৪ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে চওড়া ২.৯৫ মিটার। মসজিদটির চারকোণে চারটি মিনারের মতো স্তম্ভ আছে। এগুলোকে কর্ণার টাওয়ার বা বুরুজ বলা হয়। এগুলো ছাদ ভেদ করে সোজা উপরের দিকে উঠে গেছে। এগুলোর চূড়ায় রয়েছে চমৎকার কলস ও ফুলকুড়ি নকশা। এগুলোর গায়ে কার্ণিসের প্রায় ২ ফুট নীচে বলয়াকৃতির একটি রিং ছাড়া বিশেষ কোন কাজ নেই । মিনারের অগ্রভাগে ৩টি সদৃশ কার্নিস আছে এবং উপরের কলার থোড় আকৃতির কারুকাজ দেখা যায়। পশ্চিমের দেয়ালে বাইরে মধ্যখানে মেহরারের অংশটি চৌকাণাকৃতি এবং সাদাসিদে সোজা ভূমি থেকে উপরের ছাদের সাথে মিশে গেছে।  বাইরে মসজিদের মূল ঘর থেকে উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে একটি দেয়াল আছে। মূল ঘর থেকে দেয়ালটি দক্ষিণ দিকে ২.৮৮ মিটার, পশ্চিম দিকে ১.৩৪ মিটার এবং উত্তর দিকে ১.৩৪ মিটার দূরে অবস্থিত। পশ্চিম দিকে দেয়ালের দৈর্ঘ্য ৮.৮৪ মিটার। দেয়ালের উচ্চতা ০.৭১   মিটার এবং  পুরো দেয়ালের মধ্যে ৯ টি মিনারাকৃতি দৃষ্টিনন্দন খুটি আছে। প্রত্যেকটি খুটির উচ্চতা ১.০৫ মিটার। প্রত্যেকটি খুটির উপরে দৃষ্টিনন্দন মোটিফ আছে। মসজিদের পূর্বদিকে খোলা বারান্দার মতো একটি স্থাপনা ছিল যেটি কিছুটা সংস্কার করা হয়েছে নামাজীদের স্থান সংকোলনের জন্য। বাইরের দেয়ালের পশ্চিমে লাগোয়া ২ টি কবরস্থানের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। গ্রামবাসীর মতে, কয়েক বছর আগেও এগুলো সুন্দর কারুকার্যখচিত দেয়ালঘেরা ছিল। দেয়ালের উপরে আস্তর করা বলে ভেতরের ইট দেখা যায় না। মসজিদ ঘরের চারদিকে বর্ধিত কার্ণিস আছে। এটি সাদাসিদে এবং এতে কোন কারুকার্য নেই। দেয়ালের উপরে কার্ণিসের নীচে দেয়ালের পুরুত্বের চেয়ে খানিকটা বড় কোণাকৃতি ভিম চারপাশে দেখা যায়। এতে কোন বিশেষ কারুকার্য নেই।   

মসজিদের অভ্যন্তরভাগের স্থাপত্যশৈলী খুবই দৃষ্টিনন্দন। ঘরের পরতে পরতে আভিজাত্যের ছাপ দৃশ্যমান। ঘরটির অভ্যন্তরের উত্তর-দক্ষিণ দেয়ালের দৈর্ঘ্য ৩.০৯ মিটার (১০ ফুট ২ ইঞ্চি) এবং প্রস্থ ২.০৮ মিটার (৬ ফুট ১০ ইঞ্চি) । ঘরের দেয়ালের পুরত্ব ০.৪৬ মিটার (১ ফুট ৬ ইঞ্চি)। উত্তর ও দক্ষিণ পশ্চিম দেয়ালে ক্রিকোণাকৃতি দু’টি গবাক্ষ আছে। আলো ও বাতাস চলাচলের জন্য এগুলো তৈরি করা হয়েছে। গবাক্ষের মধ্যভাগের উচ্চতা ০.৬০ মিটার(১ ফুট ৫ ইঞ্চি), মধ্যভাগের প্রশস্থতা ০.৩৭ মিটার (১ ফুট ২.৫০ ইঞ্চি) এবং প্রত্যেকটিতে আড়াআড়ি ১০ টি ছিন্দ্র আছে। মসজিদের মেহরার অর্ধবৃত্তকার এবং ঘরের সমতলে তৈরি। আলাদা কোন বিশেষ কারুকার্য এতে নেই। মেহরাবের উচ্চতা ১.৫৭ মিটার(৫ ফুট ২ ইঞ্চি), ব্যাসার্ধ ০.৬০ মিটার (২ ফুট) এবং প্রস্থ ০.৪৫ মিটার (১.৫০ ফুট)।  উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালের উপরিভাগে দুটি সেগমেন্টাল খিলান আছে এবং এগুলো এগুলোর প্রত্যেকটির দৈর্ঘ্য ১.৮০ মিটার( ৬ ফুট) ও পুরত্ব ০.৪০ মিটার( ১৬ ইঞ্চি) এবং এগুলো মূলত: গম্বুজের ওজন বহনের তৈরি করা হয়েছে। নিচের দিকে গম্বুজের ব্যাস ৭ ফুট ৪ ইঞ্চি। গম্বুজটি অর্ধ গোলাকার। সমতল থেকে গম্বুজের শীর্ষবিন্দুর উচ্চতা ৩.২৭ মিটার( ১০ ফুট ৯ ইঞ্চি)। গম্বুজটির বিস্তৃতি পুরো ছাদ জুড়ে। গম্বুজের চূড়ায় দৃষ্টিনন্দন পদ্ম ও কলস মোটিফ দেখা যায়। ঘরে মাত্র একটি প্রবেশপথ রয়েছে এবং সেটি অনেকটা অনুচ্চ । মাথা নীচু করে ঘরে প্রবেশ করতে হয়। দরজার উচ্চতা ১.৫০ মিটার(৫ ফুট )এবং ০.৬০ মিটার (২ ফুট)। মসজিদের মেঝে গ্রামবাসী বর্তমানে টাইলস বসিয়েছেন। সৌরবিদ্যুৎতের সাহায্যে ঘরে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আজান দেওয়ার জন্য মাইকের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রবেশপথে স্টিলের দরজা লাগানো হয়েছে নিরাপত্তার জন্য।  

বাংলার মুসলিম স্থাপত্যকে দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা: সুলতানি স্থাপত্য ও মুঘল স্থাপত্য। লাখনাবতী রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ১২০৪ হতে ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নির্মিত মসজিদ ও অন্যান্য ইমারতকে সুলতানি স্থাপত্য বলা যেতে পারে। ১৫৭৬ থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত স্থাপত্যকে মুঘল স্থাপত্য বলা হয়। উপাদান ও উপকরণ একই হওয়া সত্বেও নির্মাণগত কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। মুঘল স্থাপত্যেও কোণায় ছত্রী ব্যবহার করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে ছত্রীর পরিবর্তে টাওয়ার ব্যবহৃত হলেও সেগুলোর উচ্চতা ছাদের কিনারা হতে উপওে উঠে এবং সেগুলোর শিরোভাগে ফুলকুঁড়ির ন্যায় আবৃত মনে হয়। মুঘল আমলে ছাদ কিনারা অনুভুমিক (সমতল) আকার ধারণ করে। গম্বুজে দন্ডশলাকা গম্বুজ চূড়ার রৃপ ধারণ করেছে। টেরাকোটা বা পোড়ামাটির ফলকের অলঙ্করণ সাধারণভাবে পরিহার করা হয়েছে। ইমারত গাত্রে পলেস্তারা ব্যবহার করা হয়েছে এবং কার্ণিসের নিচে কিংবা ইমারতের অভ্যন্তরে গম্বুজের নিচে অন্ধ ’মারলন’ অলঙ্করণ মোটিফ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এসব বৈশিষ্ট্য বিচারে মসজিদটি যে মুঘল আমলের, তা নিশ্চিত করে বলা যায়।

এক ডিমের মসজিদ কিংবা গায়েবী মসজিদের ইতিহাস কী? কে বা কারা এটি নির্মাণ করেছিলেন? প্রাচীন এ পুরাকীর্তি সম্পর্কে আলোচনার ক্ষেত্রে এসব প্রশ্ন আসাই স্বাভাবিক এবং সেজন্য এসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য মসজিদটির অবস্থানস্থলের ইতিহাস আলোচনা জরুরী। এতে মসজিদটির প্রাচীনত্ব সম্পর্কে জানার পাশাপাশি নির্মাতাদের সম্পর্কেও জানা যাবে। স্থাপত্যশৈলীর বর্ণনা থেকে আমরা নিশ্চিত যে, মসজিদটি মুঘল আমলের। এলাকার লোকদের কেউ-ই মসজিদের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই বলতে পারেননি। স্থাপত্য কিংবা ইতিহাসের কোন বইতে এর কোন উল্ল্যেখ নেই।

আগেই বলা হয়েছে, মসজিদটির অবস্থান গোয়াইনঘাট উপজেলার পিয়াইন নদীর অনতিদূরে  কালাইউরা গ্রামে। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ অঞ্চলটি জৈন্তিয়া রাজ্যের অন্তভূর্ক্ত ছিল। অন্য কথায়, স্বাধীন জৈন্তিয়া রাজ্যের সর্বশেষ সীমার মধ্যে অঞ্চলটির অবস্থান। কিন্তু সিলেটের ইতিহাস রচয়িতাদের মধ্যে প্রায় সবার মত হচ্ছে, জৈন্তিয়া রাজ্য কখনো মুসলমানদের দ্বারা বিজিত হয়নি । তবে রাজা দ্বিতীয় বড় গোসইয়ের রাজত্বকালে(১৭৩১ থেকে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর ভাগনে এবং প্রধান সেনাপতি ফতেহ খাঁ’র পরিকল্পনা, নির্দেশনা ও প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে জৈন্তিয়া রাজ্যে ইসলামের প্রচার ঘটে। ঢাকা ও মুর্শিদাবাদের লব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে তিনি নতুন রাজবাড়ী নির্মাণ করেন। এ নির্মাণ কাজে প্রথম ইটের ব্যবহার করা হয় এবং তাঁর হাত ধরেই জৈন্তারাজ্যে প্রথম মোঘল স্থাপত্যের প্রচলন ঘটে। পরে তিনি প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে পরে মারা যান। কিন্তু তার এত স্বল্প সময়ে নিজপাটের দূরবর্তী একটি স্থানে এরকম একটি মসজিদ নির্মাণ সম্ভব নয় বলে আমাদের অনুমান।  

রাজ্য ও রাজ্যত্ব কোন স্থির বা অনঢ় ব্যাপার নয়। সময়ের সাথে রাজার যেমন পরিবর্তন হয় তেমনি রাজত্বেরও সংকোচন-প্রসারণ ঘটে। প্রাচীন জৈন্তিয়া রাজ্যের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি সত্যি । ইতিহাসের গতিপথে এ রাজ্যেরও সীমানার বিস্তৃতি ঘটেছে, আবার কখনও সংকোচন ঘটেছে। আমরা সে বিস্তৃত আলোচনায় না গিয়ে মসজিদের ইতিহাসের সাথে প্রাসঙ্গিক অংশটুকু আলোচনার প্রয়াস পাব।

গোয়াইনঘাট অঞ্চল সর্বদাই জৈন্তিয়া রাজ্যের অংশ ছিল মনে করা হয় এবং এজন্য এ অঞ্চল সম্পর্কে পৃথকভাবে আলোচনা খুব একটা দেখা যায় না। এ অঞ্চলের ইতিহাস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন মো: কলিম উল্ল্যাহ তাঁর ’ইতিহাস ঐতিহ্যে জৈন্তিয়া-গোয়াইনঘাট খন্ড’ শীর্ষক বইতে। তার মতে, এজিল মালাই ছিলেন মালাবার (শ্রীলংকা) রাজ্যের রাজা। তিনি তার তাদের রাজ্যকে সম্প্রসারিত করেন এবং নাম দেন ’উজ্জয়নী’। এ রাজবংশের অধস্তন বংশধর রাজা পুলকেশী ২য় (যিনি রাজা ভোজ নামে সমধিক পরিচিত) ৭ম শতাব্দীতে (৬১৬-৬৪২ খ্রিস্টাব্দ) চেরারাজ্য দখল করেছিলেন। রাজা ভোজের নামানুসারে উজ্জয়নীর নাম হয়েছিল ভোজপুর। আসামের সাবেক কমিশনার জে.এইচ.হাটন এ রাজ্যের নাম ’মালনিয়াং রাজ্য’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ভোজপুর বা উজ্জয়নীকে মুসলিম ইতিহাসবিদরা ’পূর্ব বিহার’ বলে চিহ্নিত করেছেন। এই পূর্ববিহার, বাংলা, উড়িষ্যা জয় করে মুসলিম শাসনাধীনে নিয়ে এসেছিলেন ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী ১২০২-১২০৬ সালে। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী’র মৃত্যুর পর বেশ ক’জন মুসলিম শাসক বিহার শাসন করছেন। দিল্লীর সুলতান আলাউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ খিলজির শাসনামলে (১২৯৬-১৩১৬) অরণ্যকুলের রাজা লন্দর দেব ১৩০৫ সালে বিহারের মুসলিম শাসকদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেন এবং পরবর্তীতে খাজনা ও কর প্রদানসহ নানা শর্তে শাসনকাজ পরিচালনা করতে থাকেন। তিনি ১৩০৬ থেকে ১৩২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ রাজ্য শাসন করেন। বর্তমান পিয়াইন নদী বিধৌত অঞ্চল তথা গোয়াইনঘাট উপজেলার পিয়াইনগোল, ধরগ্রাম ও জাফলং পরগণা অরণ্যকুলের অন্তর্ভূক্ত অঞ্চল ছিল।

১৩০৬ সালে অরণ্যকুলের রাজা লন্ডর দেব বশ্যতা স্বীকার করার কারণে এ অঞ্চলে মুসলমানদের অনুপ্রবেশের সুযোগ ঘটে এবং সিলেটের গৌড় বিজয়ী হযরত শাহজালাল (রহ.)’র শীষ্যগণ কর্তৃক এতদ্বঞ্চলে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্র তৈরি হয়। দেওয়ারগ্রামে হজরত শাহজালাল (র.)এর ৩৬০আওলিয়ার অন্যতম শিষ্য হজরত শেখ মুসা (র.) এবং রাউতগ্রামে হজরত সিকন্দর (রহ.) এর মাজার এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ। বিহারে নুহানী রাজবংশ ১৩৫৭ থেকে ১৫৯৩ সাল পর্যন্ত শাসন করেছে। পরবর্তিতে  বিহারের শাসকরা ব্রক্ষপুত্র নদের পূর্বপারে মনোনিবেশ করেন এবং উত্তরবঙ্গ, ঢাকার অর্ধাংশ, পাবনা, বগুড়া, ময়মনসিংহ, সিলেট ও ত্রিপুরার কিছু অংশ ঈশা খাঁ নুহানী ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন। এতে বিহারের উপর তাদের কর্তৃত্ব দূর্বল হয়ে পড়ে এবং দিল্লীর হাতে চলে যায় বিহারের শাসন। রাজা লন্ডবরের পর বর্তমান গোয়াইনঘাট উপজেলার অধিক্ষেত্রে বিদ্যমান পিয়াইনগোল, ধরগ্রাম এবং জাফলং পরগণা ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিহার সুবাহ’র অন্তর্ভূক্ত হয় এবং ১৬২৫ সাল পর্যন্ত পর্যন্ত সরাসরি দিল্লীর শাসনাধীনে থাকে। এ দীর্ঘ সময়ে সর্বশেষ বিহারের সুবেদার ছিলেন ইব্রাহিম খাঁ যিনি পরবর্তীতে রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হন। তার সমাধিদুর্গটি জাফলংয়ের সীমান্তরেখায় ডাউকি নদীর পশ্চিম পারে ভারত অংশে অবস্থিত ।

মোহাম্মদ আব্দুল হাই ’সিলেটের প্রত্মসম্পদ’ গ্রন্থে জাফলং রাজবাড়ী সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে প্রাচীন মালনিয়াং রাজ্য সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি Dr. Homiwell Lyngdoh , Dr. Bareh , J.N. Chowdhury, সৈয়দ মুর্তাজা আলী, মোহাম্মদ আবদুল আজিজ, রুশ পতাম , সিলেট ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার ইত্যাদির বরাত দিয়ে বলেছেন যে, এ রাজ্যটি এককালে সিলেট সদর ও শহর এলাকা, কোম্পানীগঞ্জ, সুনামগঞ্জ জেলার কিয়দংশ, জাইন্তিয়া পাহাড়ের কিয়দংশ এবং আসামের সমতলভূমি নিয়ে গঠিত ছিল। মালনিয়াং রাজত্বের সমসাময়িক খাসিয়া চিফডমগুলো হচ্ছে-পূর্বদিকে জৈন্তিয়া, মধ্য অঞ্চলে Mawroh Marpri এবং পশ্চিমদিকে Inog Syiem। এ রাজ্যের রাজারা তাদের রাজ্যকে কামরুপের বেলতলা, মালাগুল (মুলাগুল যা বর্তমানে সিলেটের কানাইঘাটে অবস্থিত) এবং সুরমা উপত্যকার সিলেট পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন । মালনিয়াং রাজ্যটি উত্তর দিকে আসামের নওগা জেলার দিমারুয়া থেকে খাসি-জৈন্তিয়া পার্বত্য অঞ্চল হয়ে দক্ষিণ দিকে সিলেটের গোয়াইঘাট পর্যন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। রাজ্যটির রাজধানী ছিল সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ের বল্লাপুঞ্জি। সেখানে এখনও রাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। Dr.Bareh’র সাথে একমত পোষণ করে তিনিও মতপ্রকাশ করেন যে,  মাইলং রাজা ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ রাজ্য শাসন করেছেন। এরপরও এটি আধা-স্বাধীন আশ্রিত রাজ্য হিসেবে কোন রকম অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল। সর্বশেষ রাজ্যটি ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দে জৈন্তিয়া রাজা যশোমন্ত (যদিও অনেকে রাজা বিজয় সিংহের সময় বলে থাকেন) রায়ের হাতে সম্পূর্ণ অস্তিত্ব হারিয়ে জৈন্তিয়া রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয় এবং ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত জৈন্তিয়া রাজ্যের শাসনে ছিল।

সুতরাং স্থাপত্যশৈলীর বিচারে মসজিদটি মুঘল আমলের বলে আমরা নিশ্চিত অর্থাৎ ১৫৭৬ থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত কোন এক সময়ে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। অপরদিকে গোয়াইনঘাট ও মালনিয়াং রাজ্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মসজিদ সংলগ্ন পুরো এলাকাটি বিহার সুবাহ’র অন্তর্ভূক্ত ছিল। এ সময় বিহারের সুবেদার ছিলেন ইব্রাহিম খাঁ যার মাজারটি মসজিদ হতে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত । মসজিদটি ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৬২৫ খ্রিস্টাব্দের কোন এক সময়ে নির্মিত হয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস। আরও সুনির্দিষ্টভাবে ইব্রাহিম খাঁ সুবেদার থাকা অবস্থায় সম্ভবত: মসজিদটি নির্মাণ করা হয়ে থাকতে পারে কারণ এরকম ব্যয়বহুল একটি মসজিদ সাধারণ মানুষের দ্বারা নির্মাণ করা সম্ভব নয়। ইব্রাহিম খাঁ হত্যাকান্ডের শিকার হন ১৬২৫ খ্রিস্টাব্দে এবং এর বছর পাঁচেক আগে ১৬২০ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি নির্মিত হয়েছে বলে আমাদের অনুমান। সার্বিক বিচারে মসজিদটি প্রায় ৪০০ বছর পুরনো বলে ধরে নেওয়া যায়।

পৃথিবীর অন্যতম ক্ষুদ্রতম মসজিদের সাথে এ মসজিদের তুলনামূলক আলোচনা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। প্রথমেই বাংলাদেশের বগুড়ার আদমদিঘী উপজেলার সান্তাহার পৌরসভার তারাপুর মসজিদ সম্পর্কে আলোকপাত করবো। অনেকের দাবি, এটি পৃথিবীর ক্ষ্রদ্রতম মসজিদ। এ মসজিদের উচ্চতা ১৫ ফুট, দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে মসজিদটি ৪.৫৭ মিটার (১৫ ফুট) এবং দেয়ালের পুরুত্ব দেড় ফুট। মসজিদের প্রবেশ দরজার উচ্চতা ৪ ফুট এবং চওড়া মাত্র দেড় ফুট। অনুমান করা হয় যে, এখানে একসাথে মাত্র ৩ জন মুসল্লি নামাজ পড়তে পারতেন। বর্তমানে এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে এবং নামাজ পড়ার উপযোগী অবস্থায় নেই। ভারতের হায়দারাবাদের কিসান বাগের ’জীন মসজিদ’ কে অনেকে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম মসজিদ বলে দাবি করেন। সে মসজিদটি প্রায় ৪০০ বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। মসজিদটি হজরত সৈয়দ শাহ ইমাদ উদ্দিন মোহাম্মদ আল-হোসাইনি যিনি মীর মাহমুদ কি পাহাদি’র দরগাহে পাহাড়ের উপর অবস্থিত। মসজিদটি বর্গাকৃতি এবং ভেতরে আয়তন ১০ বর্গমিটার । এটি ভারতের ভূপালের ক্ষুদ্রতম মসজিদের চেয়ে ছোট যেটিকে বর্তমানে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম মসজিদ বলে অভিহিত করা হয়। বর্তমানে এটিকে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম মসজিদের স্বীকৃতির জন্য প্রচারাভিযান চালানো হচ্ছে। বগুড়ার তারাপুর মসজিদের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ১৫ ফুট, ভারতের হায়দারাবাদের ’জীন মসজিদ’র ১০০ বর্গমিটার । গোয়াইনঘাটের ’এক ডিমের মসজিদের দৈর্ঘ্য ৩.০৯ মিটার(১০ ফুট ২ ইঞ্চি) এবং প্রস্থ ২.০৮ মিটার(৬ ফুট ১০ ইঞ্চি)। অর্থাৎ পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম মসজিদ বলে কথিত মসজিদগুলোর চেয়েও আমাদের আলোচ্য এক ডিমের মসজিদের চেয়েও অনেক ছোট। তাছাড়া সেসব মসজিদগুলো ধ্বংস হয়ে পরিত্যক্ত হয়ে আছে। সুতরাং পৃথিবীর মধ্যে প্রায় ৪০০ বছর পুরনো যেটিতে বর্তমানেও নামাজ পড়া হয়, সে মসজিদটি হচ্ছে 'এক ডিমের মসজিদ’।    

আব্দুল হাই আল-হাদী: প্রধান সমন্বয়কারী, সেভ দ্য হেরিটেজ এন্ড এনভায়রনমেন্ট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত