শওগাত আলী সাগর

২৯ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:২৪

শিশু জিহাদ, মিডিয়ার দায়িত্ববোধ ও আমাদের দুর্যোগ-প্রস্তুতি


২৩ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পর স্বেচ্ছাসেবীরা শিশু জিহাদকে উদ্ধারের পরবর্তী ঘটনাটুকু দেখছিলাম ঢাকার একটি টেলিভিশন চ্যানেলের খবরে। উদোম শরীরের শিশুটিকে বুকের কাছে আগলে ধরে এগুনোর চেষ্টা করছেন ক’জন মানুষ। তাদের ঘিরে আছে অগুণতি ক্যামেরা, শত শত মানুষ।



টেলিভিশনের পর্দায় তাকিয়ে থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসে, এতটা দীর্ঘ সময় অন্ধকার একটা পাইপে আটকে থাকার পর শিশুটির দেহে আর প্রাণ থাকার কথা নয়। তবু, উদ্ধারের পরপরই তাকে চিকিৎসকের হাতে ছেড়ে দেওয়ার কথা। ঘটনাস্থলে চিকিৎসক না থাকলে তাকে দ্রুত নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু উদ্ধারকারীরা এগুতেই পারছিল না, চারপাশে ঘিরে থাকা মানুষ, ক্যামেরার ক্লিক। এমন ভিড়ে একজন সুস্থ বাচ্চারও তো দম বন্ধ হয়ে মারা যাবার কথা!



অটোয়ায় পার্লামেন্ট হিলে সন্ত্রাসী হামলার খবর পেয়েই ছুটে গিয়েছিলেন মিডিয়াকর্মীরা। আন্তর্জাতিক সব মিডিয়ার সাংবাদিক, ক্যামেরা আর টেলিভিশন ক্যামেরা উৎসুক হয়ে পড়েছিল অভাবিত এই ঘটনার খবর সংগ্রহে। কিন্তু বাদ সাধে বেরসিক পুলিশ। মুখের কথায় সাংবাদিকদের সরিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়ে ক্ষুব্ধ পুলিশ কর্মকর্তা অস্ত্র তাক করে ধরেন সাংবাদিকদের দিকে– ‘মুভ’! কঠোর নির্দেশে সরিয়ে দেন তাদের। পার্লামেন্ট ভবনের ভেতর একটি কক্ষে নিয়ে রীতিমতো আটকে রাখা হয় তাদের।



পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে সামনের রাস্তায় ছিলেন একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক। দায়িত্বরত এক পুলিশ কর্মকর্তার সামনে টেলিভিশনের মাইক্রোফোন ধরে ঘটনা সম্পর্কে বক্তব্য চান ওই সাংবাদিক। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা: ‘‘আমি এখানে দায়িত্ব পালন করতে এসেছি। আমার কাজ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, টিভিতে ইন্টারভিউ দেওয়া নয়।’’



তারপরও খানিকটা জোর করেছিলেন ওই সাংবাদিক। পুলিশ কর্মকর্তাটি ‘গেট লস্ট’ বলে চিৎকার করে তাড়িয়ে দেন ওই সাংবাদিককে।


ঢাকার শাহাজাহানপুরে শিশু জিহাদের উদ্ধারকাজের পাশে অবস্থান নেওয়া ঢাকার টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ক্রু বা পত্রিকার সাংবাদিক-ফটো সাংবাদিকদের ‘গেট লস্ট’ বলে তাড়িয়ে দেওয়ার মতো কোনো পুলিশ কর্মকর্তা সেখানে অবশ্যই ছিলেন না। থাকলেও তিনি হয়তো সেটি বলতে পারতেন না। সাহস করে কোনো ‘বেয়াড়া’ পুলিশ কর্মকর্তা ‘গেট লস্ট’ বলে সাংবাদিকদের দিকে তেড়ে গেলে উপায় ছিল না। ওই পুলিশের চাকরি নিয়ে টানাটানি তো শুরু হতই, সরকারের বিরুদ্ধেও মহাআন্দোলন শুরু হয়ে যেত। ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ খর্ব করার অভিযোগে আমাদের সুশীল বুদ্ধিজীবী আর তাদের আন্তর্জাতিক মিত্ররা বিবৃতির সুনামি বইয়ে দিতেন। অথচ বিশ্বের যে কোনো দেশে এটিই সাধারণ চর্চা।



পশ্চিমের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কোনো দুর্ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ হলুদ ফিতা দিয়ে জায়গাটি ঘিরে ফেলে। পুলিশ আর সংশ্লিষ্ট লোকজনের বাইরে সেখানে কারও প্রবেশাধিকার থাকে না। সাংবাদিকদের তো প্রশ্নই আসে না। খবর প্রচারের ক্ষেত্রে সাংবাদিকরাও অবলম্বন করেন অতিমাত্রার সতর্কতা। বাহুল্য তথ্য পরিবেশনের ভয় তো তাদের থাকেই, সবচেয়ে বেশি বিবেচনায় থাকে জনমানসে তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে। ঘটনাটি যদি ভীতিকর কিছু হয়, তাহলে সেটি সাধারণ জনগোষ্ঠীর মনের উপর চাপ তৈরি করতে পারে– এই বিবেচনা নিয়েই মিডিয়া খবর প্রকাশ করে।



শীতের রাতে চিকন একটি পাইপে ছোট্ট এক শিশু আটকে আছে, এর চেয়ে ভয়াবহ দৃশ্য আর কী হতে পারে? অত্যন্ত দৃঢ় মনের মানুষের চিত্তেও খবরটি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করবে। জিহাদের ঘটনাও সেটি করেছে। টেলিভিশনে মুর্হূমুহূ সংবাদ প্রচার আর লাইভ প্রচারণায় সারা দেশের মানুষ সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিল দুর্ঘটনাটির সঙ্গে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে রাত জেগে টিভির সামনে বসে থেকেছেন তারা। টিভি যে কেবল বড়রাই দেখেছেন তা নয়, ছোট্ট ছোট্ট শিশুরাও টিভির খবরে সেই ঘটনার বিবরণ দেখেছে। ঘটনাটি ঘরে ঘরে শিশুদের মনোজগতে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে তা কি আমরা কেউ ভেবে দেখেছি?



আবার অটোয়ার পার্লামেন্ট হিলের ঘটনায় আসি। আমি জানি, বাংলাদেশ আর কানাডাকে পাশাপাশি তূলনা করা বিবেচনার কাজ নয়। কিন্তু কমন সেন্স, মানবিকতাবোধ উন্নত আর অনুন্নত দেশভেদে ভিন্ন রকম হয় না। তাছাড়া ভিনদেশের দুর্যোগ মোকাবেলার উদাহরণগুলো সামনে থাকলে নিজেদের প্রস্তুতিতেও সেটি সহায়ক হয়। কানাডার মিডিয়া ঘটনাটি ফলাও করে প্রচার করেনি, বরং এই খবর প্রচারের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় রক্ষণশীল ছিল ওরা।



এমনকি সিএনএন যখন বেনামি সূত্রের বরাত দিয়ে হামলাকারী ইসলামি জঙ্গি সংগঠন ‘ইসলামিক স্টেট’এর কর্মী বলে ব্রেকিং নিউজ প্রচার করল, তার এক ঘণ্টার মধ্যে কানাডার মিডিয়া হামলাকারীর চৌদ্দগোষ্ঠীর নথিপত্র হাজির করে জানাল যে, হামলাকারীর সঙ্গে ইসলামি জঙ্গিদের সম্পর্ক নেই। কানাডিয়ান সরকারও চেয়েছিল হামলাকারীর সঙ্গে জঙ্গি-সম্পৃক্ততার তথ্যের ভিত্তি দিতে। কিন্তু মিডিয়া সেটি উড়িয়ে দিয়েছে।



পার্লামেন্টে হামলাকারী ‘ইসলামি জঙ্গি’– এই তথ্য প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কানাডার বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত মুসলমানদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। কানাডিয়ান মিডিয়া যে ইসলামি জঙ্গিদের ভালো চোখে দেখে তা কিন্তু নয়। তারা বরং ইসলামি মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের প্রবল বিরোধী। কিন্তু অপ্রমাণিত তথ্যের কারণে মুসলিম জনগোষ্ঠী আতঙ্কে সময় কাটাক, তাদের মধ্যে কোনো ধরনের মানসিক চাপ তৈরি হোক সেটি মিডিয়া চায়নি। এখানেই মিডিয়ার দায়িত্ববোধের প্রশ্ন। কিন্তু শিশু জিহাদের ঘটনার খবর প্রচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মিডিয়া তার পরিচয় দিতে পারেনি।



যে কথা বলছিলাম। অটোয়ায় পার্লামেন্ট ভবনের হামলার ঘটনার পরদিনই দেশজুড়ে প্রত্যেক শিশুর ঘরে তাদের স্কুল থেকে দীর্ঘ চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে পার্লামেন্ট হিলের ঘটনার বিবরণ দিয়ে যে কথাগুলো বলা হয়েছে, সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্কুল থেকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে: ‘‘শিশুরাও কোনো না কোনোভাবে ঘটনাটি জেনেছে, তাদের মনে এ নিয়ে ভীতিকর প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে। সে জন্য স্কুল মনোবিজ্ঞানী এবং সোশ্যাল ওয়ার্কারদের একটি প্যানেল করেছে। শিশুরা কোনো কারণে ভীতসন্ত্রস্ত হয়েছে বা ঘটনা সম্পর্কে বাড়তি কৌতূহল দেখিয়েছে তা জানা গেলে মনোবিজ্ঞানীদের প্যানেল সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছে। একই ব্যবস্থা আছে তাদের বাবা-মায়েদের জন্যও।’’



বাংলাদেশে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের কথা কল্পনা করাও কঠিন। শিশু জিহাদের ঘটনায় কোন শিশুর মনে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা ভাবার মতো মানসিক অবস্থানে আমরা নিজেরাই পৌঁছুতে পারিনি। ঘটনাটি শিশুদের কেন, বয়স্কদেরই-বা কতটা মানসিক চাপে ফেলেছে, সেটা খতিয়ে দেখার ব্যবস্থা কি আমাদের আছে? প্রতিক্রিয়া যে হয়নি তা তো নয়। আমরা হয়তো খোঁজ নিইনি।



সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে একজন মা তার নিজের সন্তানের প্রতিক্রিয়া নিয়ে লিখেছেন। পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে আগের রাতে টেলিভিশনে খবর দেখেছে তার ছেলেও। রাতও জেগেছে। এক ধরনের উৎকণ্ঠা নিয়েই ঘুমুতে গেছে ছেলেটি। সকালে উঠেই টিভির রিমোট হাতে নেয় সে। মা যতই তাকে কার্টুনে মনোনিবেশ করাতে চান, ছেলে ঘুরেফিরে খবরের দিকেই ছুটে। ওই মা লিখেছেন, সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে তিনি দেখেন ছেলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এ রকম কত শিশু কেঁদেছে আমরা কি তার খবর রাখি? কিংবা কত ছেলেমেয়ে কাঁদতে না পেরে বুকের ভেতর বেদনা চেপে রেখেছে?



জিহাদকে শেষ পর্যন্ত জীবিত উদ্ধার করা যায়নি। রাষ্ট্রের ফায়ার সার্ভিস যখন শিশুটিকে উদ্ধারের আশা ছেড়ে দিয়ে পুরো ঘটনা ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে, তখনই স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের সেই চেষ্টায় ছাই দিয়ে জিহাদের লাশ তুলে এনেছেন পাইপ থেকে। তাহলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জিহাদকে উদ্ধার করতে পারলেন না কেন?



তারা উদ্ধারকাজে অবহেলা করেছেন এমনটি বলার সুযোগ কম। এতগুলো মিডিয়ার লাইভ ক্যামেরা আর হাজার হাজার উৎসুক মানুষের ভীড়ে তারা কাজ করেছেন। কিন্তু তাদের ব্যর্থতা অবশ্যই আছে। সে ব্যর্থতা কি যথাযথ প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির অভাব? নাকি প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন জনবলের অভাব? সেটা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। দুর্যোগ ঘটে গেলে পরীক্ষায় নামার পদ্ধতি থেকে সরকারকে অবশ্যই বের হয়ে আসতে হবে। নাটকের চূড়ান্ত মঞ্চায়নে রিহার্সেল হয় না, রিহার্সেল আগেই দিতে হয়।



আরেকটি কথা। উদ্ধারকাজের সময়কার ঘটনাস্থলের যে বিবরণ মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া যায়, তাতে উদ্ধারকর্মীদের ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করার পরিবেশ যে সেখানে ছিল না, সেটি তো পরিস্কার।



অবুঝ এক শিশু মৃত্যকূপে আটকে আছে, এই ঘটনা উদ্ধারকর্মীদেরও মানসিক চাপে ফেলে। তাই নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ দিয়ে কাজ করার মতো পরিবেশ দরকার হয় তাদের। উদ্ধারকাজ পরিচালনা করতে গিয়ে উদ্ধারকর্মীরা অনেক সময় স্বগোতোক্তি করেন। অনেক সময় তাদেরও মনে হয়, এই বুঝি কিছু একটা হয়ে গেল। ঘটনাটা যখন একজন মানবশিশুকে উদ্ধারের– তাদের মনে হতে পারে যে, তারা বোধহয় কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছেন। কিন্তু সেই মনে হওয়া দিয়ে এ ধরনের উদ্ধারকাজের উপসংহার টানা যায় না। সে কারণেই অখণ্ড মনোযোগে তাদের কাজ করার সুযোগ দেওয়া জরুরি।



এ কারণেই পশ্চিমা বিশ্বে উদ্ধারকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত উদ্ধারকারীরা কোনো কথা বলেন না। মিডিয়াকে যেটুকু জানানোর সেটা একজনই জানান, অভিযান শেষ হবার পর। কিন্তু আমরা সেকেন্ডে সেকেন্ড ঘটনার অগ্রগতি জানতে চাই। এত দ্রুত যে কোনো ঘটনার অগ্রগতি হয় না, সে বিবেচনাটুকুও আমাদের থাকে না। আমরা এমনই স্বচ্ছ, অবাধ তথ্যপ্রবাহের আবহ চাই যে, মৃত্যুপথযাত্রীর জীবনরক্ষার চেয়েও মিডিয়ার তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।



শিশু জিহাদের ঘটনা সারা জাতিকে ছুঁয়ে গিয়েছে। পুরো বাংলাদেশ প্রার্থনা করেছে যেন ও সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসে। বাংলাদেশের মানুষের মমত্ববোধ, দুর্যোগ মোকাবেলায় একাত্মবোধ নতুন করে প্রকাশিত হয়েছে। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো প্রশ্নও সামনে নিয়ে এসেছে। আমাদের মিডিয়ার ‘ক্যাপাবিলিটি’ নতুন করে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে। প্রশ্ন, সংশয় তৈরি হয়েছে মিডিয়ার ‘ক্রেডিবিলিটি’ নিয়েও। কিন্তু বড় প্রশ্নটি উঠেছে দুর্যোগ মোকাবেলায় রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও প্রস্তুতি নিয়ে।



‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ যে সরকারের মূল দর্শন– সে সরকারের কাছে দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য ডিজিটাল প্রস্তুতি থাকবে না, এটা কী করে হয়?




শওগাত আলী সাগর: টরন্টো থেকে প্রকাশিত ‘নতুন দেশ’এর প্রধান সম্পাদক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত