অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল

১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯ ১৯:৪১

জাতিকে মেধাশূন্য করার নীল নকশা বাস্তবায়নেই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা

আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী, তাদের সামরিক বাহিনী ও এদেশে তাদের দোসর এবং কিছু কুলাঙ্গারের মানবতাবিরোধী ও অন্যায্য একটি যুদ্ধে যখন আনুষ্ঠানিক পরাজয়বরণের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসছিল তখনই তারা বাঙালী জাতির কৃতিসন্তানদের হত্যা করে। যখন পাকিস্তানী শাসকরা ও তাদের এদেশীয় দোসর আলবদর, আলশামস বুঝে উঠতে পারছিল যে তারা ইতিহাসের চরমতম অন্যায্য যুদ্ধে নিশ্চিত পরাজিত হচ্ছে, তখনই তারা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ যাতে বিশ্বে দরবারে মাথা উঁচু করে না দাড়াতে পারে সেইজন্য জাতির কৃতিসন্তানদের হত্যা করে।

চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র দু’দিন পূর্বে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করায় স্বাধীনতা লাভের পর এদিনটিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণের পর থেকেই সারাদেশে নিরীহ বাঙ্গালীদের পাশাপাশি শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও শিল্পীদের হত্যা করতে থাকে।

এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাপিডিয়া থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ৪৯জন চিকিৎসক, ৫ জন প্রকৌশলী, ৪২ জন আইনজীবী, ১৩ জন সাংবাদিক, ৯ জন সাহিত্যিক ও শিল্পীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তন্মধ্যে ১৪ ডিসেম্বর কেবল ঢাকা থেকে অন্তত ২শ’ বুদ্ধিজীবীকে রাতের আধারে তাদের বাসাবাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে মিরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে তাদের লাশ ফেলে রেখে যায়। এসব লাশ ১৪ ডিসেম্বর সকাল থেকে ১৯৭২ মধ্য জানুয়ারি পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়।

তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- শহীদুল্লাহ কায়সার (লেখক), মুনীর চৌধুরী (ভাষাবিজ্ঞানী), মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষক), ডাঃ এ এফ এম আবদুল আলীম চৌধুরী, আবুল খায়ের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক), ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা, ড. ফয়জুল মহী (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষক), গিয়াসউদ্দীন আহমদ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক), আ ন ম গোলাম মোস্তফা (দৈনিক পূর্বদেশ-এর সাংবাদিক), আনোয়ার পাশা (কবি, কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ), ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি, সেলিনা পারভীন (সাংবাদিক), সিরাজুল হক খান (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক), এস. এম. এ. রাশীদুল হাসান (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক), সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক)।

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সাথে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী থেকে আমাদের দেশের আল বদর আল শামস জড়িত থাকলেও এর নীলনকশা করেন মুলত পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গভর্নর হাউস (বর্তমান বঙ্গভবন) থেকে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর একটি ডায়েরী উদ্ধার করা হয় যেখানে ১৪ ডিসেম্বর যেসকল বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয় তাদের সবার নাম ছিল। আর তার বাস্তবায়ন করা হয় এদেশীয় দালাল তথা আল বদর আল শামস দিয়ে।

মোট কথা হচ্ছে, পশ্চিম পাকিস্তান কখনই চায়নি আমাদের এ অঞ্চল মাথা উঁচু করে সম্মান নিয়ে সমৃদ্ধি নিয়ে জীবন যাপন করুক। তারা কখনই চায়নি আমাদের অঞ্চল থেকে নেতৃত্ব আসুক। সেজন্যই সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে নির্বাচিত দল আওয়ামী লীগ ও এ জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর হাতে তারা ক্ষমতা দেয়নি। কেবল তাই না এ জাতিকে নির্মূল করতে ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম ও বর্বর গণহত্যা চালায়। কিন্তু বাঙালীরা যখন প্রাণপণ যুদ্ধ করে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন এ জাতিকে মেধাশুন্য করার নীল নকশা বাস্তবায়নেই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা। আর এজন্য আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে থাকা স্বত্বেও আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আজও ঢেলে সাজাতে পারিনি; ভালো একটা স্বাস্থ্যনীতি তৈরি করতে পারিনি; ঔপনিবেশিক প্রশাসন ব্যবস্থার স্থলে একটি স্বাধীন দেশের জন্য যুগোপযোগী প্রশাসন বিনির্মাণ করতে পারেনি। আর এজন্যই আমরা যতই সামনের দিকে এগুতে চাই আবার পিছিয়ে পড়ি। তবে আমরা একটা দিক থেকে অন্তত সফল হয়েছি। তা হলো যারা এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাড়া করেছি; দোষীদের ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়েছি।

লেখকঃ অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত