মুঈদ রহমান

০৯ নভেম্বর, ২০১৯ ২২:১৯

জাবিতে দেড় কোটি টাকার ‘গণঅভ্যুত্থান’!

গত ৫ নভেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) ভিসি অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের ওপর সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন হামলা চালায়। এতে করে ৮ জন শিক্ষক ও ৩৫ জন শিক্ষার্থী আহত হন। সারা দেশের বিবেকবান মানুষ এ হামলার তীব্র নিন্দা করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি নিজেও লজ্জাবোধ করছি।

জাহাঙ্গীরনগরের মাটি ও সুবাতাস এখনো আমার মনকে আলোড়িত করে। তাই আমরা যারা জাবিয়ান (জাবি’র প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থী), তারা জাহাঙ্গীরনগরের যে কোন কলুষিত চিত্র দেখলে দারুণভাবে মর্মাহত হই। বেদনা থেকে জন্ম নেয় ক্ষোভের। কিন্তু ভিসি যেহেতু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নন, তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন অঘটন তার মনকে পীড়িত করে না, বিচলিত করে না। যে কারণে তিনি ওই ন্যক্কারজনক আক্রমণকে অত্যন্ত জোরালোভাবে এবং অত্যন্ত সাবলীলভাবে ‘গণঅভ্যুত্থান’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

’৬৯’র গণঅভ্যুত্থানের সময়ে আমি ৫ বছরের শিশু, তাই তা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়নি। সেই গণঅভ্যুত্থানের মহাত্ম্যের কথা বইপত্র ও প্রচার মাধ্যমের সহায়তায় জানতে পেরেছি, অভ্যুত্থানকারীদের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এসেছে। কিন্তু আজকের ভিসি একটি সংগঠিত ‘গুণ্ডামি’কে ‘গণঅভ্যুত্থান’ আখ্যা দিয়ে ’৬৯’র গণঅভ্যুত্থানের মর্যাদাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন। সঙ্গত কারণেই অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম ভিসি পদে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। আমরা তার পদত্যাগ না, অপসারণ দাবি করছি আর তার সাথে সমস্ত অপকর্মের বিচার দাবি করছি। এখানে বলে রাখা ভালো যে, গেল ঈদে জাবি ছাত্রলীগ শাখাকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকার ‘ঈদ-সেলামি’ দেবার খবর গণমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সমালোচকেরা মনে করেন আন্দোলনকারীদের ওপর নগ্ন হামলা করে ছাত্রলীগ তাদের দায় শোধ করেছে মাত্র।

বর্তমান সময়ে একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অসন্তোষ চলছে। অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি আর নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠছে অহরহই। সে তুলনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাটি কিছুটা ভিন্নতর। প্রায় ১৫০০ কোটি টাকার মেগা-প্রকল্পকে ঘিরেই এখানকার জল ঘোলা হওয়া শুরু হয়েছে। এখন অনেক তোষামোদকারীই বলছেন, একটি কুচক্রী মহল ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে’। আমি এ কথার সাথে দ্বিমত পোষণ না করেও বলতে পারি, মাছ শিকারতো দ্বিতীয় পর্যায়। কিন্তু প্রাথমিকভাবে জলটা ঘোলা করলো কে? তিনি অবশ্যই জাবি ভিসি। তিনি সমস্যার সমাধান না করে, সমস্যাকে জিইয়ে রেখেছেন। এবং তারই ধারাবাহিকতায় ওনার স্বামী-সন্তানরাও আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে গেছেন।

গত ২৮ মে একটি গৃহনির্মাণ প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে দরপত্রের শিডিউল ছিনতাইয়ের অভিযোগ আনে। প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো সে সময়ই ছিনতাইয়ের ঘটনা তদন্তের দাবি তোলে। কিন্তু প্রশাসন থেকে কোন প্রকার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। কমিশনের বিপরীতে কোন একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতেই এই ‘শিডিউল ছিনতাই’। প্রাথমিকভাবে আরও অভিযোগ ওঠে যে, প্রকল্পের টাকা তড়িঘড়ি করে খরচ করতে গিয়ে ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য বিনষ্ট করে তা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে প্রশাসন। তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত বাদ-প্রতিবাদ শুরু হয় জুলাইর শুরু থেকে। ৮ জুলাই ছাত্র -শিক্ষকরা সম্মিলিতভাবে ভিসি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে। তেমন কোন জটিল বা সমাধানের বাইরে কোন দাবি ছিল না। তাদের দাবির সার কথা ছিল, প্রয়োজন হলে ৩ মাস কাজ বন্ধ রেখে, সবাইকে নিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন কাজ করা। এটা কী এমন দাবি? যদি আপনার স্বচ্ছতা, সততা ও আন্তরিকতার অভাব না থাকে, তাহলে সবার মতামত নিয়ে কাজ করলে ক্ষতি কী? কিন্তু না, যেহেতু স্বচ্ছতা, সততা আর আন্তরিকতার অভাব রয়েছে তাই ভিসি ওপথ মাড়ালেন না। সবার গায়ে ‘উন্নয়নবিরোধী’র তকমা লাগিয়ে দিলেন, যেটা আজকের জাতীয় রাজনীতির চরিত্র ও সংস্কৃতি। সকলের মতামতকে উপেক্ষা করে ২৩ আগস্ট শুরু হয় গাছ কেটে হল নির্মাণ। এ সময়েই জাতীয় দৈনিকগুলোতে খবর প্রকাশিত হয় - প্রকল্প থেকে ২ কোটি টাকা ছাত্রলীগকে দেয়া হয়েছে। প্রকাশিত সংবাদ কতোখানি সঠিক ছিল তা প্রকাশকই বলতে পারেন। কিন্তু বিষয়টি তদন্ত করে দেখার দাবিতো যে কোন শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ করতেই পারেন। তাছাড়া ভিসি ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “আমি শুনেছি কোম্পানি ছাত্রলীগকে ২ কোটি টাকা দিবে, এখন নাকি ১ কোটি টাকা দিতে চায়”। সঙ্গত কারণেই শিক্ষার্থীরা ভিসির কাছে এ বিষয়ে তদন্তের দাবি তোলে।

৮ সেপ্টেম্বর আন্দোলনরত এক শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগের ছেলেরা মারধর করলে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে। এর প্রেক্ষিতে ১২ সেপ্টেম্বর প্রশাসনের সাথে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মাস্টারপ্ল্যান পুনঃবিন্যাস করার যৌক্তিক দাবি মেনে নিলেও দুর্নীতি তদন্তের ব্যাপারে আইনজ্ঞের পরামর্শের কথা বলে ৩ কার্য দিবস সময় নেয়া হয় এবং বৈঠকের পরবর্তী তারিখ নির্ধারিত হয় ১৮ সেপ্টেম্বর। এর ভেতরই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি-সম্পাদকের সাথে ভিসির কথোপকথন, পার্সেন্টেজ, চাঁদা ইত্যাদি অপ্রীতিকর ঘটনা প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সভায় ভিসি দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত করার দাবিটি উপেক্ষা করেন। উনি যদি স্বচ্ছ হতেন তাহলে তদন্তে দ্বিধা করতেন না। সবাই তাই ধরে নিয়েছেন যে, ‘ডাল মে কুচ কালা হায়’। যার প্রেক্ষিতে পরবর্তী সময়ে ওনার স্বামী এবং ছেলের নাম জড়িয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের সামনে আর কোন পথ খোলা রাখলেন না ফারজানা ইসলাম। প্রথমে পদত্যাগ ও ২ অক্টোবর থেকে ভিসি অপসারণের দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ২৭ অক্টোবর থেকে আন্দোলন ধর্মঘটে রূপ লাভ করে এবং তার চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে গত ৫ নভেম্বর আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগ কর্মীরা ন্যক্কারজনক হামলা চালায়। আন্দোলনের ভয়ে প্রশাসন অনির্দিষ্টকালের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে। কোন রকমের প্রস্তুতি ছাড়াই শিক্ষার্থীরা হল ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এতো হুমকি-ধমকির পরও আন্দোলনরত অনেকেই হল ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এতোটাই নির্মম ও মরিয়া হয়ে উঠেছিল যে, শিক্ষার্থীরা যেন খেতে না পায়, সে জন্যে সকল খাবারের দোকান বন্ধ করে দেয়। এর নাম ক্যাম্পাস! এর নাম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান!!

যে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাণ ও সৌন্দর্য হলো সে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। সেই শিক্ষার্থীদের টেনে-হেঁচড়ে বের করে দিয়ে একটা পুলিশি ক্যাম্পাসের ভিসি হয়ে ফারজানা ইসলাম কতদিন টিকে থাকবেন সেটাই এখন দেখার বিষয়। অবশ্য আমরা জানি ওনার ‘খুঁটির’ অনেক জোর। তবে একথাও মাথায় রাখতে হবে যে কেবলমাত্র সরকারের প্রশ্নাতীত সমর্থন নিয়ে ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা যায় না। একটি ভালো ও উন্নত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে চাই গোটা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের আন্তরিক সহযোগিতা। সেক্ষেত্রে যে কোন ধরনের দমন-নিপীড়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারে, যা করার কোন অধিকার ফারজানা ইসলামের নেই।

ভিসি মহোদয়ের মনে রাখা প্রয়োজন যে, আপনি যদি শিক্ষার্থীদের কাছে আত্মসম্মান বজায় রাখতে না পারেন তাহলে সামান্য ভিসি পদ আপনার আত্মসম্মান ফিরিয়ে দিতে পারবে না। সেই আত্মসম্মানবোধ নেই বলেই বর্তমানকালের ভিসিরা শত নিন্দের পরেও পদত্যাগ করেন না। একটিবারের জন্যেও নিজেকে প্রশ্ন করেন না যে, দোষ-ত্রুটি থাক বা না থাক, আমি যাদের ভিসি তারাই যদি আমাকে না চায় তাহলে আমি কেন সে পদে থাকতে যাবো? কেন সে পদ আঁকড়ে থাকবো? তারপরও আমাদের ভিসিরা সে পদ আঁকড়ে থাকেন। দায়িত্ব শেষে যখন আবার শিক্ষকতায় ফিরে আসেন, ততদিনে মর্যাদা মাটিতে মিশে সারা। জোর করে সম্মান আদায়ের চেষ্টা কোনকালেই সফলতার মুখ দেখে না।

ভিসিরা পদত্যাগ করেন না কেন, এমনতর প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন আমেরিকার ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইসড অধ্যাপক আলী রিয়াজ। তার মতে, “আর নিয়োগদাতারা উপাচার্যদের পদত্যাগকে রাজনৈতিক পরাজয় বিবেচনা করেন বলেই যে কোন মূল্যে তাদের টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে তাদের কোন দ্বিধা নেই।” গত বৃহস্পতিবার আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যে আমরা তারই প্রমাণ পাই। তিনি পরিষ্কারভাবেই বলেছেন যে, আন্দোলনকারীরা অভিযোগের প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হলে তাদেরকে বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরা তার বক্তব্যে হতাশ হয়েছি। ’৫২, ’৬৬, ’৬৯ এবং বাংলাদেশের ’৯০’র আন্দোলনে কেউ প্রমাণ নিয়ে মাঠে নামেনি। কোন অসন্তোষেই হাতে প্রমাণ থাকে না। প্রমাণের বিষয়টি আদালতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য ভিসি ফারজানা ইসলামকে আরও স্বেচ্ছাচারী হবার সুযোগ তৈরি করে দেবে; সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনকে আরও বেশি মারমুখী হতে উৎসাহ জোগাবে এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও বেশি বেপরোয়া করে তুলবে। এসবের কোনটিই ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক হবে না।

ভিসির গদি অটুট রাখার জন্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আজ শিক্ষার্থীশূন্য। এ ক্যাম্পাস কি কোনদিনই খুলবে না? এই শিক্ষার্থীরাই কি আবারো পূর্ণোদ্দমে তাদের প্রাণপ্রিয় ক্যাম্পাসে ফিরে আসবে না? সেদিন পিছুটানহীন তরুণ প্রজন্ম কি ভিসি পদে কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিত্বকে মেনে নেবে? যদি না নেয় তাহলে কি আবারও ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেওয়া হবে? এসব প্রশ্নের যৌক্তিক সমাধান খুঁজতে হবে। এবং সে ক্ষেত্রে ভিসির অপসারণই হতে পারে একমাত্র সমাধান। তা না হলে আরেকটি উত্তপ্ত ক্যাম্পাসের জন্যে তৈরি থাকতে হবে যা ১৬ হাজার শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেবে।

  • মুঈদ রহমান: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
  • প্রকাশিত লেখায় মত, মন্তব্য, বিশ্লেষণ লেখকের নিজস্ব, এখানে সিলেটটুডের সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নাও প্রকাশ পেতে পারে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত