কনটেন্ট না দেখে আন্দাজে কিছু এঁকে রাখা নিজের সাথেই প্রতারণা : চারু পিন্টু

বাংলাদেশের অন্যতম প্রচ্ছদশিল্পী চারু পিন্টুর সাথে প্রচ্ছদ নিয়ে আলাপচারিতা

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-০৬ ২০:৪২:৩৭

 আপডেট: ২০১৬-০২-২৩ ২৩:০২:৩৫

রেজা ঘটক:

প্রতি বছর অমর একুশে বইমেলা আসার আগেই লেখক-প্রকাশকদের পাশাপাশি প্রচ্ছদ শিল্পীদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। পাঠক একটি বইয়ের ভেতরের কনটেন্টে যাবার আগেই বইয়ের প্রচ্ছদ দেখেই অনেক সময় বইটা পছন্দ করেন। পছন্দের লেখক বা পছন্দের বইয়ের বাইরে তাই বইয়ের প্রচ্ছদ পাঠক এবং বই প্রেমীদের কাছে ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

মূল আলোচনায় যাবার আগে পাঠকদের সঙ্গে আজকের শিল্পীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।  শিল্পী চারু পিন্টু  বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন প্রচ্ছদশিল্পীর ভেতর একজন।

চারু পিন্টু যশোরের মণিরামপুর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার নেশা এবং স্কুল কলেজ গণ্ডি পেরিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। পড়াশুনা করেছেন ইউডা' বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে ড্রইং এন্ড পেইন্টিং নিয়ে। চিত্রকলা নিয়েই তার ধ্যান-জ্ঞান, মনের আনন্দে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ান, আড্ডাবাজী করেন। একসময় দেশের অন্যতম নাট্যদল পালাকারের সাথে নিয়মিত কাজ করেছেন।  এর বাইরে এখন বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকায় নিজের মত করে একটি স্বতন্ত্র জায়গা তৈরি করেছেন বাংলাদেশ-ভারতে।

২০১৬ সালের অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে  তরুণ শিল্পী চারু পিন্টু'র অন্দরের খোঁজখবর নিয়েছেন কথাসাহিত্যিক রেজা ঘটক

রেজা ঘটক: সেদিন ফেসবুকে আপনার একটা স্ট্যাটাসে দেখলাম, আপনি লিখেছেন, আহা কেন যে আরো দুটো হাত থাকলো না, কেন আরো দুটো চোখ থাকলো না! আরো দুটো হাত আর দুটো চোখ আপনাকে দেওয়া হলে কী করতেন?
চারু পিন্টু: আসলে রেজা ভাই মানুষের আকর্ষণ সবক্ষেত্রেই সেদিকে যায় যেখানে অদৃশ্য থাকে অথবা কিছুই থাকে না। আমরা জানি মানুষের গঠন কি। আর যেটা জানি না সেটা- আদৌ নেই বা শূন্য, এই নেই বা শূন্যকেই বেশি কল্পনা করি আমরা। ধর্মীয় দৃষ্টিতে দেবী দুর্গার দশভূজ হবার ক্ষমতা রয়েছে কিন্তু বাস্তবতায় মানুষের সে ক্ষমতা নেই অথবা অনুমতি দেয়া হয়নি। আর যদি দুটো চোখ ও দুটো হাত বেশি থাকতো হয়তো মানুষ দুটো বেশি খুন করতো আবার নাও করতো, দু’চোখকে বিশ্রাম দিতো আর অন্য দু’চোখকে জাগ্রত রাখতো। অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টাই সে কিছু না কিছু দেখতো। মানুষ যতকাল বেচে থাকে তার অর্ধেকটাই ঘুমিয়ে আর অর্ধেকটাই জাগ্রত অবস্থায় কাটায়, এই ঘুমিয়ে কাটানো না দেখা সময়গুলো হয়তো মিস হতো না। এটা আসলে কি যেন ভেবে দিয়েছিলাম।

রেজা ঘটক: আচ্ছা মুল প্রসঙ্গে আসি। কেন ছবি আঁকতে ইচ্ছে হলো? কবি হতে পারতেন অথবা সমাজ অথবা পদার্থ-অপদার্থ সাবজেক্ট থাকতে চারুকলায়। কিসের নেশা পেয়েছিলো? চারুকলায় ভর্তি হবার গল্পটা যদি বলতেন?
চারু পিন্টু:  সত্যি বলতে খুব ছোটবেলায় কবিতা পড়তাম, লেখারও ইচ্ছে ছিলো কিন্তু পারিনি। এটা অনেক কঠিন। তখন যতটুকু বুঝতাম শব্দের শেষে শব্দ মিল। ও আমার দ্বারা সম্ভব ছিলো না। আরেকটু বড়ো হয়েও একবার লেখার ইচ্ছে ছিলো কবিতা, সেটাও সম্ভব হলো না। আসলে শব্দের গঠন বা শব্দগুলোকে সৃষ্টি করে একটা ভ্রম তৈরি করা অথবা নিজস্ব রাজ্য তৈরি করা অথবা মানুষকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে ফেলা, এটা আমার দ্বারা অসম্ভব। আমার মনে হয় কবিতা লেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম কঠিন কাজ অথবা নেশা। কবিতা এমনি শক্তিশালী বিষয় যা যেকোনো মুহূর্তে পট পরিবর্তন করতে পারে।

যশোরের আজিজুল হক স্যার একটা কথা বলতেন- ‘‘কবিতা কখনো কখনো থাপ্পড় মারে বিখ্যাত চোয়ালে এবং তা কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত রী রী জ্বলতে থাকে’’। কবিতা এমনি শক্তিশালী। হয়তো আমি তা পারি না।

চারুকলায় পড়ার ইচ্ছে বা অনিচ্ছে কিছুই ছিলো না আমার। ভালো লাগতো ছবি আঁকতাম, শিখতাম। তখনও চারুকলা সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিলো না। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবার পর যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এ্যাডমিশন দিতে হয় বা কিভাবে দিতে হয়, কিছুই আমি কিছুই জানতাম না, পরিচিত তেমন কেউ ছিলো না সেটাও একটা ব্যাপার। যশোরের বাইরে বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার পথঘাট বা সিস্টেম কিছুই জানা ছিলো না। ঢাকা তো আরো বড়ো ব্যাপার। প্রায় রাস্তাঘাট হারিয়ে কাঠখড় পুড়িয়ে বাসায় ফিরতাম। তারপর কিভাবে যেন একদিন নারায়ণগঞ্জ চলে গেলাম তারপর সেখানে আর্ট কলেজ দেখলাম, ভাবলাম এটাই বুঝি চারুকলা ইন্সটিটিউট, তাহলে এখানেই ভর্তি হওয়া যায়, ভর্তি হলাম প্রি-ডিগ্রী শেষ করলাম। করেই মহাবিপদ, অলরেডি দুবছর পার হয়ে গেলো, সেই ইন্টারমিডিয়েট লেবেলেই থেকে গেলাম। অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ্যাডমিশন দেয়ার মিশন টোটাল ব্যর্থ। পরবর্তীতে ইউডা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স করার সুযোগ আসলো, সেখানে অনার্সে ভর্তি হলাম ড্রইং এন্ড পেইন্টিং বিভাগে। তারপর থেকেই পথ চলা শুরু।

রেজা ঘটক: বইয়ের প্রচ্ছদ করায় কীভাবে জড়িয়ে গেলেন? আপনি কি প্রচ্ছদের বাইরে পেইন্টিংও করেন?
চারু পিন্টু: রেজা ভাই, সে এক লম্বা ইতিহাস। স্কুল গণ্ডি পেরিয়ে যখন কলেজে উঠবো তখন থেকেই আমার শহর মণিরামপুরে চায়ের আড্ডায়, কখনো কখনো আমাদের বাড়িতে কবি, নাট্যকর্মী, রাজনৈতিক, বা সংগীত শিল্পীদের নিয়ে প্রায় আড্ডা হতো। সবাই কতো বড়ো বড়ো কবি সাহিত্যিক আসতেন। তাদের কথা শুনে কবিতা শুনে গল্প শুনে বেশ হিংসে হতো। এরা সবাই কতো কি পারে কিন্তু আমি অপদার্থ, কিছুই পারি না। তারপর থেকে চারুকলায় পড়া, ঢাকা- যশোর চষে বেড়ানো আর আড্ডায়।

আমার ভাই শাফি সমুদ্র, কাজী টিটো, বন্ধু হুমায়ূন আফতাব কবিতা লেখেন, সে সূত্র ধরেই কবিদের আনাগোনা বেশিই ছিলো, তার মধ্যে আশির দশকের অন্যতম কবি খসরু পারভেজ, মকবুল মাহফুজসহ যশোর শহরের অনেক কবিই আসতেন। হঠাৎ একদিন কবি খসরু পারভেজ বললেন- আপনিতো ছবি আঁকেন, প্রচ্ছদ আঁকেন না কেন? আমি বললাম ওটা কিভাবে আঁকবো? অনেক কঠিন কাজ। তখনতো বরেণ্য শিল্পী হাসেম খান, শিল্পী ধ্রুব এষ, শিল্পী সমর মজুমদারের প্রচ্ছদ আমার মুখস্থ। প্রতিদিন বই খুললে বা পত্রিকা দেখলেই তাদের কাজ। আর অক্ষরজ্ঞান যেদিন থেকে শিখেছি সেদিন থেকেই স্কুলের বইয়ের পাতায় কি চমৎকার দৃশ্য আঁকা দেখতাম- হাসেম খান, কাইয়ূম চৌধুরী স্যারদের। কি চমৎকার চমৎকার অলংকরণ করতেন এই প্রথিতযশা শিল্পীরা, আমার মুগ্ধ হওয়া ছাড়া কিছুই ছিলো না।

তারপর ২০০৪ সালে কবি খসরু পারভেজ আঁকতে দিলেন তার প্রেমের কবিতা বইয়ের প্রচ্ছদ। দিন রাত ঘুমহীন হয়ে গেলো আমার। আঁকলাম কলম দিয়ে প্রচ্ছদ, সেটা পাঠিয়ে দিলো নতুন প্রকাশনী সংস্থা ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ-এ। বন্ধুবর আদিত্য অন্তর ও জুয়েল ভাই দুজন মিলে করেছেন প্রতিষ্ঠানটি। তারাও অনেক সহযোগিতা করলেন, যেহেতু ঐ সময়ে আমি প্রযুক্তি প্রতিবন্ধী ছিলাম। ইলাস্ট্রেটর-ফটোশপ কিছুই জানতাম না, সেই ড্রইংকে তার অন্যরকম মাত্রায় নিয়ে প্রকাশ করলেন খসরু পারভেজের প্রেমের কবিতা। ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ খুশি হয়ে আরো অনেক কাজ দিয়েছিলো প্রচ্ছদের জন্য, করলাম। সেই থেকে যাত্রা শুরু আর থেমে থাকতে হয়নি।

প্রচ্ছদ আমার কাছে পেইন্টিং এর মতোই। পেইন্টিংতো করতেই হয় নিজের জন্য হলেও।

রেজা ঘটক: প্রতিটা শিল্পীর নিজস্ব কিছু পছন্দ থাকে, আপনার নিজের করা প্রিয় প্রচ্ছদ কোনগুলোকে বলবেন?
চারু পিন্টু: আসলে আমি মনে করি প্রতিটা কাজই আমার প্রিয়, বেশি প্রিয় কাজগুলো একটি না অনেকগুলিই। নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে করাতকল, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, নওরোজ, বাংলা একাডেমিসহ অনেক প্রকাশনীর প্রচ্ছদ করতে আমার বেশি ভালো লাগে। কেননা তারা পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দেন, আর তখনই নিজেকে নিজেই চেরাই করে নতুন কোন কাজ বের করে আনার চেষ্টা করি। অনেক এক্সপেরিমেন্ট করার সুযোগ থাকে।

রেজা ঘটক: অন্য শিল্পীদের করা কার কার প্রচ্ছদ আপনার ভালো লাগে? আপনার অগ্রজ এবং অনুজের অথবা সমকালীন শিল্পীদের কাজগুলো কতটুকু চাহিদা পূরণ করতে পারছে প্রকাশনা শিল্পে?
চারু পিন্টু: দেখুন রেজা ভাই, অগ্রজ শিল্পীরাতো আমাদের পথ প্রদর্শক মনে করি। তাদের সেই এনালগ সময়ের কঠোর পরিশ্রম এবং প্রচ্ছদশিল্পের নান্দনিকতা এ পর্যায়ে এনে দেবার জন্য যে পরিশ্রম করেছেন, সে পরিশ্রম হয়তো আমরা পাইনি। আমরা প্রচ্ছদ করতে আসার মুহূর্তে প্রযুক্তিও আধুনিকতা পেয়েছে আর আমরাও সহজে সে যাত্রায় গা ভাসাতে পেরেছি। সুতরাং সিনিয়র শিল্পীদের কোন কাজটাকে অস্বীকার করবো? বা করার ক্ষমতা আছে আমার!! তাদের প্রতিটা প্রচ্ছদই আমার কাছে মহান কিছু। কাইয়ূম স্যার, ধ্রুব দা, সমর দা, সব্য’দার কাজ আমার কাছে সবসময়ই প্রিয়; কেননা তারা লম্বা সময় পার করে এসে আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, আর তা সহজে আমরা গ্রহণ করতে পেরেছি। আর সমসাময়িক শিল্পীদের ভেতর প্রায় সবাই দুর্দান্ত কাজ করেন। বইমেলা আসলেই দেখা যায় কি নান্দনিকতার ছোঁয়া, কি প্রাণবন্ত কাজ প্রতিটা শিল্পীর। মাসুক হেলাল ভাই, নিয়াজ চৌধুরী তুলি, মামুন হুসাইন ভাইদের তুলনাতো কেবল তারাই, তাদের প্রতিটা কাজে নিজস্বতার স্বাক্ষর রেখেছেনই। মুস্তাফিজ কারিগর, সব্যসাচী মিস্ত্রি এবং নতুনদের ভেতর কাব্য কারীম, আল নোমান ও অসাধারণ কাজ করেন।

রেজা ঘটক: আমরা যেমন লেখালেখির ক্ষেত্রে অনেকটা প্লাটফর্ম তৈরি করে নেই মাথার ভেতর, তারপর হয়তো কলমে কাগজে বসে যাই এবং কিছু একটা বের হয় হয়তো, তেমনি একটি বইয়ের প্রচ্ছদ করার আগে প্রথম কোন বিষয়টি আপনার মনোজগতে আলোড়ন তোলে?
চারু পিন্টু: দেখুন আমি বিশ্বাস করি সব শিল্পকলাই এক, শুধু প্রয়োগের মাধ্যমটা আলাদা। একটা বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকার ক্ষেত্রে প্রথমেই আমি ভাগ করে নেই কয়েকটা ভাগে যেমন- বইটা কি ধরনের? কবিতা, গল্প, উপন্যাস না প্রবন্ধ, তারপরে এটা কোন ধরনের কবিতা গল্প বা প্রবন্ধ? পরবর্তীতে চলে যাই মূল পাঠে; সেখান থেকে হাইলাইটে মূল বক্তব্যটাকেই ধরার চেষ্টা করি। এরপর প্লান শুরু হয়- কি আঁকবো, কি রঙ দিবো, কিভাবে এর শিল্প গুণাগুণ বৃদ্ধি করবো। এভাবেই শুরু হয় কাজ আর অবশ্যই মনোজগতে একটা ছবি তৈরি হয়েই যায় এবং সেটাকে যথাযথ রূপ দেবার চেষ্টা করি।

রেজা ঘটক: আপনি কীসের উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন? বইয়ের কনটেন্ট নাকি আগে থেকেই একটা আইডিয়া আপনার মাথায় কাজ করে?
চারু পিন্টু: আসলে আগে থেকে আইডিয়া হয় না প্রচ্ছদের ক্ষেত্রে। অবশ্যই কনটেন্ট দেখে কিছু আঁকার চেষ্টা করি। কনটেন্ট না দেখে আন্দাজে কিছু এডভান্স এঁকে রাখা একপ্রকার নিজের সাথেই নিজের প্রতারণা করা ছাড়া আর কিছু নয় অন্তত আমার কাছে।

রেজা ঘটক: বইয়ের প্রচ্ছদ করার ক্ষেত্রে লেখকের চাওয়া বা প্রকাশকের চাহিদার বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পায় নাকি এ ব্যাপারে আপনার নিজস্ব কোনো সাইকোলজি কাজ করে?
চারু পিন্টু: রেজা ভাই এটা খুবই একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একজন লেখকের দায়িত্ব লিখে যাওয়া, একজন প্রকাশকের দায়িত্ব সেটা সুন্দরভাবে সম্পাদনা এবং প্রকাশ করা, বইয়ের গুণগত মান বা বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করা। তেমনি প্রচ্ছদটাকে কেবল শিল্পীর নিকট আস্থা রেখে ছেড়ে দেয়া। শিল্পীই বুঝবে কি আঁকতে হবে। সেক্ষেত্রে লেখক প্রকাশকের সাথে অবশ্যই সমন্বয় হওয়া উচিত বা চিন্তাটাকে শেয়ার করা উচিত। লেখক শিল্পী এবং প্রকাশকের সমন্বয়ে একটা বই তার পরিপূর্ণ রূপ পেতে পারে।

রেজা ঘটক: প্রথম বইয়ের প্রচ্ছদ করার সময় কেমন অনুভূতি হয়েছিল?
চারু পিন্টু: সেটা বলে প্রকাশ করবার মতোই নয়। প্রচ্ছদ করবার মুহূর্তেতো ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিলো, তার প্রায় তিনমাস পর বই প্রকাশ পেলো। বই হাতে পাবার পর কি হয়েছিলো বলতে পারবো না। তবে ঘুমানোর সময় মাথার নিচে বালিশ থাকতো না প্রেমের কবিতার বই থাকতো, সেটা ভুলে যেতাম। আর বইটা সবসময় সাথে সাথে রাখতাম সবাইকে দেখিয়ে বেড়াতাম।

রেজা ঘটক: প্রচ্ছদ করা নিয়ে কোনো বিড়ম্বনার ঘটনা কি আছে? থাকলে সেটি কেমন?
চারু পিন্টু: বিড়ম্বনা ঠিক ওভাবে বলা যাবে না। আপনি যেকোনো কাজ করতে যাবেন সেখানে কিছুনা কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকবেই। সেক্ষেত্রে নিজের মতো করেই আসলে সমাধান করা শ্রেয়। তবে অসস্তিকর বিষয়তো অবশ্যই আছে। যখন আপনি লেখক বা প্রকাশক হবেন এবং তার যৌক্তিক বা অযৌক্তিক চিন্তা বা রঙের ব্যবহার ইত্যাদি চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন, তখন আসলে কাজের চরিত্রটাই নষ্ট হয়ে যায়। এবং আমি মনে করি তখনি প্রচ্ছদ কয়েকবার ধর্ষিত হয়। যেটা কোনভাবেই সুখকর নয়। আপনার যদি সমস্যা হয় তবে স্রোতধারার চ্যানেল পরিবর্তন করতে পারেন কিন্তু বাঁধ দিতে পারেন না। সেরকমই যখন প্রচ্ছদের কনসেপ্ট চাপিয়ে দেয়া হয় সে চাপ না নেবার চেয়ে কাজটা না করলে অন্তত প্রচ্ছদটি রক্ষা পায়।

রেজা ঘটক: প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রচ্ছদ শিল্পীদের সঙ্গে যদি বাংলাদেশের প্রচ্ছদ শিল্পীদের তুলনামূলক গুণাগুণ বিচারের কথা বলি, তাহলে আপনি কাদের এগিয়ে রাখবেন এবং কেন?
চারু পিন্টু: দেখুন রেজা ভাই, বাংলাদেশ এবং ভারত প্রায় কাছাকাছি সংস্কৃতির। আমাদের মতো করে ওপারের বাঙালিরাও একই কবির কবিতা পড়েন একই শিল্পীর গান শোনেন। একই সময়ই প্রায় সূর্য ওঠে সূর্য অস্ত যায়। সুতরাং খুব বেশি পার্থক্য চোখে পড়ার মতো নয়। তবে যেটা গুরুত্বপূর্ণ যে আমাদের দেশের প্রকাশনা ব্যবস্থাপনায় প্রচ্ছদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং তার শিল্পমান নিয়েও অনেক পরিশ্রম করেন শিল্পী ও প্রকাশকগণ, দীর্ঘ ধারাবাহিকতা রয়েছে এ শিল্পের, এবং এখানে প্রচ্ছদ করতে যাওয়া মানেই নিজেকেই নিজে টপকে যাওয়া বা নিজের একটি কাজ আগের কাজের চেয়ে ঢ়েরতম শ্রেয় করার প্রবণতা আছে। কোলকাতার বা ত্রিপুরা, আসাম অথবা উত্তরপ্রদেশে সমকালীন শিল্পীরা সেরকম হয়তো ভাবছে। দেজ, আনন্দ পাবলিসার অথবা অভিযানের বইগুলো দেখলেই বোঝা যায় সেখানেও প্রচ্ছদের ঝড় তোলে। এখানে আসলে এগিয়ে রাখবার বা প্রতিযোগিতা করার কিছু আছে বলে মনে হয় না। কেননা শিল্পের ভাষা সবসময় আন্তর্জাতিক এবং কোন কাঁটাতারের বেড়ায় আটকে রাখা সম্ভব নয়। আর গুণাগুণ বিচার অনেক বড়ো ব্যাপার, প্রতিটা শিল্পীরই কাজের নিজস্ব স্টাইল থাকেই। আর নিজের স্বকীয়তা নিজের সাথে নিজেরই প্রতিযোগিতা করে, অন্যের সাথে নয়।

রেজা ঘটক: আঁকাআঁকির কাজটা কখন করেন? হাহাহা আমিতো দেখি অনেক জনপ্রিয়তা আপনার, মহাব্যস্ত মানুষ, কখন বান্ধবীকে সময় দেন কীভাবে?
চারু পিন্টু: আসলে আঁকাআঁকি সবসময়ই হয়। প্রচ্ছদ করতে গেলেও কিছু না কিছু আঁকতেই হচ্ছে। প্রচ্ছদের জন্য শেষ চারমাস একটু চাপ থাকে আর বাকি সময়গুলো তো পেইন্টিং নিয়েই কেটে যায় সময়। আসলে রেজা ভাই বান্ধবী বলে কিছু নেই। সবাই যেহেতু সমগোত্রীয় সুতরাং সবাই বন্ধু। আর যারা আছে নয়নতারায় তাদের মনে হয় না আলাদা ভাবে সময় দেবার প্রয়োজন আছে, তারা নয়নে নয়নে বসত করে। হাহাহাহা।

রেজা ঘটক: প্রথম প্রচ্ছদ করে কত টাকা পেয়েছিলেন?
চারু পিন্টু: সেটা মনে নেই। ভালো বলতে পারবেন ইত্যাদি প্রকাশনার আদিত্য অন্তর আর জুয়েল ভাই (যদি মনে থাকে)।  

রেজা ঘটক: দেশের বাইরের কোনো লেখকের বা কোনো প্রকাশনার জন্য কোনো প্রচ্ছদ করেছেন কী? সংখ্যাটি কেমন?
চারু পিন্টু: হ্যাঁ দেশের বাইরে বলতে ভারতের বেশ কিছু লেখকের বই বের হয়েছে যা ওখান থেকেই প্রকাশিত। আরও অনেক বই আছে দেশের বাইরের লেখক, কিন্তু তাদের লাইসেন্সকৃত বই তাদের অফিসিয়ালভাবে বাংলাতে বেরিয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য জার্মানের নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক হার্টা মূল্যার এবং ইংল্যান্ডের নোবেল বিজয়ী ডেরিস লেসিং এর বই। যেগুলো বাংলাদেশের অংকুর প্রকাশনীর অফিশিয়াল বই হিসেবে বের হয়েছিলো।

রেজা ঘটক: পেইন্টিং এবং প্রচ্ছদের মধ্যে আপনি কোন মাধ্যমে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
চারু পিন্টু: দেখুন পেইন্টিং এর ভেতর প্রচ্ছদ থাকে না কিন্তু প্রচ্ছদের ভেতর পেইন্টিং থাকে। মোট কথা পেইন্টিং এর বাইরে কিছু নয়। দুটোই আমার কাছে ভালো লাগার। কোনটা ছেড়ে কোনটাই নয়।

রেজা ঘটক: অমর একুশে বইমেলার আগে আগে কয় ঘণ্টা ঘুমানোর সুযোগ পান?
চারু পিন্টু: বইমেলা আসলে চাপ একটু বেড়ে যায় বৈকি। তবে সময়ের কাজ আমি সময়ে করার চেষ্টা করি বলেই হয়তো খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। আমি সময় সচেতন খুব। আর আমি যতটুকু কাজ করি সেটা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই করি। ঘুম নিয়ে মাথা ব্যথা নেই, ঘুম যদি নিতান্তই না-ই আসে তবে সেটা ঘুমের ব্যর্থতা বা চোখের ব্যর্থতা, তাতো আমার কোন সমস্যা নেই।

রেজা ঘটক: বাংলাদেশের প্রচ্ছদ শিল্পের ভবিষ্যৎ কেমন?
চারু পিন্টু: প্রচ্ছদ শিল্পের কোন ভবিষ্যৎ নেই। সে জড় তাকে যেভাবে চালাবেন সে সেভাবে চলবে। এখন অনেকটা নির্ভর করে বাংলাদেশের প্রকাশনা ব্যবস্থা কেমন চলছে তার উপর। সেজন্য সব থেকে বেশি ভূমিকা মহান পাঠকগণের। পাঠকগণ যদি বই পড়েন বা কেনেন তাহলে প্রকাশনা ব্যবস্থা টিকে থাকবে, আর তা থাকলে প্রচ্ছদও টিকে থাকবে।

রেজা ঘটক: নবীন শিল্পীদের যারা প্রচ্ছদ করতে চান, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
চারু পিন্টু: বাংলাদেশে প্রতিবছর চার থেকে পাঁচ হাজার বই প্রকাশ পায় সে তুলনায় হাতে গোনা কয়েকজন প্রচ্ছদশিল্পী। আমার মনে হয় নতুন শিল্পীদের এগিয়ে আসা উচিৎ প্রচ্ছদশিল্পে, তাহলে আমরা পাবো নানানরকম নানান কনসেপ্ট। নতুনত্ব। তবে নতুনদের প্রতি একটাই অনুরোধ হতাশ না হবার। যেভাবে হোক টিকে থেকে নতুন নতুন চিন্তা বের করা এবং নিজস্বতা তৈরি করা।
ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য