অসীম চক্রবর্তী

২৭ জানুয়ারি, ২০১৫ ২১:২৭

শিশু হত্যা এবং আমাদের রাজনৈতিক পরিচিতি

গত কয়েকদিন ধরে মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে মিঠাপুকুরে অন্যদের সঙ্গে একটি শিশু মর্মান্তিকভাবে নিহত হওয়ায় এবং পাঁচ বছরের নিস্পাপ শিশু ফারজানা আক্তারের জন্যে । যে ‘নিরপেক্ষ নির্বাচন’ হাসিলের জন্য এমনি ধারার আন্দোলন চলছে, সেটি আদায় হলেও ওই শিশু তাতে ভোট দিতে যেত না।


গত দুই দিন আগে সংবাদে দেখলাম  আরো এক পাঁচ বছরের নিস্পাপ শিশুর আহাজারি “আমি কিচু করেনি। দাদীর সাথ বাসে করি আসতি লাগি, মানুষ আমাক পুড়া দিছে। খুব কষ্ট, ঘুম আসতি প্যারছিনা। খালি জইলা যাছি, পুড়্যা যাছি। চোখও খ্যুইলতে পারছিনি। আমার জ্বলা কখন বন্ধ হবি; কখন আমি দুই চোখদি দ্যেখতি পাইরবো। মানুষ আমাক কেন পুড়াইলো?”
অধো আধো বোলে এভাবেই দুঃসহ যন্ত্রণার কথা বলছিল পাঁচ বছরের শিশু ফারজানা আক্তার। এ সময় তার নিষ্পাপ চোখের পানি গড়িয়ে মুখের এক পাশ ভিজে যাচ্ছিল।

এ লেখাটি লেখার সপ্তা দুই আগে  রংপুরের মিঠাপুকুরে বিএনপি জামায়তের অবরোধ ভেঙ্গে জীবন ও জীবিকার তাগিদে  বাস চালানোর অপরাধে একটি যাত্রীবাহী বাসে পেট্রল বোমা ছুড়ে শিশুসহ বেশ ক’জন যাত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। আরও কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর। বার্ন ইউনিটে এদের বেশিরভাগ সম্ভবত ধুঁকে ধুঁকে মরবে।

 এর মধ্যে আরো একটি সংবাদে চোখ আটকে গেলো তা হলো উচ্চ বিত্তের সন্তানদের  ইংলিশ মিডিয়ামের পরীক্ষা অবরোধ আওতামুক্ত রাখা হয়েছে l কিন্তু ২ ফেব্রুয়ারি থেকে সারাদেশে একযোগে শুরু হচ্ছে এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা, যাতে ১৪ লাখের বেশি শিক্ষার্থী অংশ নেবেন। কিন্তু মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের সন্তানদের এসএসসি পরিক্ষার জন্যে অবরুধ তুলছেনা বিরোধী জোট  l এদিকে পরীক্ষা যতো এগিয়ে আসছে, পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের শঙ্কা ততো বাড়ছে। অবরোধের কারণে প্রস্তুতিতে ব্যাঘাত ঘটছে বলেও জানিয়েছেন কয়েকজন পরীক্ষার্থী।

 বিএনপি-জামায়াতের  এই টানা  অবরোধ চলাকালে প্রতিদিনই চলছে এ ধরনের মৃত্যু মিছিল। সাথে আছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে অবরোধকারী এবং বোমাহামলাকারীদের মৃত্যু সংবাদ ও l সঙ্গত কারণেই বেড়েছে  ‘মামলা-হামলা’র ঘটনা।মামলা হামলার এই চিত্র বাংলাদেশ দেখছে সেই নব্বইয়ের গণ আন্দোলন থেকেl

নাসকতাময় এই অবরোধে সড়ক-মহাসড়কে চালক, হেলপার ও যাত্রীর ওপর হামলাও বাড়ছে। পণ্যবাহী ট্রাক বা কাভার্ড ভ্যান পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাও কম নেই। আইন-শৃঙ্খলা, এমনকি সীমান্তরক্ষা বাহিনী দিয়ে পণ্য চলাচল নির্বিঘ্ন করার চেষ্টা থাকলেও এরই মধ্যে চালানো হচ্ছে হামলা। এর ফলে বিঘ্ন হচ্ছে আমদানি রফতানি পন্য পরিবহন এবং বেকায়দায় পরছে ব্যাবসায়ী তথা দেশের সাধারণ মানুষ l

 গত কয়েকদিন ধরে  মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে মিঠাপুকুরে অন্যদের সঙ্গে একটি শিশু মর্মান্তিকভাবে নিহত হওয়ায় এবং পাঁচ বছরের নিস্পাপ শিশু ফারজানা আক্তারের জন্যে । যে ‘নিরপেক্ষ নির্বাচন’ হাসিলের জন্য এমনি ধারার আন্দোলন চলছে, সেটি আদায়  হলেও ওই শিশু তাতে ভোট দিতে যেত না। এ দেশের রাজনৈতিক ঘৃণ্য খেলার  মাঠে  কোনো পক্ষেই ছিল না সে। পুড়ে মরার সময় সে জানতেই কিংবা বুঝতেই পারেনি , কারা কোন উদ্দেশ্য সাধনে তাকে এভাবে হত্যা করছে।
অবরোধকারীদের ভাষ্য মতে তারা বলবেন  অবশ্য বলবেন, এটা সরকারি দলের লোকদের কাজ। বলা হচ্ছে অবরোধকারীদের দোষী সাব্যস্ত করতে সরকার এসব বোমা হামলা করছে l দেশের একটি অংশ যে এই ধরনের বক্তব্য বিশ্বাস করছেনা তা কিন্তু নয় l আবার অন্য অংশ বিশ্বাস করে অবরোধকারীরা এসব বোমা হামলা করছে l এমন সন্ধি ক্ষনে বিজিবি প্রধান বিবৃতি দিলেন যে বোমা হামলাকারীদের দেখা মাত্র গুলি করা হবে l তাতে আবার অবরোধকারী বিএনপি জামায়াত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল যা স্ববিরুধিতার সামিল নয় কি ?

এবার আসি সাধারণ জনগনের কথায় l এদের কাছে  গণতন্ত্র মানে  হচ্ছে  দুবেলা  দুমুঠো পেট ভরে খাওয়া, শান্তিতে বউ বাচ্চা নিয়ে  ঘুমানো আর পাঁচ বছর পরে ভোট দেওয়া l ভোট দিয়ে  কি পেলো না পেলো তার হিসাব কষে  সময় ব্যায় না করলেও এরা গর্বের  সাথে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে l যদিও মিঠা পুকুরের খুন হয়ে যাওয়া শিশু, পুড়ে যাওয়া পাঁচ বছরের ফারজানা কিংবা কোমলমতি এস এস সি পরীক্ষার্থীরা এসবের মধ্যে ছিলো না l 

সপ্তাহ চারেক আগে শাহজানপুরে পাইপের মধ্যে পড়ে মারা গিয়েছিলো চার বছরের শিশু জিহাদ l সারাদেশের মানুষ আবেগাপ্লুত হয়েছিলো l বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদের নেতারা বিভিন্ন ভাবে বিবৃতি দিয়েছিলেন l সরকারের সমালোচনা করা হয়েছিলো দেদারসে l কিন্তু মিঠা পুকুরের খুন হয়েযাওয়া শিশুর জন্যে, কিংবা পুড়ে যাওয়া ফারজানার জন্যে তেমন কিছু ঘটবেনা l কোনো শোকবই তে ভিনদেশী কূটনৈতিক সহ দেশের বিশিষ্ট নাগরিকেরা  দস্তখত করবেনা lকরা হবে না  রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা l তবে জমে উঠবে ব্লেইম গেইম নামক এক অদ্ভুত রাজনৈতিক খেলা l  সরকার পক্ষ এটা ব্যবহারের চেষ্টা চালাবে। বিরোধী পক্ষ এঁটে না উঠলে এমনটিও বলবে– আন্দোলনে এসব ঘটেই থাকে। বলবে, আপনারা করেননি? ‘আপনারা’ও আন্দোলনে নাশকতার আশ্রয় নিয়েছিল, সন্দেহ নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে কম জ্বালাও-পোড়াও হয়নি। এসবের ভেতর দিয়ে দাবি আদায়ে সক্ষম হয়েছিল আন্দোলনকারীরা। তাতে জ্বালাও-পোড়াওটা জায়েজ হয়ে যায়নি। তবে এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, এভাবে আন্দোলন করে সফল হওয়া যায়। পরবর্তী নির্বাচনে জেতাও নিশ্চিত হয় তাতে।

চলমান এই সহিংসতাকে  আন্দোলন না বলে অন্য কিছু বলা হলে কাউকে দোষ দেওয়া যাবে না। এবং এটা যে নতুন কৌশলের আন্দোলন তাও কিন্তু নয় । অতীতেও এসব হয়েছে; তবে এত মাত্রাযুক্ত ছিল না। ৫ জানুয়ারির ২০১৩ সালের  আগে অনেক বেশি নাশকতা হয়েছিল আন্দোলনে।দেশের  নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলকে বলা যায় ‘মুক্তাঞ্চল’ বানিয়ে ফেলে বিএনপি-জামায়াত কিংবা জামায়াত-বিএনপি। প্রশাসনের নির্দয় হস্তক্ষেপে  সেসব অঞ্চলের দুর্দম সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে আসে। বিএনপি জামায়াতের আন্দোলনকারীরা যেভাবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উপরে বিগত দিনে চড়াও হয়েছে l  পিটিয়ে খুন করেছে পুলিশ বিজিবির সদস্যদের তা থেকে সহজেই অনুমেয় যে প্রশাসন এখন আরও বেশি করে সরকারের নিয়ন্ত্রণে। যে কোনো ধরনের আন্দোলন দমনে একে আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারবে সরকার। অব্যাহত অবরোধে সরকারকে কাবু করতে না পারলে বিএনপি-জামায়াতকে আরও ‘হামলা-মামলা’ মোকাবেলা করতে হবে। আর সরকার তাতে আরও বেশ কিছুটা সময় টিকে থাকার শক্তি অর্জন করবে।

এত দ্রুত এবং এই কায়দার আন্দোলনের মাধ্যমে নির্বাচন আদায় করা যাবে এই ধারণা বেগম জিয়া নিশ্চয়ই পোষণ করেন না l এমতাবস্তায় দুর্বল সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে দন্ডায়মান দলকে বড় ধরনের ঝুকির মুখে ফেলতেও বোধহয় চাইবেন না তিনি l যুদ্ধাপরাধ বিচারেরে অভিযুক্ত বড় নেতারা জেলখানায় বন্ধি অবস্থায় জামায়াত ও নেই সেই আগের অবস্থায় l অমিত শাহ নাটক, মার্কিন কংগ্রেস ম্যান কেলেংকারীতে আন্তর্জাতিক ভাবে অনেকটাই কোনঠাসা অবস্থা l আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রশ্নে অনেকটা ধোয়াসাচ্ছন্ন l

এই মুহুর্তে আন্দোলনের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে গণ সম্পৃক্ততা l গণ সম্পৃক্ততা ছাড়া গণতন্ত্রের জন্যে আন্দোলন অনেকটা ঝাল ছাড়া ঝাল মুড়ির মত l  বিস্বাদ অথবা বিষাদ l চলমান আন্দোলনে দলের লোকদেরও ঠিকমতো নামাতে পারছেন না বেগম জিয়া। নেতাদের রাস্তায় নামতেই হবে, এমন নয়। কিন্তু তারা কি যূথবদ্ধভাবে আছেন খালেদা জিয়ার সঙ্গে? সরকার যে আচরণ করছে তার সঙ্গে, এর প্রতিবাদও কি তারা করতে পারছেন সক্রিয়ভাবে? দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব জাতীয় প্রেসক্লাবে আশ্রয় নিয়ে যেভাবে গ্রেপ্তার এড়াতে চাইলেন, তাতে একটু অবাক হতে হয়।

সরকারের ভাব দেখে মনে হচ্ছে বিএনপি জামায়াতের চলমান আন্দোলনকে আমলেই নিচ্ছে না তারা । তাই বাধ্য করার মতো আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে বিএনপিকে।প্রধান বিরোধীদল বর্জিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সরকার দেশ চালাতে ব্যর্থ হলে সরকার পতনের কাজটি সহজ হতো বিএনপির জন্যে l কিন্তু সরকার কি দেশ চালনায় ব্যর্থ ?ঠিকমতো নির্বাচিত সরকারও এভাবেই দেশ চালায়। ঠিকমত নির্বাচিত সরকারের মনে যে মনের জোর থাকে সেটা হয়ত বর্তমান সরকারের নেই কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্জনও আছে চোখে পড়ার মত l এ বিষয়ে ব্যাপক মানুষের উৎসাহ এবং একই সঙ্গে বিশ্বাস উৎপাদনের জন্যও সময় দিতে হবে না-কি? বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত আন্দোলন কি সে প্রক্রিয়াও ব্যাহত করছে না?

বেগম জিয়ার পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পরে সংলাপের যে আশার ঝিলিক দেখেছিল দেশের মানুষ প্রধানমন্ত্রীকে গেট থেকে প্রত্যাক্ষান করে সে আশার কফিনেও পেরেক ঠুকলেন বিএনপি নেতারা l

দলমতের বাইরে থাকা সাধারণ মানুষের ভেতর থেকে বলতে চাই, যে দাবির জন্যে বিএনপি আন্দোলন করছে তাতে আমার উত্সাহ নেই l একটি গ্রহণ যোগ্য নির্বাচন হয়তো বিএনপি জামায়াত কে মসনদে বসাবে কিন্তু তাতে কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে ?  এর জন্য দরকার প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলোয় সংস্কারের কর্মসূচি, যাতে কোনো পক্ষেরই কোনো রকম আগ্রহ নেই। অগ্রহ কেবল পেট্রোল বোমাদিয়ে মানুষ পুড়িয়ে, লগি বৈঠার আন্দোলন দিয়ে পাওয়া রাষ্ট্রক্ষমতা কৌশলে করায়ত্ত করে রাখা l

ক্ষমতা দখলের এই হিংস্র মহড়াকে কেউ বলছেন গণতন্ত্রের জন্যে আন্দোলন আর কেউ বলছেন অন্যকথা l এও বলছেন এইখানে মধ্য পন্থা বলে কিছু নেই l তবে দেশের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে প্রশ্ন রংপুরের মিঠা পুকুরের যে শিশুটি মারা গেলো তার রাজনৈতিক পরিচয় কি ? পাঁচ বছরের ফারজানা পুড়ে দগ্ধ হলো তার রাজনৈতিক পরিচয় কি ?পেট্রল বোমায় আহত  ট্রাক চালক রসিদ আজকে মারা গেছে সেই খেটে খাওয়া মানুষটির রাজনৈতিক পরিচয় কি ? অবরুধে আটকে পড়া শতশত মন সবজি নিয়ে আটকে পড়া সর্বশান্ত কৃষকটির রাজনৈতিক পরিচয় কি ? জাতির ভবিষ্যত এসএসসি পরীক্ষার্থীদের রাজনৈতিক পরিচয় কি ?



 

 

 

 

 

 

 

 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত