মোহাম্মদ দিদার

২৮ নভেম্বর, ২০১৯ ০৪:০৯

‘সরকারি উপাচার্য’ আখ্যান

১৯৭৩ এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেন। মূলত কথা ছিলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের লেজুড়বৃত্তি করবে না। এক সময় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে জনগণের ক্যান্টনমেন্ট বলা হতো, রাষ্ট্রের জনগণের টাকায় পড়াশুনা করে রাষ্ট্রের সংকটময় সময়ে জনগণের পাশে দাঁড়াবে। দলমতের ঊর্ধ্বে গিয়ে জাতীয় স্বার্থ নিয়ে কাজ করবে। কিন্তু এখন দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ পাচ্ছেন দলীয় যোগ্যতার ভিত্তিতে এবং উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন দলীয় লেজুড়বৃত্তি ও ক্ষমতাসীনদের তোষামোদ করে গদিতে টিকে থাকতে চান। এর একটি প্রমাণ পাওয়া যায় জাবি উপাচার্যের ''যিনি আমাকে বসিয়েছেন তিনি চাইলে সরে যাব, নয়তো গালি খেয়েও থাকবো'' এই বাক্যটির মধ্য দিয়ে। বাক্যটি চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারের বহিঃপ্রকাশ। কোন দলের দাসত্ব, ক্ষমতার লেজুড়বৃত্তি, তোষামোদ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন খর্ব করার পাশাপাশি ভয়ানক সংকটের মধ্যে ফেলে দেয়।

মূলত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠার মূল কারণ এটি। উপাচার্যরা মনে করেন ক্ষমতার ভিত্তি হচ্ছে সরকার, সরকারের কথা মতো চললেই উপাচার্য পদটি থাকবে। তখন শিক্ষার্থীদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। শিক্ষার্থীদেরও যে মতামত থাকতে পারেরে সেটি পর্যন্ত ভুলে যান।

২৪টি প্রশাসনিক পদে ভারপ্রাপ্ত দিয়ে পরিচালিত প্রশাসন কর্তৃক ৩ বছর ধরে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হলো অথচ এখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথে কোন প্রকার আলোচনা করা হয়নি। শুরু থেকেই আমরা বারবার দাবি জানিয়েছি সকল ছাত্র সংগঠনগুলোর মতামত নিন, সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মতামত নিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে সকলের অংশগ্রহণে একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করুন। উপাচার্য কোন তোয়াক্কাই করেনি। গত কিছুদিন আগে ডেইলি স্টার মারফত জানতে পারা যায় মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন কমিটির প্রধান আহসান উল্লাহ মজুমদার বলেন ''পাবলিক পার্টিসিপেশন নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া ইআইএ করতে চাইলে প্রশাসন বলে ইআইএর প্রয়োজন নেই।'' এর মধ্যদিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ভূলুণ্ঠিত হয় এবং প্রশাসনের স্বৈরাচার ও কাউকে তোয়াক্কা না করার মানসিকতা প্রকাশ পায়।

ই-টেন্ডার করার কথা থাকলেও এনালগ টেন্ডার করা হয়। গত ২৮ মে ছাত্রলীগ কর্তৃক দরপত্রের শিডিউল ছিনতাইয়ের অভিযোগ করে একটি গৃহনির্মাণ কোম্পানি। তখনই মূলত আমরা জানতে পারি মাস্টারপ্ল্যানের কাজ শুরু হয়েছে। আমরা শিডিউল ছিনতাইয়ের তদন্ত করতে বললেই কোন প্রকার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে পরিষ্কার হলো কমিশন খেয়ে নির্দিষ্ট কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দিতেই পরিকল্পিত শিডিউল ছিনতাই। জড়িত শাখা ছাত্রলীগ, আর কোম্পানি নির্দিষ্ট করে উপাচার্যের স্বামী, সন্তান, উপাচার্যের সচিব, এবং পিডি। আর সকল কিছু হয়েছে উপাচার্যের সম্মতিতে। ক্যাম্পাসের সুন্দরতম জায়গায় প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে যত্রতত্র ভবন নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানতে পারি। আমরা জানতে পারি একটি ৫ তলা ভবনের ৩ পাড় ঘিরে ৩টি ১০তলা বিল্ডিং হবে। তখন আমাদের কাছে পরিষ্কার হয় তড়িঘড়ি করে অপরিকল্পিতভাবে জনগণে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে।

সর্বপ্রথম আমাদের সম্মিলিত প্রয়াস ৮ জুলাই শিক্ষক শিক্ষার্থী ঐক্য মঞ্চের পক্ষ থেকে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। উপস্থিত ছিলো সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট এবং শিক্ষক মঞ্চ। পরবর্তীতে যুক্ত হয় বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদ। দাবি ছিলো স্পষ্ট অপরিকল্পিতভাবে হল নির্মাণ বন্ধ করে অংশীজন সকলের মতামত নিয়ে হল নির্মাণের স্থান পুনঃনির্ধারণ করতে হবে। বলেছিলাম সকলের মতামত নিয়ে সর্বোচ্চ সুন্দর বিকল্প স্থান বাছাই করা হোক যাতে করে কম পরিমাণে প্রকৃতি ধ্বংস হয়। তখন থেকেই আমাদের উন্নয়ন বিরোধী, উন্নয়নে বাধাদানকারী আখ্যা দিতে থাকে।

আমরা বলেছিলাম ৩ মাস সকল কাজ স্থগিত রেখে সকল অংশীজনের মতামত নিয়ে পুনরায় উন্নয়ন কাজ শুরু করা হোক। সকলের মতামতকে উপেক্ষা করে ২৩ আগস্ট গাছ কেটে হল নির্মাণ শুরু হয়। বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত হয় উন্নয়ন প্রকল্প থেকে ছাত্রলীগকে ২ কোটি টাকা ভাগ করে দেওয়ার সংবাদ। মাস্টারপ্ল্যান পুনর্বিন্যাস্ত করার দাবির সঙ্গে যুক্ত হয় ২ কোটি টাকার দুর্নীতির বিচার বিভাগীয় তদন্ত। আমাদের জায়গা ছিলো যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের গায়ে কালিমা যুক্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী হিসাবে উচিত হবে তদন্তের মুখোমুখি হয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। পরবর্তীতে ডেইলি স্টারের প্রথম পাতায় ২ কোটি টাকা ভাগের বিস্তারিত প্রতিবেদন। এবং ঢাকা ট্রিবিউনে উপাচার্যের বক্তব্য : ''আমি শুনেছি কোম্পানি ছাত্রলীগকে ২ কোটি টাকা দিবে, এখন নাকি ১ কোটি দিতে চায়।'' সকল কিছু তদন্তের দাবিকে আরও জোরালো করে।

টানা ৬ দিন প্রশাসনিক ভবন অবরোধের পর ৮ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টায় মিটিং করতে যাওয়ার কালে আন্দোলনরত এক শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগ নেতা মারধর করে। শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করলে বিচারের আশ্বাস দিয়ে ১২ সেপ্টেম্বর মিটিং নির্ধারণ করা হয়। ১২ সেপ্টেম্বর প্রশাসনের সাথে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। আন্দোলনে চাপে এবং দাবির যৌক্তিকতার জন্য মাস্টারপ্ল্যান পুনর্বিন্যস্ত করার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু দুর্নীতির তদন্তের ব্যাপারে আইনজ্ঞদের সাথে পরামর্শের জন্য ৩ কার্যদিবস সময় নেন। পরবর্তী বৈঠক ১৮ সেপ্টেম্বর নির্ধারিত হয়। এর মাঝখানে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্য, উপাচার্যের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, শাখা ছাত্রলীগের (যারা টাকার ভাগ পেয়েছে) পরিষ্কার স্বীকারোক্তি তদন্তের দাবিকে আরও জোরদার করে। পরবর্তী মিটিংয়ে উপাচার্য তদন্ত করতে অস্বীকৃত জানান, কোন সুযোগ নাই বলে উড়িয়ে দেন। সেইদিনই আমরা শিডিউল ছিনতাইয়ের তদন্ত না করা, আন্দোলনকারীদের মারধরের বিচার না করা এবং পত্র-পত্রিকার সংবাদ ও স্বীকারোক্তির মধ্যদিয়ে দুর্নীতির বিষয়টি প্রমাণিত হয়েও তদন্ত করতে অস্বীকৃতি জানলে আমরা উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করি।

আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাই। সসম্মানে পদত্যাগ না করায় ২ অক্টোবর অপসারণের দাবি করি। ২৭ অক্টোবর থেকে সর্বাত্মক ধর্মঘট সফল হতে থাকলে উপাচার্যপন্থীরা ক্লাস পরীক্ষা বাড়িয়ে দেয়। এবং অন্যদিকে চলতে থাকে অব্যাহতভাবে আক্রমণ। ছাত্রলীগ কর্তৃক আন্দোলনকারীদের হুমকি, বিভিন্ন অপপ্রচার, শিবির ব্লেইম, উন্নয়নবিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী, পরবর্তীতে সহকারী প্রক্টরের নেতৃত্বে হামলা, আন্দোলনকারী ৫০/৫০ জনের বিরুদ্ধে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষক শিক্ষার্থী যখন উপাচার্যের বাসভবন অবরোধ করে তখন উপাচার্যের সর্বশেষ অস্ত্র যাদেরকে ২ কোটি টাকা ভাগ করে দিয়েছেন তাদের দিয়ে আন্দোলনে হামলা করেন। এতে ৫ জন শিক্ষকসহ আহত হয় ৫০। প্রথমে সরকারের জিইয়ে রাখা অস্ত্র জামাত-শিবির তকমা দিয়ে আন্দোলনকে দমানোর চেষ্টা করে। পরে শিবির পিটাও বলে আন্দোলনে হামলা করে ছাত্রলীগ। আহত হয় ৭ জন শিক্ষকসহ ৩৫ জন। প্রতিবাদে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সহ ৪ জনের পদত্যাগ করেন। করে দেয় হল ভ্যাকেন্ট। এইখানে অগণতান্ত্রিক আচরণ, শিক্ষার্থীরা হল ভ্যাকেন্ট চায় কিনা জানতে চাওয়া হলো না। যিনি আন্দোলন করার তিনি করবেন। যিনি চাইবেন না তিনি আন্দোলনে আসবে না কিন্তু হল ভ্যাকেন্টের তো কোন প্রশ্ন নাই এইখানে। মূলত আন্দোলন দমন করতেই এই আয়োজন। সবকিছু উপেক্ষা করে চলতে থাকে আন্দোলন।

উপাচার্য সকল প্রকার গ্রহণযোগ্যতা, নৈতিকতা, সবকিছু হারিয়েছেন। পদের মোহে সকল কিছু করতে পারেন এখন তিনি। তাকে অপসারণই সংকট সমাধানের একমাত্র উপায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ভালো রাখতে হলে দলীয় লেজুড়বৃত্তির বাইরে গিয়ে উপাচার্য নির্বাচন করতে হবে।

  • মোহাম্মদ দিদার: সাধারণ সম্পাদক, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, জাবি; সংগঠক, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর।
  • প্রকাশিত লেখায় মত, মন্তব্য, বিশ্লেষণ লেখকের নিজস্ব, এখানে সিলেটটুডের সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নাও প্রকাশ পেতে পারে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত