তানভীর রেজা খাঁন

২৩ মে, ২০১৯ ২২:১০

হাওর বন্ধু থেকে জননেতা

“মানব মুক্তির অভিযাত্রায় এক আদর্শ পুরুষ হিসেবে সুনামগঞ্জের জনজীবনের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে গেছেন আলফাত উদ্দিন আহমদ।” বরুণ রায়ের এ উদ্ধৃতির মাধ্যমে সুনামগঞ্জের একজন সিংহ পুরুষের ইতিহাস আলোচনা করতে চাই।

আজ তাঁর চব্বিশতম মৃত্যুবার্ষিকী। যার মৃত্যুবার্ষিকীতে নেই রাজনীতিবিদদের কোন ঝলকানো আয়োজন, নেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি আপলোড দেবার সিরিয়াল।

প্রচলিত প্রভাব-প্রতিপত্তির রাজনীতির রেষারেষিতে আলোচনার টেবিলে যাদের ইতিহাস আমরা ভুলে যাচ্ছি, যাদের ত্যাগের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আমাদের ঝুলিতে থাকা স্বত্বেও ক্ষমতার রাজনীতির মারপ্যাঁচে বিলীন হতে বসে তাদের বিসর্জন এমন একজন মানুষই হচ্ছেন হাওরপাড়ের জননেতা আলফাত উদ্দিন আহমদ। লোকে যাকে মোক্তার সাব হিসেবে চিনেন।

সুনামগঞ্জ জেলার, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার শিমুলবাঁক ইউনিয়নের মুক্তাখাই গ্রামে ১৯৩১ সালের ২১ জুন জন্মগ্রহণ করেন ভাটি বাংলার বঞ্চিত মানুষদের প্রতিনিধি আলফাত উদ্দিন আহমদ। আব্দুস সামাদ ও জমিলা খাতুন তখনও জানেন না তাদের ছোট্ট ছেলেই একসময় ভাটির নিপীড়িত জনতার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হবেন।

১৯৪০ সালে গোবিন্দপুর এম.ই মাদ্রাসায় শিক্ষা জীবন শুরুর পর বুলচান্দ উচ্চবিদ্যালয়ে, সরকারি জুবিলী উচ্চবিদ্যালয়ে এবং সুনামগঞ্জ কলেজে অধ্যয়ন করেন তিনি। ১৯৪৮ সালে মেট্রিক, ১৯৫০ সালে আই.এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন ক্ষণজন্মা এ মানুষটি।

রাজনৈতিক জীবনের সূচনালগ্নে ১৯৪৬-১৯৪৮ সালে মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কর্মী হিসাবে পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন তিনি। মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকারে দেশ যখন সোচ্চার তখন নিজের দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যের জায়গা থেকে সারাদেশের মতোই সুনামগঞ্জে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন আলফাত উদ্দিন আহমদ।

ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী আলফাত উদ্দিন আহমদ ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল 'গণতন্ত্রী দল' এ যোগদান করেন। রাজনৈতিক প্রজ্ঞার মাধ্যমে সে বছরই দলের সুনামগঞ্জ মহকুমার আহ্বায়ক নির্বাচিত হন।

পাকিস্তানি শাসকদের বুর্জোয়া নীতির বিরুদ্ধে তৎকালীন সময়ে আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন হাওরের এ জননেতা।

১৯৫৭ সালে খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেবার মাধ্যমে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তিনি জোরালো ভূমিকা পালন করেন।

১৯৫৮ সালে তৎকালীন সংবিধানের ৯২-ক ধারা অনুযায়ী পূর্ব বাংলায় কেন্দ্রীয় শাসন জারি করে  যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভার মন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ প্রায় ১৬শ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে আইয়ুব বাহিনী। তৎকালীন সময়ে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তৎপর থাকায় কারাবন্দী হন জননেতা আলফাত উদ্দিন আহমদ। পরিবার পরিজনহীন জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠেই চলতে থাকে জননেতা আলফাত উদ্দিন আহমদের জীবন।

শিক্ষা, উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, রাষ্ট্রীয় অধিকার, গণতান্ত্রিক ও সামাজিক অধিকার সহ সকল ক্ষেত্রেই একে একে বঞ্চিত হতে থাকে পূর্ব পাকিস্তান। অত্যাচার নিপীড়নের মাত্রা তুঙ্গে উঠায় শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৬৯ এর গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে। জননেতা আলফাত উদ্দিন আহমদ সুনামগঞ্জের আপামর জনতাকে সাথে নিয়ে এ গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার অপরাধে দ্বিতীয় বারের মতো কারাবরণ করেন তিনি।

১৯৭০ এর নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী দেওয়ান ওবায়দুর রাজা চৌধুরীকে সমর্থন দেন এবং তার পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর সারা দেশের ন্যায় সুনামগঞ্জেও স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হলে আলফাত উদ্দিন আহমদ সদস্য সচিব নির্বাচিত হন।

২৫ শে মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণের পর সংগ্রাম কমিটির অনেকে শহর ছেড়ে নিরাপত্তার কারণে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিলেও সুনামগঞ্জে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন হোসেন বখত এবং আলফাত উদ্দিন আহমদ।

পাকসেনাদের অত্যাচারে ভারত সীমান্তে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে থাকা হাজার হাজার শরণার্থীদের তিনি লঙ্গরখানা খুলে স্বাধীনতার পক্ষের স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় একবেলা খাবার ব্যবস্থা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং এ পাঠানো, শরণার্থীদের মধ্যে রিলিফ বিতরণ, চিকিৎসা সেবা, শরণার্থীদের মৃতদেহ সৎকার এবং সর্বশেষ স্বাধীন সুনামগঞ্জের শরণার্থীদের ঘরে ফেরত পাঠানোর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে পালিত দায়িত্বের অবসান ঘটে তার।

যুদ্ধের পর হাওর পাড়ের মানুষের অন্ন রক্ষায় মোক্তার সাব ছুটে গিয়েছেন হাওরবাসীর দুয়ারে। ১৯৭৩ সালে তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী প্রয়াত আব্দুস সামাদ আজাদ নির্মিত পাণ্ডার খাল বাঁধ নির্মাণে মোক্তার সাবের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পেশাগত দায়িত্ব ছেড়ে তিন মাস পাণ্ডার খালের পাশে অবস্থান করে সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে হাওরবাসীর মনে জায়গা করে নেন তিনি।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ঘাতকগোষ্ঠী যখন মার্শাল-ল জারি করে প্রতিবাদী কণ্ঠগুলোকে থমকে দিতে চায় তখন প্রতিবাদ করেন জননেতা আলফাত উদ্দিন আহমদ। প্রতিবাদের প্রতিদান হিসেবে জোটে জীবনে তৃতীয় বারের মতো কারাবরণ। বদ্ধ হয়ে যায় একটি বলিষ্ঠ কণ্ঠ।

মামলা-হামলা, জেল-ঝুলুমের পরও থেমে থাকেননি তিনি। জনগণের জন্য রাজনীতি করে আসা আলফাত উদ্দিন আহমদ শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগ দেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার পরিচয়ে ১৯৮৫ সালে সুনামগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন এবং মৃত্যু পূর্ব পর্যন্ত এ পদে আসীন থাকেন।

স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার যখন সমানে রাজস্ব আদায়ের নাম করে দেশের সব হাওর-জলাভূমি ইজারা দিতে থাকে তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায়ই 'ভাসান পানি আন্দোলন' এ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এ হাওরবন্ধু। নিপীড়িত খেটে খাওয়া জেলেদের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে স্বৈরশাসকের রোষানলে পড়ে চতুর্থ বারের মত কারাবাস উপহার পান জননেতা আলফাত উদ্দিন আহমদ।

তিনি গরীব দিনমজুর রিকশাচালকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায়ও সংগঠিত হয়েছিলেন জননেতা আলফাত উদ্দিন আহমদ। যাদের কাছে তার বিন্দুমাত্রও কোন স্বার্থ ছিল না। যারা সরাসরি শরীরের ঘাম বিক্রির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে, যাদেরকে আমরা প্রতিনিয়তই অবজ্ঞা করি, সমাজের নিচুস্তরের মানুষ হিসেবে কল্পনা করতেই বেশী অভ্যস্ত তাদেরকেই তিনি বুকে টেনে নিয়েছিলেন। সুনামগঞ্জের দিনমজুর রিকশাচালকদের নিয়ে তিনি রিক্সা শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়া মহাপুরুষটি ২৩ মে ১৯৯৫ সালে মাত্র ৬৪ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন।

একজন রাজনীতি সচেতন মানুষ হিসেবে প্রশ্ন জাগে, মোক্তার সাবের মতো সেলফিহীন রাজনৈতিক যুগের ঘাম ঝরানো আলেকজান্ডারদের সঠিক মূল্যায়ন কি আমাদের যুগের প্রজন্ম করছে?

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী লাল-সবুজ বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবেও কৌতূহল জাগে, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, পরিবার-পরিজনের মায়া ত্যাগ করে শুধুমাত্র স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখা মানুষটির ত্যাগের ইতিহাস কি আমরা পৌঁছে দিতে পারবো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে?

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোর তরুণের প্রশ্ন, নিপীড়িত জনতার অধিকার আদায়ের জন্য বারবার জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দিনাতিপাত করা মোক্তার সাবের স্বপ্নের বাস্তবায়ন কি বর্তমান প্রজন্ম করবে?

এই চাটুকারিতাময় রাজনৈতিক যুগে হয়তো আলফাত উদ্দিন আহমদকে নিয়ে হাজার হাজার মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভর্তি করবে না! হয়তো সারি সারি লাইন ধরে উনার কবরে ফুলের ঢালি সাজাবে না! কিন্তু, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর আমরা কি আমাদের মূল ইতিহাস এড়িয়ে যাচ্ছি? সেলফি এবং তোষামোদির রাজনীতির ভিড়ে আমরা কি এককালের রাজপথের প্রমিথিউসদের ভুলতে বসেছি?

যদি আমরা এ পথেই হাঁটি তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ খুব বেশী সুখকর নয়। কারণ নিজের ইতিহাস ভুলে হয়তো সাময়িক রাজনৈতিক বলয় সৃষ্টি করা যায় কিন্তু একজন আদর্শিক কর্মী তৈরি করা যায় না। আলফাত উদ্দিন আহমদের মতো মানুষদের করে যাওয়া রাজনীতি বর্তমান যুগের অনেক রাজনীতিবিদদের শতবর্ষ রাজনীতির চেয়েও ক্ষুদ্র। কারণ, তাদের ত্যাগ দেশের জন্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত।

তাদের ত্যাগ স্বার্থহীন নিপীড়িত মানুষের অধিকারের জন্য। তাদের ত্যাগ মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্য প্রতিষ্ঠার। এরকম পরোপকারী, চরিত্রে ক্লেদহীন, সম্মোহনী শক্তির রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে এযুগের রাজনীতিবিদদের অনেক কিছু শেখার আছে।

পরিশেষে আলফাত উদ্দিন আহমদকে নিয়ে সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের একটি বক্তব্য দিয়ে শেষ করতে চাই। তিনি বলেন, “আমি প্রতিকূল উজান বেয়ে বড় হয়েছি, রাজনৈতিক ভাবে এতবড় হওয়ার পিছনে তাঁর অবদান রয়েছে। আমরা তাঁর স্নেহধন্য ছিলাম। শাসকগোষ্ঠী মজুতদার সুদখোর-ঘুষখোরদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। প্রতিটি আন্দোলনে –সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তিনি।”

জননেতা আলফাত উদ্দিন আহমদের চব্বিশতম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই অফুরন্ত শ্রদ্ধা। সৃষ্টিকর্তা উনাকে উত্তম প্রতিদান দিন।

লেখক, তানভীর রেজা খাঁন, সমাজকর্মী, বিতার্কিক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত