দীপংকর মোহান্ত

০৫ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:৩৬

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শিক্ষা-সমাজ-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে শ্রীহট্ট ব্রাহ্মসমাজের ভূমিকা

একথা প্রায় সর্বজনসম্মত যে, আধুনিক বাঙালি সমাজের চিন্তা-চেতনার অরুণোদয়ের দ্বার খুলে দিয়েছিল ব্রাহ্ম সমাজ। ‘ভারত পথিক’ রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) যেভাবে বদ্ধ সমাজে প্রথা ভাঙার সূচনা করেছিলেন, তার ঢেউ বাংলার পূবসীমানার শ্রীহট্টের জনপদে আছড়ে পড়েছিল। এই জোয়ার একশ্রেণির তরুণ ও শিক্ষিত সমাজকে প্রণোদিত করেছিল। আবার প্রথাবাদী সাধারণ মানুষ ভেবেছিল যে ওটা অন্য কোনো ধর্ম, অতএব সে-ধর্ম সমর্থকদের মর্যাদা লাভ করতে পারেনি। সনাতন হিন্দুরা ভাবেনি যে, ব্রাহ্ম ধর্ম আসলে বৈদিক দর্শনে উল্লিখিত নিরাকার উপাসনার একটি দার্শনিক ও ভাবগত বিষয়। ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাবে মানুষ তার প্রাত্যহিক জীবনে ঠুনকো কৃষিপ্রথা, সমাজের স্তর-মান্যতা, লৌকিক পূজা-পার্বণ চালানো ও আচারমূলক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। মানুষ পুরুষানুক্রমে নারীকে অন্ধকার ঘরে রাখা, ছুঁতমার্গ পালন, অন্নদোষ খোঁজা ইত্যাদি বিষয়কে অতি আবশ্যক ধর্ম-অনুষঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। আরেক দল লোক অনার্য আচারে ডুবে থাকে-তারা শৈব। শিক্ষাগ্রহণের চেয়ে গাঁজার কলকিকে শিবঠাকুরের নামে নিবেদন করাকে মোক্ষ ভেবেছিল। তাদের সঙ্গে উচ্চদের কোনো সংশ্রব ছিল না। বৈষ্ণবদের ছিল রাধাভাবের বিষয়হীন কান্না। তারও লেখাপড়ার চেয়ে ভাবের ঘোর বেশি দেখেছেন। অন্যদিকে সামান্য সংখ্যক ব্রাহ্মণ অসামান্য হয়ে ওঠে। সমাজ সংস্কার হোক তা তারা মনেপ্রাণে চায়নি। এই অবস্থা সিলেটেও ব্যতিক্রম ছিল না। ব্রাহ্মরা সে-সকল দুর্গে যৌক্তিক আঘাত হেনে ‘আধুনিকতা’র বিস্তৃতি ঘটায়।

সেকালে পুরো বঙ্গীয় অঞ্চলের মতো সিলেটেও চৌদ্দপুরুষের প্রথা সংরক্ষণ ও রক্ষণশীলতার নীতি ঐতিহ্যের পরম্পরায় প্রবহমান ছিল। তবে পার্থক্য এই যে, বঙ্গীয় অঞ্চলে চালু ছিল রঘুনন্দন স্মৃতি এবং সিলেটে মৈথিলী স্মৃতি শাস্ত্র। যে-কারণে সিলেটের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান দীর্ঘ হয়ে থাকে। আবার এ-জনপদে হজরত শাহজালাল ও চৈতন্য দেবের প্রভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে কেবলমাত্র ধর্মীয় শিক্ষার জোর ছিল। আধুনিক শিক্ষা গ্রহণে অধিকাংশই দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। ইংরেজ আগমনের অনেক পরেও অর্থকরী শিক্ষা এই অঞ্চলে কার্যকর হতে পারেনি। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম অবস্থায় ঢাকা বিভাগ থেকে সমস্ত পূর্বাঞ্চলের প্রশাসনিক ইউনিট চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় সিলেটি চাকরিজীবী খুঁজে পায়নি। এমনকি ‘শ্রীহট্ট জেলা’ সৃষ্টির পর থেকে উনিশ শতকের ষাটের দশক পর্যন্ত বহিরাগত জেলার লোকজন দিয়ে শ্রীহট্টের প্রশাসন চালাতে দেখা যায়। মূলত বহিরাগত কয়েকজন বাঙালি আমলার মাধ্যমে ‘শ্রীহট্ট ব্রাহ্ম সমাজ’-এর সূচনা হয়।

১৮২৮ সালের ২০ আগস্ট কলকাতায় প্রথম ‘ব্রাহ্ম সভা’ অনুষ্ঠিত হয়। ১৮৩০ সালের ২৩ জানুয়ারি (১১ মাঘ) রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে এবং দ্বারকানাথ ঠাকুরের বদান্যতায় আনুষ্ঠানিক ‘আদি ব্রাহ্ম সমাজ’ গড়ে ওঠে। তারা সমবেত হয়ে অন্তরের মধ্যে বিশ্বপতির ছায়া খোঁজে কায়মনোবাক্যে নিরাকার ব্রহ্ম সাধনা করতেন। তার সাথে ছিল বেদ-উপনিষদের একেশ্বরবাদী মন্ত্রোচ্চারণ। এই সময়ে ‘ইয়ং বেঙ্গল’ গোষ্ঠীর ছাত্ররা প্রথাকে একেবারে শেষ করে দেওয়ার আন্দোলন চালিয়েছিল। ফলে শিক্ষিত, উদার ও যুক্তিবাদী ধার্মিক জন ‘ব্রাহ্ম সমাজ’-এর দিকে অগ্রসর হয়। এই টালমাটাল সময়ে ব্রাহ্মদের নেতৃত্বে অনেক সংস্কারবাদী আন্দোলন চলেছিল। তখন সিলেট তথা মৌলভীবাজারের এক টোলে পড়ুয়া ব্রাহ্মণ পণ্ডিত সংরক্ষণবাদী নীতি নিয়ে রামমোহন রায়ের ‘দক্ষিণহস্ত’রূপে কাজ করেছিলেন। তিনি হলেন গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য (১৭৯৯-১৮৫৯)। গৌরীশঙ্কর একদিকে ইয়ং বেঙ্গলের জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকা চালাতেন; আবার রামমোহনের সতীদাহ নিবারণ আন্দোলনে ছিলেন প্রথম সারিতে। তাঁর নিজের পত্রিকা ছিল সম্বাদভাস্কর। তিনি ব্রাহ্ম না হলেও কিছুটা ব্রাহ্মপ্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর পত্রিকার মাধ্যমে অনেক খবর পূর্বাঞ্চলে চলে আসে। গৌরীশঙ্করের সাথে কলকাতায় চাকরিরত সিলেটিদের সম্পর্ক ছিল। বিশ্বনাথের দিঘলী গ্রামের দেওয়ান স্বরূপচন্দ্র দাসের সাথে তাঁর যোগাযোগের তথ্য পাওয়া যায়। স্বরূপচন্দ্র দাসের দুই ছেলে সারদামোহন দাস (যৌবনে প্রয়াত) ও প্রখ্যাত সুন্দরীমোহন দাস (১৮৫৭-১৯৫০) ব্রাহ্ম হয়েছিলেন। সেকালে সিলেটি যুবকদের কলকাতা পড়তে পাঠানো কিংবা শিলং-শিলচরে চাকরিতে পাঠানোর পর অভিভাবকরা আতঙ্কিত হয়ে থাকতেন। কারণ অনেকে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বা প্রভাবিত ছিলেন। হবিগঞ্জের লাখাই দত্ত বংশের শ্রীনাথ দত্ত, রামকুমার দত্ত প্রমুখ ব্যবসায়িক সূত্রে কলকাতায় ব্রাহ্মমত গ্রহণে করলে সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। বিপিন পালের বেলায় তেমনি সারা সিলেটজুড়ে আলোড়ন ওঠে; তারা সমাজচ্যুত হয়েছিলেন।

শ্রীহট্ট ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা
আগেই বলা হয়েছে, সিলেট চাকরিরত কয়েকজন আমলা বা চাকরিজীবী ব্রাহ্ম ছিলেন। তারা এই অঞ্চলে জগদ্দল পাথরের মতো বসে থাকা পুরাতন প্রথা যেমন আধুনিক শিক্ষা গ্রহণে অনীহা, মেয়েদের স্কুলে পাঠানোকে পাপ হিসেবে দেখা, স্পর্শদোষকে ধর্মের বিষয় হিসেবে মান্য করা ইত্যাদি দূর করার চেষ্টা করেন। পাশাপাশি একেশ্বরবাদ প্রচার ও নিরাকার উপাসনাকে সামনে নিয়ে আসেন। মূলত তাদের উদ্যোগে ১৮৬২ সালের ১৫ এপ্রিল (১লা বৈশাখ, ১২৬৯ বঙ্গাব্দ) ‘শ্রীহট্ট ব্রাহ্ম সমাজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। উদ্যোক্তাদের মধ্যে কালিকাদাস দত্ত ও ব্রজেন্দ্রসুন্দর মিশ্র ছিলেন প্রধান ভূমিকায়। কালিকাদাস দত্তের বাড়ি সম্ভবত ময়মনসিংহ জেলায়। তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। ব্রাহ্ম সমাজ গঠনের সময় প্রায় পঞ্চাশজন সদস্য উপস্থিত ছিলেন, তার মধ্যে আইনজীবী ১ জন, ছাত্র ৬জন, ভূ-স্বামী ও ব্যবসায়ী ২৩ জন; বাকি অন্যান্য (সম্ভবত সরকারি চাকরিজীবী)]। অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ব্রজসুন্দর মিশ্র বড় আমলা ছিলেন, কিন্তু তাঁর পরিচয় জানা যায়নি। শ্রীহট্টের আগে ১৮৪৬ সালে ‘ঢাকা ব্রাহ্ম সমাজ’ও গঠিত হয়েছিল। অন্যদিকে ১৮৬৬ সালে দেবেন্দ্রনাথ-কেশবচন্দ্রের দ্বন্দ্বের রেশ শ্রীহট্টে এসে পড়েছিল। তখন স্থানীয়ভাবে সিলেটে ব্রাহ্ম ধর্মের তিনটি শাখা তৈরি হয় [আদি ব্রাহ্ম সমাজ, সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ ইত্যাদি]। একদল শহরের টিলাগড়ে; অন্য দল ছাতকে কেন্দ্রস্থল করেছিলেন। তবে সকলের সমাজ সংস্কারমূলক কাজ একই থাকে। বন্দরবাজারের ব্রাহ্ম মন্দিরটি প্রধান হিসেবে গণ্য হয়। সিলেটে কেশচন্দ্র সেনপন্থীদের অবস্থান বেশিদিন ধরে রাখা যায়নি। সিলেটে কিছু উগ্রতা এসেছিল যেমন পৈতা পরিহার করার প্রশ্ন ইত্যাদি। অনেক যুবক পারিবারিক সংস্কার ও বিশ্বাসবশত পৈতা ত্যাগ, পঞ্জিকা দেখে ভালো দিনে কার্যারম্ভ করা, পিতৃশ্রাদ্ধ বন্ধ করা এবং পূজা-পার্বণ ছাড়তে পারেনি। কলকাতার মতো সিলেটেরও একই অবস্থা ছিল।

পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, প্রথম ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণের যুগে বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার তরুণরা ব্রাহ্ম মতের দিকে বেশি ঝুঁকেছিলেন। তার কারণ হতে পারে পার্শ্ববর্তী ময়মনসিংহ জেলায় প্রভাব। ১৮৫৪ সালে ৭ জানুয়ারি ‘ময়মনসিংহ ব্রাহ্ম সমাজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘শ্রীহট্ট ব্রাহ্ম সমাজ’ প্রতিষ্ঠা হলেও স্থানীয় কেউ আনুষ্ঠানিক ব্রাহ্ম হওয়ার খবর পাওয়া যায় না। তবে ব্রাহ্ম সমাজ গঠনের পর-পর সাপ্তাহিক সমবেত উপাসনা ও মাঘোৎসব (প্রতিষ্ঠা দিবস) পালন শুরু হয়। তখন আনুষ্ঠানিক ব্রাহ্মদের চেয়ে অনানুষ্ঠানিক ব্রাহ্মদের (মতের প্রভাব/ সমর্থক) সংখ্যা বেশি ছিল। প্রধান উদ্যোক্তা দুজন বদলি হয়ে গেলে প্রথম দিকে ব্রাহ্মদের অনুষ্ঠানাদি কোথায় সম্পাদিত হতো তা জানা যায় না। তবে শারদামঞ্জরী দত্তের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় যে, ১৮৭৬ সাল থেকে পুরান লেনের কাছে জমি বন্দোবস্ত নিয়ে ব্রাহ্ম সমাজের ঘর উঠেছিল। পুরাতন কাগজপত্র ও দলিলে প্রমাণিত হয় যে, বর্তমান জায়গায় প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম মন্দিরের জায়গাটি তখন মজা পুকুর ছিল এবং বার্ষিক ছয় টাকা খাজনায় ব্রাহ্মসমাজ দ্বারা পুকুরটি ব্যবহার শুরু হয় এবং ক্রমে পুকুর ভরাট করে উপাসনা ঘর তৈরি হয়। এই জায়গার মালিক ছিলেন জমিদার ব্রহ্মময়ী দাসী (স্বামীসূত্রে তেলী হাওর, শ্রীহট্ট) ও রাইমণি দাসী (পৈত্রিক সূত্রে, শেখঘাট, শ্রীহট্ট)। সে আমলের নিয়মে মহিলারা ‘দাসী’ লিখতেন। সেই ব্রহ্মময়ীর নামে বন্দরবাজারে এখনো ‘ব্রহ্মময়ী বাজার’ রয়েছে। উনিশ শতকের সিলেটে অনেক সংগঠনে এই দুই বদান্য মহিলার দ্বারা চাঁদা/অর্থদানের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৮৯৬ সালে ৩ মার্চ তাঁরা ১৫০ টাকা ‘সেলামী’ গ্রহণপূর্বক প্রায় ষোল শতকের উপরে জায়গা তখন ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক গঙ্গাচরণ সেন (পাঁচবছর পরিচালনা করেন) কে ব্রাহ্মধর্মীয় কাজের নিমিত্তে দান প্রদান করেন। দলিলে জায়গার পরিমাণ উত্তর-দক্ষিণে ৮৮হাত ১২ ইঞ্চি এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৫৯ হাত ১৮ ইঞ্চি উল্লেখ রয়েছে। সম্ভবত আশপাশে জনবসতি বাড়ার কারণে মন্দিরের জায়গা অনেকটা বেহাত হয়ে যায়। সে-কারণে ১৩.০৭.১৯১০ সালে রেজিস্ট্রারির মাধ্যমে মন্দিরের সীমানা চৌহদ্দি পুনর্নির্ধারিত হয়। সংশোধনীতে লেখা হয় : ‘পূর্ব্বে ডাক্তার বিশ্বেশ্বর সেন মহাশয়ের বাসাবাটীর পশ্চিমস্থ নালা (অর্থাৎ খাল), দক্ষিণে সরকারী সড়কের নালা, পশ্চিমে গলি রাস্তার পূর্ব্বস্থ নালা, উত্তরে পুষ্করিণীর উত্তর পারে শ্রীযুক্ত বাবু অভয়চরণ বিশ্বাস মহাশয়ের বাসা। বর্ত্তমানে বাবু কার্ত্তিকচন্দ্র শ্যামের বাসা।’

ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক গঙ্গাচরণ সেন পরলোকগমন করলে পর্যায়ক্রমে কৈলাশচন্দ্র বাগচী, রাধাবিনোদ দাস, জানকীনাথ সেন ‘শ্রীহট্ট ব্রহ্মসমাজ’-এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তারপর আসেন রাজচন্দ্র চৌধুরী (১৮৬০?-১৮২৮)। তিনি বিশ্বনাথ উপজেলার লোক। শিলং চাকরিকালে ব্রাহ্ম হয়েছিলেন। ১৯১১ সাল থেকে ১৯৩২ সাল সাল পর্যন্ত ‘শ্রীহট্ট ব্রাহ্ম সমাজ’কে সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়ে পরিচালিত করেছিলেন গোবিন্দনারায়ণ সিংহ (১৮৬১-১৯৩২)। গোবিন্দনারায়ণের পিতা শিবনারায়ণ সিংহ মজুমদার ময়মনসিংহ জেলার বাসিন্দা ছিলেন। তিনি আসামে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির পদস্থ চাকরিজীবী থাকা অবস্থায় ছেলেদের লেখাপড়ার জন্য বর্তমান চৌহাট্টার ‘খাজাঞ্চি বাড়ি’ বা ‘সিংহ বাড়ি’ গড়ে তুলেছিলেন। গোবিন্দনারায়ণ সিলেটে লেখাপড়া করে সরকারি চাকরি গ্রহণ করেন। তিনি ব্রাহ্ম মত গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী সনাতনধর্মীয় প্রথা-পদ্ধতি পালন করতেন। গোবিন্দনারায়ণের মৃত্যু পর ব্রাহ্ম সমাজের দায়িত্বে আসেন ডা. মহিম চৌধুরী (১৮৭২-১৯৪৪)।

১৮৯৬ সালে শ্রীহট্ট ব্রাহ্ম সমাজের ট্রাস্ট-ডীডস্-এর সদস্যবৃন্দের নাম : ১. সদয়াচরণ দাস (পিতা : মুন্সি সুবলচরণ রায়, আখালিয়া, জাতি বৈদ্য, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট); ২. প্রকাশচন্দ্র দেব (পিতা: সুবিদচন্দ্র রায় চৌধুরী, রায়গড় ঢাকাদক্ষিণ, জাতি : কায়স্থ। ব্যবসা মিরাশদার। প্রকাশচন্দ্র আসাম সরকারের খুব উচ্চ পদে চাকরি করতেন [সচিব হয়ে অবসর নিয়েছিলেন। তিনি লীলা নাগের মায়ের বাবা); ৩. দুর্গাকুমার বসু [বিক্রমপুর, ঢাকা। তিনি সিলেটে আধুনিক শিক্ষার বাতি জ্বালিয়েছিলেন। সিলেট জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ১৯০৩ সালে অবসরে যান); ৪. গোপালকৃষ্ণ দেব (পিতা: হরেকৃষ্ণ দেব চৌধুরী, জাতি: কায়স্থ। পদস্থ সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন); ৫.শিবনাথ দত্ত [পিতা: শম্ভুনাথ দত্ত, গ্রাম: জামসি, বালিশিরা, শ্রীমঙ্গল। ঢাকা বোর্ড রেভিনিউ অফিসের কর্মকর্তা); ৬. গোবিন্দনারায়ণ সিংহ মজুমদার (পিতা : শিবনারায়ণ সিংহ মজুমদার,; বটতলী তপেসিংধা, আটগাঁও ময়মনসিংহ); ৭.নীলমণি চক্রবর্তী (কলকাতা, তিনি চেরাপুঞ্জি খাসিয়া অঞ্চলে ব্রহ্মপ্রচারক ছিলেন); ৮. রাজচন্দ্র চৌধুরী (পিতা : রাজমোহন চৌধুরী, বিশ্বনাথ, সিলেট। স্পেশিয়াল সাব-রেজিস্টার); ৯. উমেশচন্দ্র চৌধুরী (পিতা : কালীচন্দ্র চৌধুরী,ভাটেরা, কুলাউড়া)।

১৯৪৬ সালের ট্রাস্টিবৃন্দ: ১. রায় সাহেব শিবনাথদত্ত; ২. উমেশচন্দ্র চৌধুরী; ৩. নলিনীবালা চৌধুরী ; ৪. সতীশচন্দ্র রায়; ৫. গোপেন্দ্রনারায়ণ সিংহ; ৬. আশুতোষ দাস; ৭. রাজেন্দ্রচন্দ্র দাস ( ৮ ও ৯ সংখ্যক ঘর খালি রয়েছে)

শ্রীহট্ট ব্রাহ্ম সমাজের সমাজ সংস্কার কার্যক্রম
শ্রীহট্ট ব্রাহ্ম সমাজ ছিল এই অঞ্চলের সমাজ প্রগতির বাতিঘর। তারা ধর্ম ও সমাজ-প্রগতিকে একই তরীর যাত্রী করেছিলেন। নিরাকার ব্রহ্ম উপাসনার পাশাপাশি তারা আধুনিক শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে সাহায্য করেন। সাপ্তাহিক সমবেত উপাসনা ছাড়াও শ্রীহট্ট ব্রাহ্মমন্দির ছিল বুদ্ধিভিত্তিক চিন্তা এবং সংস্কৃতিচর্চার অন্যতম কেন্দ্র। তাদের সভা নারী-পুরুষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকে। ব্রহ্মসঙ্গীত গাওয়া হতো। কোনো ছুঁৎমার্গ ছিল না। উনিশ শতকের সিলেটের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এই ঘরকে কেন্দ্র করে প্রবাহিত হয়েছিল। তখন নামী দামী লোকের বক্তৃতা ও সংগীত শোনার জন্য শহরের লোকজন ভিড় করতেন। বিপিন পাল তাঁর সত্তর বছর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি শৈশবে ব্রাহ্ম সমাজে গিয়ে রামমোহন রায়ের ওপর বক্তৃতা শুনেছিলেন। পরে তিনিও বহুবার এই গৃহে বক্তৃতা করেছেন। প্রথম যুগের বিখ্যাত ব্রাহ্ম রামকুমার বিদ্যারতœ এখানে এসে বক্তৃতা করেছিলেন। ডা. বিধান রায়ের পিতা বিখ্যাত প্রকাশচন্দ্র রায় (সমাজ সংস্কারক) সিলেট ব্রাহ্ম সমাজে বক্তৃতা দিতেন। মুরারিচাঁদ কলেজের অনেক অধ্যাপক তখন ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তখন ব্রাহ্ম সমাজের কার্যক্রম ছিল বহুমুখী।

ব্রাহ্মদের সামাজিক প্রথা ভাঙা
সামাজিক প্রথা ভাঙার জন্য ব্রাহ্মদের জুড়ি ছিল না। তারা একেশ্বরবাদী চিন্তা ও নিরাকার ব্রহ্ম উপাসনার ফলে হিন্দু সমাজের লোকাচার ও বৈদিক ক্রিয়াদি অস্বীকার করেন। অনেক আবার দুয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে চলেন। তারা স্পর্শদোষ ও ছুঁতমার্গের ঘোর বিরোধী ছিলেন। অথচ এগুলো ছিল হিন্দুদের রক্ত-মজ্জায় প্রবহমান। তারা নিত্য গৃহপূজা, পিণ্ডদান, গঙ্গাস্নান, কাকবলি দেওয়া, মন্ত্রে কন্যাদান- এমনি মৃতের উদ্দেশ্যে শাস্ত্রমতে শ্রাদ্ধ করতে অপারগতা প্রকাশ করতেন। কেউ মারা গেলে তারা কেবল আত্মার সদ্গতির জন্য উপাসনা করতেন। উমেশচন্দ্র চৌধুরীর স্ত্রী মারা গেলে তিনি ব্রাহ্ম মতে শ্রাদ্ধ করেন। পদস্থ কর্মকর্তা প্রকাশচন্দ্র দেব তাঁর মেয়ের বিবাহকালে [কুঞ্জলতা দেবী, পরে নাগ। স্বামী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট গিরিশচন্দ্রনাগ] ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি মেয়েকে শাস্ত্র মতো দান করতে পারেন না। মেয়ের ইচ্ছে হলে তার মামারা দান করবেন। তখন কিছু রেজিস্ট্রারি বিয়ে ব্রাহ্মদের বদান্যতায় হয়েছিল।

ব্রাহ্মদের কার্যক্রমে গোটা সিলেটের হিন্দু সমাজ ছিল বিপক্ষে। তখন ব্রাহ্মদের বিরুদ্ধে রক্ষণশীল ও প্রথা মানা ব্যক্তিরা সামাজিক বৈঠক যেমন করেছিল তেমনি অনেক ব্যঙ্গাত্মক কবিতা-ছড়া বের হয়েছিল। রক্ষণশীলরা ব্রাহ্মদের প্রসার ও প্রচার ঠেকানোর চেষ্টা করেন।

প্রথম দিকের ব্রাহ্মরা সমাজ ও পরিবার দ্বারা ‘একঘরে’, সমাজচ্যুত এবং বহিষ্কার হয়েছিলেন। কেউবা হয়েছিলেন ত্যাজ্যপুত্র। এই সময় বৃহৎ সমাজে চোখে ব্রাহ্মদের অবস্থান নিম্নতর শূদ্রদের পর্যায়ে চলে যায়। সিলেটে ব্রাহ্মদের কোনো সামাজিক নিমন্ত্রণ ছিল না। ঘরে তোলা হয়নি। যে পরিবারের সদস্য ব্রাহ্ম হয়েছিলেন-সেই পরিবারগুলো ‘কলঙ্কের ঘানি’ টানতে হয়েছিল বহুকাল। এমন দিনও গেছে যে, হয়তো ভাই ব্রাহ্ম হয়েছে, এই অপরাধে বাড়ির সবাই হয়েছেন সমাজচ্যুত। তারাও কারো ঘরে উঠলে সে পরিবারের জাত যাওয়া বা অসম্মানিত হওয়ার শামিল ছিল। প্রবীণ শিবেন্দ্র প্রসাদ দে-এর মুখ থেকে শুনেছিলাম যে, ব্রাহ্মরা কখনো কারো বাড়ি অকস্মাৎ গেলে তিনি চলে যাওয়ার পর গোময় দিয়ে ছিটা দিয়ে বাড়ি-ঘর পবিত্র করতে হয়েছে। ব্রাহ্মরা কী প্রতিকূলতা মাড়িয়ে সিলেটে শাস্ত্রাচারের চারণভূমিতে সমাজ প্রগতির বাণ ডেকেছিলেন তা আজ চিন্তার বাইরে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। বিপিনচন্দ্র পাল ও সুন্দরীমোহন দাস যখন ব্রাহ্মধর্মমত গ্রহণ ও অসবর্ণে বিধবা বিবাহ করেছিলেন তখন সিলেটবাসী তাদের বর্জন করে। ঘটনার পর একবার বিপিনচন্দ্র সিলেটে এলে ঘৃণায় কেউ ডাকেনি ও নিমন্ত্রণ দেয়নি। তখন রেভারেন্ড প্রাইসের ছাত্র ও ব্রাহ্ম সমর্থক হরকিঙ্কর দাস উকিল (১৮৪৮-১৯৩৩) পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।

তখন শিক্ষিত সমাজের অনেক সংস্কার ছিল। নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং মুসলমানের হাতে জলগ্রহণও অস্পৃশ্য ছিল অর্থাৎ ‘জল-চল’ছিল না। মুরগি খাওয়া ও ডিম খাওয়া তখনো অধিকাংশ পরিবারে অচিন্তনীয় ছিল। সমাজে নিচু শ্রেণির লোকজন ধনী বা বর্ণবাদী কারো বাড়িতে/হোটেলে ভাত-চা খেলে থালা ধুয়ে দেওয়ার প্রচলন ছিল। কিন্তু ব্রাহ্মরা এটাকে দেখতেন অবমাননাকর বিষয় হিসেবে। ব্রাহ্মরা তখন বলতে পেরেছিলেন- ‘অনাহারে রাত্রি কাটাইব তাও ভালো। কিন্তু হোটেলে ভাত খাইয়া থালা ধুইতে পারিব না।’ ব্রাহ্ম মহিলা শারদামঞ্জরী লেখেন : ‘সেই সময় প্রকাশ্যে বিস্কুট খাইলে জাতিচ্যুত হইতে হইত’। তিনিও এই বিপদে পড়েছিলেন। বিপিন পালের আত্মজীবনীতে লুকিয়ে বিস্কুট ও পানীয় খাওয়ার ঘটনা রয়েছে। ব্রাহ্ম এবং কিছু ব্রাহ্ম সমর্থক পরিবারের শিশুরা শিশু সুলভচিত্তে প্রকাশ্যে তা খাইতেন। এই প্রভাব গিয়ে পড়েছিল রক্ষণশীল পরিবারের ওপর। তখন অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন হয়ে হয়ে পড়েছিলেন। খাওয়া-দাওয়, ছোঁয়াছুঁয়ির সামাজিক বাধা তখনো অনতিক্রম্য ছিল। এই গর্হিত কাজ করলে ছাত্রদের মা-বাবা বকুনি দিতেন, কখনো স্নান করে ঘরে তুলত। সমাজের বিপরীতে বড় কাজ করলে আবার প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো। সেকালে অন্য সমাজের লোকের হাতে খাওয়া ও ঘরে প্রবেশ-অধিকার ছিল না। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে এই বাধাগুলো ভেঙে ছিল ব্রাহ্ম সমাজের লোকজন।

শ্রীহট্টের কৌড়িয়া পরগণার (বর্তমান বিশ্বনাথ) ব্রাহ্ম ভারতচন্দ্র চৌধুরী শিলং শহরে প্রকাশ্যে মুচির ঘরে ভাত খেয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক প্রথা ভাঙা। পরে তিনি ‘জাতিচ্যুত ব্রাহ্মণ’ হয়েছিলেন। ঢাকাদক্ষিণ দত্তরাইল গ্রামের গুরুচরণ সেন ব্রাহ্ম মত গ্রহণের ফলে সমাজের কোপদৃষ্টিতে পড়েছিলেন। ভাটেরা কুলাউড়ার ব্রাহ্ম উমেশচন্দ্র চৌধুরী এই কারণে বাড়িছাড়া হয়েছিলেন।

উনিশ শতকের সত্তর ও আশির দশকে ‘শ্রীহট্টীয় ছাত্র’ কিছু ছাত্র উচ্চশিক্ষার আশায় কলকাতা গিয়ে ব্রাহ্ম হয়েছিলেন। বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসে যারা স্থান করে নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-সীতানাথ দত্ত তত্ত্বভূষণ [(১৮৫৬-১৯৪৫) ব্রাহ্ম], সুন্দরীমোহন দাস [(১৮৫৭- ১৯৫০) ব্রাহ্ম], বিপিনচন্দ্র পাল [(১৮৫৮-১৩৩২) ব্রাহ্ম], অভয়াচরণ দাস [(১৮৬২-১৯২১) ব্রাহ্ম-সমর্থক], তারাকিশোর চৌধুরী [(১৮৫৯-১৯৩৫) ব্রাহ্ম]। সিলেটে স্কুল জীবনে এই যুবকদের প্রাণিত করেছিলেন তাদের শিক্ষাগুরু উদারনৈতিক শিক্ষক দুর্গাকুমার বসু [ব্রাহ্ম, বাড়ি ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে]। এই গ্রুপ সেদিন কলকাতায়ও আলোড়ন তুলেছিল। তারা মাতৃভূমি সিলেটের উন্নয়ন সাধনের মাধ্যমে পুরাতন দুর্গ ভেঙে আলো আসার পথ করে দিয়েছিলেন। ব্রাহ্মদের নতুন সমাজ বিনির্মাণের ঐতিহাসিক কৃতিত্ব গভীর চিত্তে বুঝতে হবে।

নারী জাগরণমূলক কাজ
সিলেটে আলাদা একটা নারী ধর্ম ছিল। সকল নারী ভালো ফল লাভের আশায় হরেক রকম ব্রত তারা পালন। কুমারী মেয়েরা ভালো স্বামীর আসায় ‘মাঘী ব্রত করতেন’। পূজা-পার্বণ-বিবাহে আলাদা নারী আচার ছিল। কিন্তু ব্রাহ্ম মহিলারা এগুলো করতেন না এবং মানতেন না। তারা স্বামীর পাতে ভাত ভাওয়ার প্রথা বিলুপ্ত করেন। ব্রাহ্ম সমাজ নারী শিক্ষায় উৎসাহ প্রদান করতেন। ব্রাহ্ম সমাজে চালু ছিল তের বছরের নিচে মেয়েকে বিয়ে করা যাবে না। ছেলেরা বিয়ে করবে সতেরো-আঠারো বছরে। ছেলেমেয়েদের মধ্যে পারস্পরিক দেখাদেখি, কথাবার্তার মাধ্যমে বিয়ের প্রথা করে ব্রাহ্মরা।

ব্রাহ্ম মহিলারা বাড়ি-বাড়ি গিয়ে মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর প্রচার করেন। বয়ঃসন্ধিকালের মেয়েদের স্বাস্থ্য, বিবাহিত নারীদের স্বাস্থ্যের কথা বলতেন। এমনকি উনিশের শেষদিকে সিলেটে ব্রাহ্ম প্রভাবান্বিত একটি পরিবার (কবি প্যারীচরণ দাসের) প্রথম বিবাহকালে মেয়েকে পায়ে হেঁটে সাত পাকের মাধ্যমে স্বামীর গলায় মালা দেওয়ার প্রচলন ঘটিয়েছিল। তার আগে কন্যাকে ‘খাটে তুলে’ চক্কর দেওয়ানোর প্রথা ছিল। ব্রাহ্মরা বয়স্ক নারী, মেয়ে ও শিশুদের জন্য স্কুল খুলেছিল। গর্ভাবস্থায় নারীকে পুরুষ ডাক্তার দেখানো, নার্স দিয়ে সন্তান প্রসব করানো, প্রসূতিকে খাটে রাখা, শিশুদের বিজ্ঞান সম্মত পরিচর্যা, মেয়েদের পায়ে জোতা পরা, প্রকাশ্যে চলাফেরা, ঘোমটা ছোট করা, ছায়া-ব্লাউজ-অন্তর্বাস পরা, স্বামীর সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, ঘুরে-বেড়ানোর পথ রচনা করে দিয়েছিল। পবিত্রতার নামে গোময় ছিটানো ব্রাহ্ম পরিবার বন্ধ করে দেয়। ব্রাহ্ম মেয়েরা আবার অনেকটা সাহেব-মেমদের অনুসরণ করতে দেখা গেছে। সমাজ সংস্কার ও উন্নয়নের নিমিত্তে ক্লাব তৈরির ধারণা থেকে ব্রাহ্ম মহিলারা গড়েছিলেন ‘শ্রীহট্ট মহিলা সমিতি’। নলিনীবালা চৌধুরী এই সংগঠন চালাতেন। নলিনীবালা ও হেমন্তকুমারী চৌধুরীর অক্লান্ত পরিশ্রমে সিলেট শহরে পর্যায়ক্রমে গড়ে ওঠে কিন্ডার গার্টেন শিশু বিদ্যালয়, ধাত্রী বিদ্যালয় ও নার্সিং শ্রেণি এবং প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। হেমন্তকুমারী চৌধুরী ১৯০৩ সালে জিন্দাবাজার এলাকায় বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা এখন সিলেট শহরে অগ্রগামী সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। কিন্ডার গার্টেন বিদ্যালয়টি বহুদিন এই স্কুলের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ত্রিশের দশকে অগ্রণী বিদ্যালয়ের কয়েকজন ব্রাহ্ম শিক্ষিকা সমাজে সমানাধিকার ও হিন্দু পারিবারিক আইনে মেয়েদের পিতৃসম্পত্তির ওপর ভাগী হওয়ার দাবি তোলেন। সিলেটে আধুনিক চিকিৎসা খ্রিস্টান মিশনারিরা সূচনা করলেও হিন্দু পরিবারের নারীরা রক্ষণশীলতা ও লজ্জার কারণে ডাক্তারে যেতে চাইতেন না। অন্যদিকে মুসলিম সমাজে তা ছিল অকল্পনীয়। ত্রিশের দশকে সিলেট নারীনেত্রী জোবায়দা খাতুন জাগরণ পত্রিকায় নিজের সমাজের পুরুষদের নির্বিকার থাকার জন্য উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। ব্রাহ্ম মহিলাদের ধাত্রী ও নার্সিং শাখায় ডা. সুন্দরীমোহন দাস (ব্রাহ্ম) অনেক উৎসাহ দিয়েছিলেন। বিশ শতকের দ্বিতীয়/তৃতীয় দশকে এই প্রতিষ্ঠানকে তারা রেডক্রসকে দিয়ে দেয়, যা এখনো শিশু ও ‘মাতৃমঙ্গল’ নামে টিকে আছে। সমাজ সেবিকা কল্যাণী মিশ্র এই মাতৃমঙ্গল প্রতিষ্ঠানে বহুকাল মানবসেবা দিয়েছিলেন। ব্রাহ্ম মহিলাদের শিল্প সংস্থা (মেয়েদের হাতের কাজ শেখানো] পরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ব্রাহ্মরা তখন সামাজিক কল্যাণে উদ্দেশ্যে ও প্রয়াত সতীর্থদের স্মরণে রাখার জন্য কয়েকটি ফান্ড তৈরি করেছিল, যা থেকে অসহায় দুঃখী মানুষের সেবা কাজ চলত। যেমন- রাজচন্দ্র চৌধুরী ফান্ড ৬৫০ টাকা, সদয়াচরণ দাস ফান্ড ৫০০ টাকা, নবগোপাল দত্ত ফান্ড ৫০০ টাকা, জানকীনাথ সেন ফান্ড ৩০ টাকা। ফান্ডের আয় থেকে দীন-দুঃখীর সেবাকাজ চলত। টিলাগড়ে ছিল ব্রাহ্মদের একটি বড় হোমিও দাতব্য চিকিৎসালয়।

বৃহত্তর সিলেট তথা পূর্ব বাংলার প্রান্ত সীমানায় নারীজাগরণে ব্রাহ্ম সমাজের ভূমিকা তুলনাহীন। সিলেটের তরুণ ছাত্র বিপিনচন্দ্র পাল, সুন্দরীমোহন দাস প্রমুখ নারী শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে ১৮৭৬ সালে কলকাতায় ‘শ্রীহট্ট সম্মিলনী’র সৃষ্টি করেছিলেন। তারা নারী ও সিলেটিদের জীবনমান উন্নয়নে ১৯৩৫ পর্যন্ত গঠনমূলক কার্যক্রম চালিয়েছিলেন বলে দৃষ্টিগোচর হয়। ‘শ্রীহট্ট সম্মিলনী’র মাধ্যমে শত-শত মহিলারা নতুন পথরেখা দেখেছিলেন। কবি মল্লিকাসুন্দরী দাস ও শারদামঞ্জরীর মতো মহিলারা সম্মিলনীর মাধ্যমে লেখাপড়া শিখে বৃহৎ সমাজের কল্যাণে কাজ করেন। ব্রাহ্ম মহিলারা প্রকাশ্যে রাস্তা-ঘাট-প্রতিষ্ঠানে বাধাহীন যাতায়াত করতেন। কিন্তু ব্রাহ্ম সমর্থক বা রক্ষণশীল পরিবারের নারীরা ঘোড়ার গাড়ির চারদিক ঘেরা পর্দা দিয়ে চলাচল করতেন। ১৯১৮ সালে সিলেট শহরে একটি আলোচিত ঘটনা ঘটে। শিল্পপতি সারদা শ্যামের [ব্রাহ্মসমর্থক] বড় মেয়ে ব্রাহ্ম সমাজে যাওয়ার পথে ঘোড়ার গাড়ির পর্দা তুলেছিলেন। এই ঘটনায় শহরে আলোড়ন ওঠে; রক্ষণশীলরা নেতিবাচক কথা প্রচার করেন ও প্রশ্ন তোলে। কেউ-কেউ তাদের পঞ্চায়েত থেকে বাদ দেওয়ার কথা বলে। অন্যজন দেখে ‘কলিকালে’র আবির্ভাব হিসেবে। কিন্তু এই সামান্য ঘটনা অসামান্য হয়ে নারী জাগরণের পথ খুলে দেয়। গোঁড়ামিতে পূর্ণ সিলেট শহরের নারীরা এরপর থেকে আর ঘোড়ার বা গরুর গাড়িতে পর্দা মানেননি (অতিরক্ষণশীল হিন্দু ও মুসলিমদের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল)। গাড়ির ওপর থেকে পর্দা উঠানোর বিষয় আঞ্চলিকভাবে নারীর জাগরণের ইতিহাসে একটি মাইলফলক বা চিহ্নায়ন বলা যায়। ১৯১৯ সালে ব্রাহ্ম মন্দিরে রবীন্দ্রনাথের প্রার্থনা সভায় অনেক মহিলা প্রকাশ্যে যোগ দিয়েছিলেন। আবার নারীসমাজ-কর্তৃক রবীন্দ্র সংবর্ধনার ফলে শহরের রক্ষণশীলতা ও প্রাচীন পদ্ধতির বিলুপ্তি ঘটে। সংবর্ধনার উত্তরে তিনি নারীদের স্বাধীনভাবে চিন্তা ও চলাচলের কথা বলেছিলেন। ১৯৩১ সালে কবি কামিনী রায় (১৮৬৪-১৯৩৩) ব্রাহ্ম মন্দিরে এসে দীর্ঘ বক্তৃতা করেছিলেন। ফলে নারীসমাজ আরও এগিয়ে যায়।

শত-শত বছর থেকে রাজন্যবর্গের প্রশাসনের প্রাণ কেন্দ্র হিসেবে সিলেট শহরের সামাজিক ঐতিহ্য গড়ে ওঠে। নারীরা ছিল অনেকটা বন্দি দশায়। অপর দিকে সদ্য গড়ে-ওঠা শিলং ও শিলচর টাউন ছিল অনেকটা মুক্ত। এই শহরদ্বয়ের নাগরিক সমাজে গ্রামীণ পরিবেশের জটিলতা প্রবেশ করেনি। ফলে এই দুই শহরে ব্রাহ্ম সমাজ দ্রুত বিকাশ লাভ ঘটে। এবং সামাজিক রক্ষণশীলতা কাটিয়ে নারীরা আগেই পুব আকাশ দেখেছিল। বরং শিলং-শিলচরের প্রভাব উলটো সিলেটের নারী সমাজের উপর দিয়ে বয়ে যায়। মূলত সিলেটি চাকরিজীবীদের দ্বারা ১৮৭২ সালে শিলচর শহরে ব্রাহ্ম সমাজ গড়ে ওঠে। শিলং ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮৭৫ সালে (আসামে ব্রাহ্ম সমাজ সৃষ্টির সময়কাল: গৌহাটি-১৮৭০ সাল, গোয়ালপাড়া- ১৮৭০ সাল, নওয়াগা-১৮৭০সাল, শিবসাগর-১৮৬৬ সাল, তেজপুর ১৮৭০)। বিশেষত শিলং-এর ব্রাহ্ম মহিলারা সিলেট এসে আধুনিক নারী সমাজ গঠনের প্রাথমিক সলতে পাকানোর কাজ শেষ করেন। এই নারীরা আদিতে ছিলেন সিলেটি। তারা শিলং গিয়ে ব্রাহ্ম হয়েছিলেন। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য ব্রাহ্ম নারীনেত্রী হলেন-হেমন্তকুমারী দেবী (১৮৬৮-১৯৫০), শারদামঞ্জরী দত্ত (১৮৭২-?), নলিনীবালা দেবী প্রমুখ। তারা স্ব-সমাজকে অল্প সময়ে কয়েক বছর এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

সিলেটি ব্রাহ্মদের সাথে ঠাকুরবাড়ির সম্পর্ক
মহর্ষি দেবেন্দ্রেনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) যখন আসাম ভ্রমণ করেন (১৮৪৯ সালে) তখন এই অঞ্চলে কেউ ব্রাহ্ম ছিলেন না। তাঁর সাথে সিলেটি ছাত্রদের যোগাযোগ ঘটে মধ্য উনিশের নবজাগৃতির শেষ ঢেউগুলোর তালে। তারও আগে রামমোহন ও দ্বারকানাথ ঠাকুরের ব্রাহ্ম বিষয়ক খবরাখবর গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্যের সম্বাদভাস্কর পত্রিকার মাধ্যমে ঈশান বাংলার জনমানসকে আলোড়িত-বিলোড়িত করেছিল। কিন্তু এই নতুন চিন্তা গ্রহণ করতে কেউই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। সমকালে কলকাতায় বসবাসরত ‘শ্রীহট্টীয়’ কিছু ব্যবসায়ী (জানকীনাথ, শ্রীনাথ প্রমুখ) ব্রাহ্ম মত গ্রহণ করেছিলেন। সেই থেকে সিলেটে রামমোহন চর্চা ও সমবেত একেশ্বরবাদী প্রার্থনা শুরু হয়ে যায়। পরে স্কুল পড়ুয়ারা ব্রাহ্ম মন্দিরে যাতায়াত শুরু করে, বক্তৃতা শোনে।

কলকাতায় অবস্থানরত পূর্বাঞ্চলের ব্রাহ্মরা মহর্ষির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন নানা কারণে। যদিও তিনি তখন ব্রাহ্ম সমাজের মূল কাণ্ডারি। প্রথমত ঠাকুর পরিবার ছিল প্রথাভাঙা ও সমাজ সংস্কারের প্রতীক বা একটা আইকন হিসেবে। গ্রামীণ পরিমণ্ডল থেকে কলকাতা যাওয়া ছাত্রদের মধ্যে অনেক সংস্কার ছিল। সকলের হাতে খাওয়া, একসাথে বসে খাওয়া বা মুসলমান দোকানে খাওয়া ইত্যাদি ব্রাহ্মরা উৎসাহ করতেন। ঠাকুর পরিবারে এইগুলোর প্রচলন আগেই ছিল। ফলে অনেক তাদের অনুসরণ করত ও জানতে আগ্রহী ছিল। আবার দেবেন্দ্রনাথ কেশব সেনের মতো উগ্রভাব পোষণ করতেন না। তিনি অনেক হিন্দু সংস্কার ও ঐতিহ্যকে জীবনাচরণের মধ্যে রেখেছিলেন। ফলে রক্ষণশীল পরিবার থেকে যাওয়া সিলেটি ছাত্ররা নতুন-পুরাতন দ্বন্দ্বের মধ্যে সমন্বয় করতে পেরেছিল।

মধ্য উনিশ পর্যন্ত ‘হিন্দু কলেজ’(১৮১৭-১৮৫৫) ‘শ্রীহট্টীয়’ছাত্রদের সংখ্যা একেবারে কম ছিল। মূলত সত্তর দশক থেকে প্রেসিডেন্সী (পূর্বের হিন্দু কলেজ) কলেজে পূর্বাঞ্চলীয় ছাত্র ভর্তির হার ক্রমে বাড়তে থাকে। কলকাতায় প্রগতিশীল ছাত্রদের একটা বড় যোগান দিয়েছিল সিলেট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। এই স্কুলের ছাত্র বিপিন পাল পরবর্তী জীবনে উল্লেখ করেন যে, তিনি সরকারি স্কুলে পড়ার সময় তাঁর বন্ধু সীতানাথ দত্তের [(১৮৫৬- ১৯৪৫) হবিগঞ্জ] মাধ্যমে ব্রাহ্মমতের ধারণা পেয়েছিলেন। বিপিন পাল সেই সময় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম শুনেছিলেন। তাঁর উপলব্ধি ছিল, ‘প্রাচীন হিন্দুয়ানী ও নবীন ব্রাহ্ম সমাজের মাঝখানে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ দাঁড়াইয়া আছেন-এ-কথাটা ছাত্রাবস্থায় শ্রীহট্টে থাকিতেই শুনিয়াছিলাম।” ধারণা করা যায় সিলেটি ব্রাহ্মদের ওপর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছায়া পড়েছিল।

‘শ্রীহট্টীয় ছাত্ররা’ কলকাতায় পড়তে গিয়ে সেকালের শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্ম নেতা মহর্ষি দেবেন্দ্রেনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫), কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮-১৮৮৪), অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৮৬), রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬-১৮৯৯), শিবনাথ শাস্ত্রী (১৮৪৭-১৯১৯) প্রমুখের সংস্পর্শে এসেছিলেন বলে নানাভাবে প্রমাণ পাওয়া যায়। সত্তরের দশকে সিলেট থেকে সুন্দরীমোহন দাস গিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে (১৮৭৩ সালে; এফ.এ)। ক্রমে বিপিন পাল (কলকাতা গমন ১৮৭৪ সালে, ভর্তি ১৮৭৫ সালে) ও তারাকিশোর চৌধুরী (১৮৭৪) সে কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। সীতানাথ দত্ত ভর্তি [১৭৭৫] হলেন জেনারেল এসেম্বলি কলেজে (পরে নাম স্কটিস চার্চ কলেজ)। তারা প্রায় একই ছাত্রাবাসে বসবাস করে ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ’ ও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। এই চারজন প্রায় এক সময়ে ব্রহ্ম ধর্ম গ্রহণ করে কলকাতা ও পূর্বাঞ্চলে আলোড়ন তুলেছিলেন। বিপিন পালরা যখন কলকাতা প্রবেশ করছেন তখন দুলালচন্দ্র দেব [(১৮৪১-১৯২০); পঞ্চখণ্ড, সিলেট] ১৮৬৯ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। প্রথম দিকে তিনি ব্রহ্মমত দ্বারা প্রভাবিত হলেও সিলেট ফিরে ওকালতি পেশা ও পৌর চেয়ারম্যান হয়ে পরিবর্তনশীল চিন্তা থেকে সরে পড়েন। কবি প্যারীচরণ দাস ১৮৭০ সালের দিকে উচ্চ শিক্ষাগ্রহণের উদ্দেশ্যে কলকাতা গমন করেন। তিনি সম্ভবত অভাবের কারণে ব্রিটিশের পররাষ্ট্র বিভাগে চাকরি নেন। প্যারীচরণ ব্রাহ্ম দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তাঁর একান্ত বন্ধু ছিলেন অকাল প্রয়াত সারদামোহন দাস (দিঘলী, বিশ্বনাথ) ব্রাহ্ম ছিলেন। বিপিনপাল ও সুন্দরীমোহন ১৮৭৭ সালে শিবনাথ শাস্ত্রীর প্রেরণায় ব্রাহ্ম মত গ্রহণ করেন। আবার বিদ্যাসাগরের প্রভাবে অসবর্ণে বিধবা বিবাহ করে চারদিকে আলোড়ন তুলেছিলেন। ১৮৮১ সালে বিপিনচন্দ্র পাল বোম্বের এক ব্রাহ্মণ বালিকা বিধবাকে বিয়ে করেছিলেন। তখনও বিধবা বিবাহ সমাজে ব্যাপকভাবে চালু হয়নি। এ-জন্য ব্রাহ্ম বিপিনচন্দ্র পাল জন্মভূমে নিন্দিত হয়েছিলেন। সমকাল তাঁকে মূল্যায়িত করতে পারেনি। তিনি জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্দেশ্যে ১৮৮০ সিলেটে আসার পর কোনো হিন্দু চাকর পর্যন্ত যোগাড় করতে পারেননি। শেষপর্যন্ত রান্নার জন্য মুসলমান চাকর রেখেছিলেন। এই ছিল নিঠুর বাস্তবতা।

ব্রাহ্ম হওয়া চার বন্ধুর মধ্যে সীতানাথ দত্ত ‘ব্রহ্ম-সূত্র’-বিদ্যা ও উপনিষদে দক্ষ ছিলেন। সে কারণে তিনি ক্রমে মহর্ষির প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। সীতানাথ ‘মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের নিকট হইতে জ্ঞানচর্চার উদ্দীপনা লাভ করিয়াছিলেন।’এবং ব্রহ্মতত্ত্ব’ নামে পত্রিকাও প্রকাশ করেন (১৮৯৬)। সিলেটের গোবিন্দনারায়ণ সিংহ (১৮৬২-১৯৩২), রাজচন্দ্র চৌধুরী প্রমুখ ব্রাহ্মধর্মসূত্রে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংস্পর্শে এসেছিলেন। ঠাকুর বাড়িতে তাঁদের যাতায়াত ছিল।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অনেকটা সমন্বয়বাদী ধারার চিন্তক। একবার পৈতা ত্যাগের কথা বলেও পরে ফিরে আসেন। তবে হিন্দু সমাজের প্রথাগত কিছু পূজাপার্বণ বাদ দিয়ে তিনি বিভিন্ন ব্রাহ্ম দিবস পালনের প্রবর্তন করেছিলেন। এই দিবসগুলো ঠাকুরবাড়িতে ঘটা করে উৎসবমুখর পরিবেশে পালিত হতো। তাঁর মৃত্যুর পর মাঘোৎসবে কখনো দ্বিজেন্দ্রনাথ; কখনো-বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নেতৃত্ব দিতেন। এই অনুষ্ঠানাদিতে সিলেটি ব্রাহ্মদের যাতায়াত লক্ষণীয়। ব্রাহ্ম সমাজের সমর্থক ব্রজেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী [১৮৮১-১৯৭২] কলকাতা পড়াকালে ১৯০২ সালে ঠাকুর বাড়ির মাঘোৎসবে যোগ দিয়েছিলেন। সিলেটে প্রথম যুগের ব্রাহ্ম মহিলা শারদামঞ্জরী দত্ত ১৯১০সালে ঠাকুরবাড়িতে [৭পৌষের] দীক্ষা অনুষ্ঠানে যোগদান করেছিলেন। তিনি ঠাকুর বাড়ির আঙিনা ও উৎসবে যেন দেবেন্দ্রনাথের ছায়া দেখেন। শারদা লেখেন, “...স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ উপাসনার আচার্য্যরে কার্য করিলেন। উপাসনা শেষ হইলে মহর্ষিদেবের সাধন স্থান প্রসিদ্ধ ‘ছাতিম তলা’ দেখিয়া হৃদয়ে অপর আনন্দ ও বিস্ময় লাভ করিলাম।’ তখন ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের মেলায় যাওয়া নিষেধ ছিল। শারদামঞ্জরী হেমলতা দেবীর মাধ্যমে মেলায় যাওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথে ঠাকুরের নিকট থেকে অনুমতি নিয়েছিলেন। কীভাবে তিনি ঘোড়ার গাড়িতে করে মেলায় পৌঁছেছিলেন তার বিবরণ সুন্দর করে লিখেছেন। হবিগঞ্জের কামিনীকুমার চন্দের (১৮৬২-১৯৩৬) কলকাতায় পড়াকালে ব্রাহ্ম সমাজ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, কিন্তু গ্রহণ করেননি। তাঁর সঙ্গে ঠাকুর পরিবারের সংযোগ ছিল। ১৯০৫ সালে মহর্ষির মহাপ্রয়াণের পর সিলেট, শিলং এবং শিলচরের ব্রাহ্ম সমাজ বিশেষ প্রার্থনা ও উপাসনা করে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করেছিল। মহর্ষি বিহীন পরিবেশে সিলেটি ব্রাহ্মরা রবীন্দ্রনাথের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে পূর্বাঞ্চলের ব্রাহ্ম মন্দিরে ‘রবি ঠাকুরের ব্রাহ্ম সঙ্গীত’ গাওয়ার প্রচলন ছিল।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আধুনিক শিক্ষা ও নারী শিক্ষার প্রসার, সমাজ সংস্কার ও বিকাশে ‘শ্রীহট্ট ব্রহ্ম সমাজ’-এর অবদান অতুলনীয়। ব্রাহ্মসমাজ, শ্রীহট্ট সম্মিলনী ও মিশনারিদের প্রচার ও কার্যক্রমের ফলে ত্রিশের দশকে সিলেটে শিক্ষার প্রসার ঘটে এবং সমাজ অনেকদূর এগিয়ে যায়। শহরে ছোঁয়াছুঁয়ি, অস্পৃশ্যতা কমে আসে। হিন্দু সমাজেও আসে বিশাল পরিবর্তন। ব্রাহ্মদের নারী স্বাধীনতার ফলে নারী আচার কমে আসে। তবে ব্রাহ্মদের কার্যকলাপ কেবল শহরে একটা শিক্ষিত সমাজের মধ্যে ঘুরপাক করতে থাকায় সর্বত্রগামী হতে পারেনি। তবুও একটা যুগসৃষ্টিতে ব্রাহ্মদের অবদান আকাশস্পর্শী। এপ্রসঙ্গে ইফফাৎ জাহানের মূল্যায়ন প্রণিধানযোগ্য :‘উনিশ শতকের আট-এর দশকে সিলেটের ব্রাহ্ম সমাজ ছিল খুবই শক্তিশালী এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত।’ বলতে হয় তারাই সিলেটের রক্ষণশীলতার দুর্গে আঘাত দিয়ে পুরানো সমাজকে নতুনভাবে পুনর্গঠন করতে প্রয়াসী হয়েছিল যার ফল এখন সমাজ ভোগ করছে।

গ্রন্থপঞ্জি
১. বিপিনচন্দ্র পাল, সত্তর বছর, বিপিন পাল ইন্সটিটিউট, কলকাতা, ১৯৫৪।
২. শারদামঞ্জরী দত্ত, মহাযাত্রার পথে, কলকাতা, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ।
৩. ব্রজেন্দ্রনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সংবাদপত্রে সেকালের কথা, দ্বিতীয় খণ্ড [১৮৩০-১৮৪০], বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, পঞ্চম, মুদ্রণ, ১৪০১ বঙ্গাব্দ।
৪. মিজান রহমান [সম্পাদিত] কামিনী রায় রচনা সংগ্রহ, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৭।
৫. ইফফাৎ জাহান, সিলেটের অর্থনীতি ও সমাজ, উৎস প্রকাশন, ২০১০।
৬. উষারঞ্জন ভট্টাচার্য, স্মরি বিস্ময়ে, সিগনেট প্রেস, কলকাতা, ২০১৮
৭. দীপংকর মোহান্ত, আধুনিকতার অভিঘাত ও শ্রীভূমির নারী জাগরণ (১৯৭৬-১৯৪৭), সাহিত্য প্রকাশ, ২০১৮

অন্যান্য
১. শ্রীহট্ট ব্রাহ্ম মন্দিরের ভূমির দলিল [নকল], ১৮৯৬।
২. শ্রীহট্ট ব্রহ্ম সমাজের নিয়মাবলী, ১৯৪৬।
৩. শ্রীহট্ট-আসামে ঠাকুর পরিবারের তিন প্রজন্মের সেতুবন্ধন [প্রবন্ধ; দীপংকর মোহান্ত, সিলেট মিরর, সম্পাদক: আহমেদ নূর, শারদীয় সংখ্যা, ২০১৯।

[লেখাটি সিলেটে রবীন্দ্র-আগমনের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে মোস্তাক আহমাদ দীন ও শ্রীহট্ট সমাজ থেকে প্রকাশিত 'পূর্বাপর' থেকে সংগৃহীত। ৫ নভেম্বর (মঙ্গলবার) এই প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচন করা হবে।]

  • দীপংকর মোহান্ত: লেখক, গবেষক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত