সঞ্জয় সরকার

১৩ এপ্রিল, ২০১৯ ২০:২৯

বাংলা সন বিভ্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ!

বাংলা সন ও পহেলা বৈশাখ নিয়ে রয়েছে মতানৈক্য। এই মতানৈক্যের সৃষ্টি এরশাদ সরকার কর্তৃক ১৯৮৮ সালে সরকারি অফিস ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা তারিখের প্রচলনের সময় থেকে। ভারতীয় তথা হিন্দু পঞ্জিকার সাথে পার্থক্য রাখতে এরশাদ সরকার ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ কর্তৃক প্রস্তাবিত বাংলা সনকে সরকারি সন হিসেবে ব্যবহারের নির্দেশ দেন। সাম্প্রদায়িকতার চর্চা এরশাদ সরকারের একটা বড়ো অস্ত্র ছিল।

পঞ্জিকা সংস্কারের কথা:
মূলত ভারত স্বাধীন হবার পর ১৯৫২ সালে বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাকে প্রধান করে পঞ্জিকা সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু তাঁর সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। অন্যদিকে বাংলা পঞ্জিকা, বাংলা ভাষা নিয়ে হিন্দুয়ানীর ধোয়া উঠলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার পঞ্জিকা সংস্কারের প্রস্তাব গ্রহণ করে। এজন্য ১৯৬৬ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে প্রধান করে বাংলা পঞ্জিকা সংস্কারের কিছু প্রস্তাব আনা হয়।

তিনি যে প্রস্তাবগুলো দেন সেগুলো হলো-

১। বছরের প্রথম ৫মাস (বৈশাখ-ভাদ্র) হবে ৩১ দিন।
২। পরের সাতমা (আশ্বিন-চৈত্র) হবে ৩০ দিন।
৩। প্রতি ৪বছর পর ফাল্গুন মাসে অতিরিক্ত ১দিন যোগ করে বাংলায় লিপিয়ারের মাধ্যমে দিনের সামঞ্জস্য আনতে হবে।
৪। ১লা বৈশাখ হবে সবসময় ১৪ এপ্রিল।

এটা থেকে বোঝা যায় যে বাংলা পঞ্জিকা পুরোপুরি গ্রেগরীয় (ইংরেজি) পঞ্জিকা নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

বাংলা সন প্রচলন নিয়ে মতবাদ:
বাংলা সন প্রচলন নিয়ে যে দুটি মতবাদ প্রচলিত আছে, তা হলো:

১। প্রাচীন গৌড়ের (বাংলা) রাজা শশাঙ্ক (শাসনকাল ৫৯০-৬২৫) বঙ্গাব্দ চালু করেন। সপ্তম শতাব্দীর দিকে তিনি রাজচক্রবর্তী ছিলেন। গ্রেগরীয়(প্রচলিত ইংরেজি) বর্ষপঞ্জির ৫৯৪ সালে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়।

২। ভারতে মুঘল শাসনামলে হিজরি পঞ্জিকা অনুযায়ী কাজকর্ম পরিচালিত হত। যেহেতু হিজরি পঞ্জিকা চাঁদের আবর্তনের ওপর নির্ভরশীল তাই প্রত্যেক বছর সৌর বৎসর থেকে হিজরি পঞ্জিকায় প্রায় ১১দিন কমে যায়। যার ফলে চাষাবাদ ও ঋতু গণনায় বিভ্রান্তি তৈরি হয়। এজন্য সম্রাট আকবর ফতুল্লাহ শিরাজী নামক জ্যোতির্বিদকে দিয়ে হিজরি সালের সাথে সৌর বৎসরের সামঞ্জস্য করে বাংলা সাল প্রচলন করেন।

৯৯২ হিজরি ও ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে আকবর এই বর্ষপঞ্জির প্রবর্তন করলেও প্রায় ঊনত্রিশ বছর পিছিয়ে তিনি তার সিংহাসনে আরোহনের সময় থেকে এই ফসলী সন প্রবর্তনের নির্দেশ দেন। যেহেতু এটি কৃষিনির্ভর তাই একে ফসলী সনও বলা হয়।

সম্রাট আকবরের বহুপূর্বের অনেক পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে (আসাম..) যাতে বাংলা সনের উল্লেখ আছে, যা প্রমাণ করে আকবরের পূর্বেও বাংলা সন প্রচলিত ছিল।

পঞ্জিকা ও হিন্দু ভারতীয় পঞ্জিকা এবং ১লা বৈশাখ বিভ্রাট:
পঞ্জিকা মূলত তিনটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে গণনা করা হয়-

১। সৌর: সূর্যের গতির উপর
২। চন্দ্রঃ চাঁদের গতির উপর
৩। সৌর-চান্দ্রঃ সূর্য ও চাঁদ উভয়ের গতির উপর

ভারতীয় পঞ্জিকা মূলত সূর্য নির্ভর কিন্তু চাঁদ ও সূর্য দুটিকে সমন্বিত করা হয়েছে এখানে। কিন্তু সূর্য মুখ্য বলে এ পঞ্জিকাগুলো মূলত সৌর পঞ্জিকা নামে পরিচিত। গ্রেগরীয় পঞ্জিকানুসারে রাত ১২টার পর দিনের পরিবর্তন হয় আর ভারতীয় হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে দিনের পরিবর্তন হয়।

গ্রেগরীয় পঞ্জিকা মতে বছর ৩৬৫ দিনে হিসেব করা হয়। যেহেতু চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে ২৯.৫৩ দিন সময় নেয় তাই চান্দ্র মাসের সময় পূর্ণ ৩০ দিন নয়। আর হিজরি চান্দ্র পঞ্জিকা হওয়ায় একবছর সমান (২৯.৫৩*১২ = ৩৫৪.৩৬) দিন যা সৌর পঞ্জিকা থেকে প্রায় ১১ দিন কম। অন্যদিকে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবী পুরোপুরি ৩৬৫ দিন নেয় না, নেয় ৩৬৫.২৫ দিন। তাই গ্রেগরীয় পঞ্জিকার মাসগুলোকে ৩০ ও ৩১ দিনে ভাগ করা হয়েছে ফেব্রুয়ারি ছাড়া। যেমন ২০১৫ সালে সাতটি মাস ৩১ দিনে (৩১*৭ = ২১৭) ও ৪টি মাস ৩০ দিনে (৩০*৪ = ১২০) আর ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনে সব মিলে হলো-৩৬৫ দিন। কিন্তু প্রতিবছরের ০.২৫ দিনকে সামঞ্জস্য করতে পতি ৪ বছর পর ফেব্রুয়ারি মাসে ০.২৫*৪ = ১ দিন যোগ করা হয়। যা লিপিয়ার নামে পরিচিত। মূলত ৩৬৫.২৫ দিনকে মেলাতে এই কাজটি করা হয়। কিন্তু এই একদিনের ক্ষুদ্র ০.২৫ অংশ প্রত্যেক ৪ বছরেই থেকে যায়। ফলে ৪ বছরে একটি দিন মূলত প্রত্যেক বছরের হাতে থাকা ০.২৫ সময়ের সমষ্টি। যা কোন একটি বছরের অতিরিক্ত অবৈজ্ঞানিক একটি দিনের জন্ম দেয়।

অন্যদিকে ভারতীয় হিন্দুপঞ্জিকা সঠিক দিনগণনা, ধর্মীয় ও সৌরজগতের নক্ষত্রের সঠিক সময় নির্ধারণ করে। চাঁদের প্রদক্ষিণ পথে আছে ২৮টি নক্ষত্র। একদিনের মতো সময়ে একটি নক্ষত্রের ব্যাসার্ধ অতিক্রম করে চাঁদ। সবগুলো নক্ষত্র পরিভ্রমণ করতে চাঁদের ২৭.৩২ দিন সময় লাগে। ভারতীয় হিন্দু পঞ্জিকা মতে এটি একটি চান্দ্র মাস। গণনার সুবিধার প্রত্যেকটি নক্ষত্রকে চারভাগে ভাগ করে নাম দেয়া হয়েছে পদ। ৫৫০ খ্রিস্টাব্দে বরাহমিহির ‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা’ গ্রন্থ রচনা করেন। পাঁচটি খণ্ডের এই গ্রন্থের ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ নামক অংশে দিন, মাস, বৎসর গণনার পদ্ধতি লিপিবদ্ধ আছে। পরে বছর গণনার উপর জ্যোতির্বিজ্ঞানী ব্রহ্মগুপ্ত (জন্ম.৫৯৮) ‘ব্রহ্মস্ফূট’ নামক সিদ্ধান্ত রচনা করেন। জনপ্রিয়তার কারণে ‘সিন্দহিন্দ’ নাম দিয়ে এটি আরবি ভাষায় অনূদিত হয়।

হিন্দু জোতির্বিজ্ঞানীগণ সৌর পঞ্জিকায় সূর্যের অবস্থান নির্ণয় করতে আকাশের অন্যান্য নক্ষত্রের অবস্থান বিচার করতেন। ১২টি রাশিচক্র (মেষ, বৃষ, … মীন) ও ৯টি অবস্থানের (রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু ও কেতু) কথা জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলেছেন। এই বিচারে সূর্য যখন একরাশি চক্র থেকে অন্যরাশি চক্রে প্রবেশ করে তখন তাকে সংক্রান্তি বলে। বারটি রাশিতে মূলত ১২টি সংক্রান্তি সময় রয়েছে। যেদিন সূর্য রাত ১২টার মধ্যে ০ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশে প্রবেশ করে তার পরদিন হবে মাসের প্রথম দিন। যেহেতু সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবীর ৩৬৫.২৫ দিন সময় লাগে আর পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে চাঁদের ২৭.৩২ দিন সময় লাগে তাই মাস ও বছরের হিসেব ঠিক রাখতে মাসগুলোতে সূর্য ঠিক কোন সময়ে ০ ডিগ্রি অতিক্রম করছে তার ওপর ভিত্তি করে মাসের দিন ২৯/৩০/৩১/৩২ নির্ধারণ করা হয়। একারণে হিজরি সনের রমজান মাস যেমন একেক সময় একেক ঋতুতে হয়ে থাকে বাংলা সনের ক্ষেত্রে তেমনটা হওয়া কখনই সম্ভব নয়। এই সূক্ষ্ম হিসেবের কারণে বাংলা সনে আর লিপিয়ারের সমন্বয় করতে হয় না। চান্দ্র বছর ও সৌর বছরকে সমন্বয় করার জন্য বাংলা সনে একটি অধিমাস যুক্ত হয় প্রতি তিনবছর পরপর, যাকে মলমাস বলা হয়।

এই গণনার ফলে আজ থেকে ৫০ বছর পর কোনো বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিন, দুর্গাপূজা, চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ বা ঈদ কোন দিনে হবে বলে দেয়া সম্ভব। একারণে বাংলাদেশে ১লা বৈশাখ ১৪ এপ্রিল নির্ধারিত হলেও ভারতীয় হিন্দু পঞ্জিকানুযায়ী তা সর্বদা ১৪ এপ্রিল নয়, তা মূলত সংক্রান্তি সময়ের উপর নির্ভরশীল তা হতে পারে ১৪/১৫ এপ্রিল।

একই সনের দুইটি নববর্ষ থাকা প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়। যা হোক শিল্পী, কলাকুশলীরা দুইবাংলায় নববর্ষে যোগ দিতে পারেন, রবীন্দ্র জয়ন্তীতে উভয় বাংলায় উপস্থিত থাকতে পারেন, এটা তো বড়ো সৌভাগ্যের বিষয়!!!

  • লেখক: সঞ্জয় সরকার, প্রভাষক বাংলা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত