সুশান্ত দাস প্রশান্ত

৩১ অক্টোবর, ২০১৯ ২০:১৭

পেশায় শ্রদ্ধাশীল ও রাজনীতি সচেতন একজন ধীরেশ সরকার

যিনি গুরু গাম্ভীর্যের বাহিরে একটু ভিন্ন ধাঁচের অসাধারণ একজন শিক্ষক ও মহান মানবাত্মার অধিকারী একজন 'মানুষ' তাঁর প্রতিটি ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীর নিকট তিনি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় কিংবদন্তিতুল্য তিনি হচ্ছেন সিলেট এমসি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ধীরেশ স্যার।

তাঁর জন্ম নেত্রকোনা জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল হাওরবেষ্টিত কৃষিঅঞ্চল খালিয়াজুড়ী উপজেলার সাতগাঁও গ্রামে। পিতা শিক্ষানুরাগী ধীরেন্দ্র চন্দ্র সরকার। ছিলেন নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক। মাতা ছিলেন এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের আরেকটি পার্শ্ববর্তী উপজেলা শাল্লার সুখলাইন গ্রামের ঐতিহ্যবাহী ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান সুখময়ী রানী সরকার। পিতা ধীরেন্দ্র ও মাতা সুখময়ী সরকারের এক মেয়ে এবং দুই পুত্রের মধ্যে উনি ছিলেন বড়। ধীরেন্দ্র বাবু শিক্ষকতার পাশাপাশি অনেক সময় জমিতে কাজ করতে গিয়ে জমির আইলে ছেলে ধীরেশ সরকারকে বসিয়ে পড়াতেন, বোঝাতেন।

মূলত ধীরেন্দ্র বাবু শিক্ষক ও শিক্ষানুরাগী এবং মাতা সুখময়ী রানীর শাল্লার ধনাঢ্য পরিবারের ভাইয়েরা (ব্রিটিশ আমল এমবিবিএস ডাক্তার) উচ্চ শিক্ষিত হওয়ায় তাদের অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন আজকের প্রয়াত প্রফেসর ছোটবেলার দেবল। পারিবারিক আত্মীয় স্বজনদের কাছে দেবল হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

ব্যক্তিজীবনে ছিলেন হাস্যজ্জোল চেহারার, প্রতিভাবান, প্রগতিশীল, কঠোর পরিশ্রমী, নিয়মিত ব্যায়ামকারী, আন্তরিক পরিপূর্ণ, সৎ, নিষ্ঠাবান, পরোপকারী, কর্তব্যনিষ্ঠ, মা-বাবার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধাভাজন ও অভিমান ব্যক্তিত্বের অধিকারী। আজ প্রতিটা গুণের ব্যাখ্যা না করলেও মা-বাবার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধাভাজন কথাটি ব্যাখ্যা না করে পারছিনা। উনার বাবা অবসরে যাওয়ার পর মা-বাবা সহ সমস্ত ফ্যামিলিকে সিলেটে ধোঁপাদিঘীর ভাড়া বাসাতে নিয়ে আসেন। এতো কর্মময় ব্যস্ততার মাঝে ফাঁকিবুকিবিহীন টাইমমাফিক কলেজের ক্লাস, সকাল-সন্ধ্যা বাসায় ব্যাচ করে ছাত্র পড়ানো পড়িয়ে নিজ হাতে চালিয়ে যেতেন মা-বাবাকে সেবা করা। ঘরে কাজের লোক এমনকি নিজ সহধর্মিণী থাকা সত্ত্বেও স্বাচ্ছন্দ্যে নিজ হাতে কাজ করে দিতেন তাঁদের।

এ প্রসঙ্গে শ্রী শ্রী অনুকূল ঠাকুরের একটি উক্তি প্রাসঙ্গিক। যেমন- ‘বিদ্যাসাগর, স্যার আশুতোষ/ কোথায় পেলেন শক্তি?/ দেখ না চেয়ে তার পিছনে/ আছেই মাতৃভক্তি।’

আরও বলেছেন, ‘মাতৃভক্তি অটুট যত/ সেই ছেলে হয় কৃতি তত।’
‘পিতায় শ্রদ্ধা মায়ে টান/ সেই ছেলে হয় সাম্যপ্রাণ।’

তাই মা-বাবার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধাতে তিনি তাঁর পাশের জানা মানুষ ও আত্মীয় স্বজনদের কাছে শ্রদ্ধাস্পদ উদাহরণযোগ্য। অভিমান করে দীর্ঘ ৩৭ বছর মামাবাড়িতে যাননি। এইবার মৃত্যুর আগে ঘটে যাওয়া দুর্গাপূজাতে মামার বাড়িতে শত বছরের পূর্ণতা উপলক্ষে গিয়েছিলেন। এই যাওয়া হয় তাঁর মামার বাড়িতে শেষ যাওয়া। এখন আর মামারাও নেই, অভিমানও নেই আজ নিজেই অভিমানী সেজে মামাদের সাথে ঊর্ধ্বলোকে স্থান করে নিলেন।

তিনি নিজ গ্রাম সাতগাঁও থেকে প্রাথমিক ও মোহনগঞ্জ থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষার পাসে মেধার সাক্ষর রেখে গণিত বিষয়ে স্নাতক সম্মান ও সম্মানোত্তর চুকিয়ে তাঁর বাবার পেশাকে সম্মান দেখিয়ে সরাসরি ঢুকে পড়েন সিলেটের এই প্রাচীন বিদ্যাপীঠে। বেছে নিলেন শিক্ষকতা নামের এই মহান পেশাকে।

শিক্ষকতা এমন একটি মহান পেশা যার সঙ্গে সমগ্র দেশ ও জাতির মঙ্গল ও অমঙ্গল যুক্ত। আর এ জন্যই এ পেশায় সবাই দেখতে চান কিছু বিদ্যানুরাগী ভালো মানুষ যারা কেবল অসাধারণ মেধার অধিকারীই নন, শিক্ষকতা পেশার প্রতি নিবেদিত প্রাণও বটে। আর শিক্ষকতা পেশায় এ ধরনের মহৎ প্রাণ ব্যক্তিদের আগমন ও অবস্থান নিরাপদ ও সম্মানজনক। আমরা যদি উপযুক্ত নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে ও প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাই, তা হলে আমাদের নির্দ্বিধায় এমন আস্থা সৃষ্টি করা দরকার, যেখানে শিক্ষকতা কেবল একটি মহান পেশাই নয়, নিরাপদ জীবন-জীবিকার উপায়ও বটে।

শিক্ষকদের মধ্যে অবশ্যই প্রতিযোগিতা থাকবে, আর সেটি হবে জ্ঞানকেন্দ্রিক; কী করে শিক্ষা কার্যক্রমকে আরও মানসম্মত ও কার্যকর করা যায়। প্রকৃত শিক্ষার লক্ষ্য কেবল জ্ঞান আহরণ ও বিতরণই নয়, একই সঙ্গে সত্যানুসন্ধান, সত্যার্জন তথা মহৎ মানবোচিত জীবনও বটে। শিক্ষাবিদরা যখনই এ আদর্শ থেকে বিচ্যুত হন, তখনই হুমকির সম্মুখীন হয় শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ। তখন ক্রমে ক্রমে পণ্ড হতে থাকে শিক্ষার নৈতিক ও মানবিক লক্ষ্য।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অবাধ ও নিরপেক্ষ অনুসন্ধান ব্যতিরেকে কখনো সত্য অর্জন করা যায় না। আর তা নয় বলেই শিক্ষকদের চাই মত প্রকাশের প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়া চাই বাহিরের অযাচিত হস্তক্ষেপ মুক্ত। স্বাধীন অনুসন্ধানের ফলে কোনও প্রচলিত বিশ্বাস, ধারণা বা মতবাদ ভ্রান্ত ও ক্ষতিকর প্রমাণিত হতে পারে, এ আশঙ্কায় যদি দেশের সরকার স্বাধীন মত প্রকাশে কোনা রকম বাধা সৃষ্টি করে, শিক্ষা তার স্বাভাবিক গতিপথ হারিয়ে ফেলে এবং ব্যাপক মানবকল্যাণ প্রতিষ্ঠার উপায় হিসেবে শিক্ষার শক্তিও তাতে বিনষ্ট হয়।

বিজ্ঞানী গালিলিও (১৫৬৪-১৬৪২) যখন তাঁর জ্যোতির্বিদ্যার বিখ্যাত মতবাদটি ঘোষণা করেন, তখন তাঁকে ঐশ্বরিক সত্য ও ঈশ্বরের বিধান বিরোধী মত প্রচারের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। প্রত্যুত্তরে গালিলিও তাঁর বিচারকদের বলেছিলেন, ‘একজন বিজ্ঞানী হিসেবে আমার সামনে ঐশ্বরিক সত্যের বিরুদ্ধাচরণ না করার একটিমাত্র পথই খোলা আছে, আমার আবিষ্কৃত সত্যকে প্রকৃত সত্য হিসেবে হাজির করা’। পরবর্তী প্রজন্মের তথা ইতিহাসের রায় গালিলিও’র পক্ষে গিয়েছে। গালিলিও’র এ সাহসী পদক্ষেপ স্বাধীন জ্ঞানানুশীলন ও সত্যানুসন্ধানের দৃষ্টান্ত হিসেবে উজ্জ্বল ও ভাস্বর হয়ে আছে। অনুরূপ ভাবে আমাদের ধীরেশ স্যারের ক্ষেত্রেও তাই। যখন কিছু সংখ্যক ছাত্র নামধারী দুর্বৃত্তরা এমসি কলেজের শতবছরের পুরনো ‘ছাত্রাবাস’কে পুড়িয়ে ছারখার করেছিলো ঠিক তখনই শক্তহাতে সাহসী পদক্ষেপে সত্যানুসন্ধানের দৃষ্টান্ত হিসেবে মোকাবেলা করায় উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন।

তিনি সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা দোলা রানীর সহিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর সংসার জীবনে এক ভাই কাজল সরকার, সহধর্মিণী দোলা রানী সরকার সহ এক পুত্র ও এক কন্যা রেখে গেছেন। তারা উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে পুত্র ধীমান সরকার কানাডা ও কন্যা দ্বীপ্তা সরকার আমেরিকাতে বসবাস করছে।

তাঁর এক আত্মীয়া শিক্ষয়িত্রী আল্পনা তালুকদারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তিনি জীবনে অন্য কোন পেশাকে এক সেকেন্ডের জন্যও দৃষ্টি দিতে ইচ্ছা পোষণ করেননি। তবে ছাত্রদের তিনি বুঝতেন, বোঝাতেন বা বুঝাতে পারতেন প্রতিটা পেশাই শ্রদ্ধাশীল যদি পেশাকে শ্রদ্ধার সহিত পরিচর্যা করে বিকশিত করা যায়।

যে কোন মানুষ তাঁর সময়ের তাগিদে বা প্রয়োজনের তাগিদে হউক যে কোন পেশায়-ই সে আটকে যেতে পারেন। কিন্তু সেই পেশাকে চিন্তা চেতনা মন-মানসিকতায় রাষ্ট্রও সমাজের জন্য পেশাদারিত্বে বিকশিত করা সেটা কোন সাধারণ বিষয় নয়। যা পেরে ছিলেন ছোটবেলার দেবল প্রফেসর ধীরেশ সরকার। সেই জনবিচ্ছিন্ন অজপাড়া গ্রাম থেকে তাঁর বাবার হাতে শিক্ষা গড়ি নিয়ে হাওরের চান কপালী ঢেউয়ের সাথে জীবন যুদ্ধে যুদ্ধ করে বাংলার হাতে গোনা বিখ্যাত কয়েকটি বিদ্যাপীঠের সর্বোচ্চ আসনে আসীন হওয়া। এতো গেলো এতোবড় বিদ্যাপীঠের প্রশাসনিক দিকের কথা।

অন্যদিকে হার্দিক হৃদয়ের কথা কি না বললে হয়? সেই হাওরপারের ছেলে খালিয়াজুড়ী, মোহনগঞ্জ, শাল্লা সুনামগঞ্জের আফালের ঢেউ খেয়ে ঢাকা থেকে এসে সিলেটের ছাত্র-জনতার অন্তরে স্থান করে নিতে পেরেছিলেন নিজ যোগ্যতায়। আর যোগ্যতা বলেই উনি নিজেও সিলেটের মতো এতো পুণ্যভূমিকে নিজ অন্তরে লালন করতেন। প্রকৃতিও আজ তাঁর লালিত স্বপনে বিভোর হয়ে তাঁর জীবনের শেষ কৃতকাজে আলিঙ্গন করলো।

২০১৫ সালের নভেম্বরের কথা। পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত ও শৈত্যনগরী লন্ডনে “শ্রীকান্ত সংহতি পরিষদ” আয়োজিত কমরেড শ্রীকান্ত স্মরণে কী করণীয় তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-পর্যালোচনা। এসবের মধ্য থেকে সর্বসম্মতিক্রমে সংহতি পরিষদের অন্যতম মধ্যমণি এডভোকেট আবেদ আলীকে নিয়ে নির্ধারণ করা হয় উক্ত স্মরণসভার অতিথি হবেন প্রফেসর ধীরেশ চন্দ্র সরকার। তখন তিনি লন্ডনে বেড়াতে আসছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ সিলেট এমসি কলেজের অধ্যক্ষ ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত। চাকুরী জীবন ১৯৮১ সাল থেকে শুরু করে ২০১৪ অবধি পর্যন্ত বিকশিত শিক্ষকতা জীবনে সিলেটের এই বিদ্যাপীঠেই শেষ করেন।

সেদিন স্মরণ সভায় সমাজের বিভিন্ন স্তরের হল ভর্তি মানুষ ছিলেন। তিনি স্মৃতিচারণ করেছিলেন শৈশবের ফেলে আসা দিনগুলো কৌশলে এড়িয়ে গেলেও বর্ণনা করেছিলেন ছাত্ররাজনীতির প্রেক্ষাপট প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতিতে সম্পৃক্ততা। আরও বর্ণনা করেছিলেন ডাকসুর পক্ষে ৭৪ সালে সুনামগঞ্জ-হবিগঞ্জ-নেত্রকোনা-কিশোরগঞ্জসহ সমগ্র ভাটি অঞ্চলের বন্যা কবলিত সাধারণ মানুষের সাহায্যার্থে পাশে দাঁড়ানো।

তাঁর বক্তব্যে হাউজভর্তি করতালিতে মুখরিত আরও প্রকাশ করেছিলো একজন শিক্ষক সমাজের মাত্র একটি উপকরণ শিক্ষাকে পুঞ্জিভূত করে শিক্ষকতা করেন আর একজন রাজনীতিবিদ সমাজের শিক্ষা সহ প্রতিটি উপকরণকে পুঞ্জিভূত করে রাজনীতির শিক্ষকতা করতে হয় সেই হিসাবে একজন সত্যিকারের রাজনীতিবিদ তাঁর কাছে নমস্যবান ব্যক্তি। সেদিন এই শিক্ষক প্রমাণ করছিলেন তিনি কতটুকু রাজনৈতিক সচেতন। আজো লন্ডন প্রবাসীরা তাঁর সেই বক্তব্য শুনার অধীর আগ্রহী। মেনে নিতে পারছেন না তারা মৃত্যু নামধারী জীবন স্থবিরতার শব্দটি। তিনি গত মঙ্গলবার রাতে বাংলাদেশ সময় ১২.৩০টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

সত্যি অর্থে বলা যায় শিক্ষকতায় বিকশিত, পেশায় শ্রদ্ধাশীল, রাজনীতি সচেতন মানুষ ছিলেন প্রফেসর ধীরেশ সরকার।

  • সুশান্ত দাস প্রশান্ত : যুক্তরাজ্য প্রবাসী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত