মেহেদি হাসান তন্ময়

১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ১৭:৫৮

শিক্ষায় ভ্যাট: প্রতিবাদ হোক, প্রতিরোধ হোক

শিক্ষা পণ্য নয়, শিক্ষায় ভ্যাট নয়- দাবিতে উত্তাল দেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ সারা দেশ। শিক্ষার্থীদের ভ্যাটবিরোধী চলমান আন্দোলন সম্পর্কে লিখেছেন ঢাকা কলেজের সমাজবিজ্ঞান (সম্মান) বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদি হাসান তন্ময়

শিক্ষা মানবজাতির সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। শিক্ষার মাঝেই সকল উন্নয়নের অস্তিত্ব বিদিত। স্তরে স্তরে প্রাথমিক শিক্ষার নদীর তটমূল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে মেশে সাগরের মোহনায়।

আমাদের মতো দেশে যেখানে ৩৯% মানুষ অশিক্ষিত সেখানে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া প্রাণ রক্ষার মতো অবশ্যপালনীয়। কিন্তু সরকারী ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর তুলনায় অপ্রতুল। এখানে এত আসন নেই যে সব শিক্ষার্থীর স্থান সংকুলান হবে। সেক্ষত্রে দেশের একমাত্র অবলম্বন হলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।

সাধারণত মোটামুটি যারা সচ্ছল তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হয়। তবে অনেক মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা নেহাৎই কম নয়। মূলত অধিকাংশ শিক্ষার্থী এরাই।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মূলত টাকার বিনিময়ে শিক্ষা দেয়া হয়। যেখানে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর সঠিকভাবে অর্থ পরিশোধ করে পড়াশোনা শেষ করা রীতিমত দিবাস্বপ্নের মতো। সেখানে সরকারের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার উপর ৭.৫% ভ্যাট আরোপ বিনা মেঘে বজ্রপাতের ন্যায়। বেসরকারি খাতে শিক্ষাটা হয় টাকার জোরে, চাকুরী হয় মামার জোরে। সার্টিফিকেটধারী অশিক্ষিত আগাছায় দেশটা ভরে উঠেছে।

মুখস্তবিদ্যার কুচক্র ভেঙ্গে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার প্রথম শর্ত হবে অবাধ শিক্ষাব্যবস্থা। সেখান যার যা খুশি পড়তে ও জানতে পারবে। কিন্তু প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় শিক্ষা ব্যবহৃত হচ্ছে পণ্য হিসেবে। কতিপয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিলাসী জীবনযাপনের হাতিয়ার হিসেবে। কেননা, শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা সবচেয়ে নিরাপদ এবং সুলভ্য ব্যবসা। যেখানে সরকারের উচিত শিক্ষা খাতে আরো গুরুত্ব দিয়ে দেখা। বেশি করে অর্থ বরাদ্দ রাখা এবং দর্শনগত ভিত্তিকে জাগ্রত রাখা। সেখানে শিক্ষার উপর প্রযোজ্য হচ্ছে ভ্যাট!

বিদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালগুলো যখন সরকারের প্রচুর সহায়তা পাচ্ছে তখন বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর অনৈতিকভাবে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে ভ্যাট! তবে কি এটাও 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' প্রকল্পের একটা অধ্যায়? কি জানি! দেশের সরকার কাকে 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' বলে!

দেশের এই সময়ে 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' এবং 'টাল বাংলাদেশ' এর তফাত কতখানি? কিংবা কতখানি মিল? যারা শিক্ষার উপর ভ্যাট চালু করছে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায়। অথচ তারাই মন্ত্রীপরিষদের সন্মানিত সদস্য! তারাই দেশের ত্রাণকর্তা! তারা সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে কি? উত্তরটা বোকা শিশুও জানে।

বেসরকারি শিক্ষার উপর আরোপিত ৭.৫% ভ্যাট সরকার প্রবর্তিত উন্নয়ন জোয়ারে ঠিক কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে? যেখানে মহামান্য অর্থমন্ত্রীর কাছে হলমার্ক দুর্নীতির ৪০০০ কোটি টাকা কোনো টাকাই মনে হয় না। অথচ সেদেশেই মাত্র ১০০ টাকার জন্য মানুষ খুন হয়! যেখানে সামান্য এয়ারপোর্টের নাম পরিবর্তনের জন্য হাজার বারোশ’ কোটি টাকা খরচ করা হয়। তখন সেদেশে শিক্ষার উপর ভ্যাট আরোপ কোন ধরণের ছেলেমানুষি? নামটা কি উন্নয়নের চেয়ে বড়? উন্নয়ন কি শিক্ষার চেয়ে বড়?

রাষ্ট্রের সকল নাগরিক যদি সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয় তবে উন্নয়ন এবং শান্তি উভয়ের আগমন নিশ্চিত। এনবিআর বলেছে, "শিক্ষার্থী নয়, ভ্যাট দেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।" একথা শোনার পর হাসতে হবে? নাকি কাঁদতে হবে? ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা, দো-টানায় পড়ে যাই। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টাকা পাবে কোথায়? শিক্ষার্থীদের কাছে থেকেই নেবে! মানে হলো ভাতের নলা মাথার পেছন দিয়ে ঘুরিয়ে এনে খাওয়া! স্রেফ ভাঁওতাবাজি, স্রেফ প্রতারণা। কোর্স ফি, সেমিস্টার ফি বাড়িয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে থেকে এই টাকা হারে হারে আদায় করবে। মানে সাপও মরলো, লাঠিও ভাঙ্গলো না। তখন সরকার উচু গলায় বলবে, "এটা তো আমরা করিনি!" এটা অদ্ভুত নয়, খুব সত্য। রথও দেখলাম, কলাও বেচা হলো ধরণের ব্যাপার।

শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদী হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এ ধরণের অন্যায় ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তারা যখন একত্রিত হয়েছে এবং প্রতিবাদ শুরু করেছে তখন এটা আশা করা যায়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর সরকার ও মিডিয়ার নজরদারি বাড়বে। এতে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার দুর্নীতি কিছুটা হলেও কমবে বলে আশা করা যায়। আন্দোলন একটি সুস্থ রাষ্ট্র গঠনের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয়। ডিজুস, ইয়ো-ইয়ো কিংবা লুল প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা যখন অধিকার আদায়ে রাজপথে নেমে যায় তখন রাষ্ট্রের বুকে যেন পদ্মফুল ফুটে ওঠে।

রাষ্ট্র যখন ভুগছে অশিক্ষায়, সাম্প্রদায়িকতায়, জঙ্গীবাদে। তখন রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের সুশিক্ষা অতীব জরুরী। প্রয়োজন সুস্থ ও প্রতিবাদী রাজনৈতিক আদর্শের। যেটা বর্তমানে এদেশের একদমই নেই। যা আছে, কিছু মৃত মানুষ নিয়ে বিলবোর্ড, বিজ্ঞাপন, প্রচারণা। অথবা তার আদর্শকে মেরে, পুঁতে ফেলার নীলনকশা।

যখন জাতির পিতার নাম নিয়ে একটি যৌক্তিক আন্দোলনে হামলা হচ্ছে, যখন 'জয় বাংলা' বলে হামলা করা হচ্ছে তখন পঁচিয়ে দেয়া আদর্শের বড়াই করাও যেতে পারেনা। যখন একজন তরুণ তার দেশাত্মবোধক চেতনা ও শক্তি দেশের সঠিক কাজে লাগাতে পারবে না তখন সে শক্তিটা অকাজে ব্যয় করবে। তখন তারা হয়ে ওঠে সন্ত্রাসী কিংবা জঙ্গী। যেখানে আছে শুধুই রাষ্ট্র ও সমাজের ধ্বংস। কিন্তু সবাই একত্রে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথে নামবে তখন ঘটবে তারুণ্যের সঠিক বহিঃপ্রকাশ। তখন বুকচিরে বেরুবে বিদ্রোহ, শ্লোগান, মিছিল। তখন তাদের দিয়েই হবে দেশ ও সমাজের পরিবর্তন।

বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে শিক্ষার উপর ভ্যাট আরোপের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে, সে একই রকম আন্দোলন যদি প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি ও বেতনাদি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে করতো তবে শিক্ষাব্যবস্থা এতটা ব্যবসায়িক হয়ে উঠতো না। তখন সরকার শিক্ষার উপর ভ্যাট আরোপ করার এই দুঃসাহস করতো না।

আমি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাধুবাদ এবং শুভকামনা জানাই। তারা শিক্ষার উপর এই ফ্যাসিবাদী ভ্যাটের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। পুলিশশাসিত সরকারের বিরুদ্ধে বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিরোধ হোক যার যার স্ব-অবস্থান থেকে।

শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার এখানে কোনো ভ্যাট প্রকার চলতে পারেনা। তরুণ, তরুণী! আজ দেখিয়ে দাও শিক্ষার্থীদের প্রকৃত ক্ষমতা। হৃদয়ের গভীর থেকে নিঙড়ে বের করে আনো তারুণ্য, ক্ষোভ, বিদ্রোহ। মুখ থুবড়ে পড়া রাষ্ট্রকে চাঙা করে তোলো।

যে রাষ্ট্র আমাদের জননী, যে রাষ্ট্র আমাদের মা। সে তো অনন্ত যৌবনা, মায়ের কাছে সন্তানের শিক্ষার জন্য কোনো ভ্যাট লাগেনা। ফ্যাটবাবার শিক্ষাভ্যাটে সজোরে ব্যাট মারো, ভ্যাট, শিক্ষা গ্যালারির ওপারে গিয়ে কালোবাজারের বুকচিরে ছক্কা হোক।

শিক্ষায় ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনের জয় হোক।
জয় হোক শিক্ষার, জয় হোক জনতার।
জয়তু বাংলাদেশ।।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত