অর্ক ও সূর্যমামা: সূর্যের পূর্ণাঙ্গ বায়োগ্রাফি

বই আলোচনা

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-১৪ ১৭:১৫:১৮

 আপডেট: ২০১৬-০২-১৪ ১৭:২১:৪৯

দেব প্রসাদ দেবু:

হাইস্কুল পর্যায়ে নতুন স্কুলে ভর্তি হয়ে প্রচণ্ড বিরক্ত ছিলাম সমাজ বিজ্ঞান বা সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়টির উপর; এ এক বিভীষিকা! এতো এতো সন আর ঘটনা মুখস্থ করা রীতিমতো অত্যাচার মনে হতো। যে কায়দায় আমাদের ইতিহাস পড়ানো হতো সেটা ছিলো তোঁতা পাখির নাম মুখস্থ করার পদ্ধতি। ফলে আমরাও বুঝে উঠতে পারতাম না পলাশী যুদ্ধের তারিখ জেনে আমার কী লাভ? কলম্বাস কিংবা ভাস্কোদাগামা সম্পর্কে জানার আগ্রহ আমরা পাই নি কখনো, বড়জোর পরীক্ষা পাশের জন্য কিছু ছাপানো কথা মুখস্থ করেছিলাম মাত্র। বুঝে উঠত পারতাম না ইতিহাসের এই অলিগলি জেনে আমার কী লাভ?

জাতিসত্তার কৃষ্টি, সংস্কৃতির ভীত বুঝতে বা সাংস্কৃতিক ধারা বুঝতে অথবা সমাজ বিকাশের গতিধারা বুঝতে যে ইতিহাস একটি বড় মাধ্যম সেটি কেউ মাথায় ঢুকায় নি। আমার মোটা মাথাও কোন প্রয়োজন অনুভব করেনি পরীক্ষা পাশের বাইরে ভিন্নভাবে পাঠ্যবইকে বুঝাতে বা ভালোবাসতে। আর বিজ্ঞান? সেতো আরো বিরক্তিকর! কী সব হাবিজাবি পড়াশুনা। বিজ্ঞান স্যারের ভাষায় ‘বাস্তবের সাথে হাজারো অমিল। পাঠ্যসূচিতে আছে তাই পড়ো, মুখস্থ করে নাও। বিবর্তনবাদ আসলে একধরনের ধারণা, যেটার সাথে বাস্তবের মিল নেই’।

বিবর্তন বিষয়ক চ্যাপ্টারের পাঠদান পূর্ব স্যারের ভূমিকা ছিলো এমনই। ফলে কিশোর বয়সে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহটা ঠিক জাগে নি আমাদের। গণিত? সেতো আরো ভয়াবহ! বানর কেন তৈলাক্ত বাঁশে উঠানামা করে সেটা গবেষণার উপজীব্য ছিলো বটে, কিন্তু স্রোতের বিপরীতে এগিয়ে যাবার গাণিতিক হিসাব মাথায় ঢুকে না কিছুতেই, প্রয়োজনীয়টাই ধরতে পারি নি। ইনফ্যাক্ট ঢুকানো হয়না। উপপাদ্য তবুও ঠিকঠাক মুখস্থ করে লিখে আসা যায়, কিন্তু সম্পাদ্য? এ এক জটিল ধাঁধা, কিভাবে কি আঁকি?

ফলে কিশোর বয়সে মনে প্রশ্ন জাগে-‘কে এই জ্যামিতি আবিষ্কার করলো এবং কেনইবা করলো’? তারপরও আমরা সায়েন্সে পড়তে হতে আগ্রহী। দুটো কারণ। এক- ভালো ছাত্ররা বিজ্ঞান পড়ে (কে না চায় নিজেকে ভালো ছাত্রের তকমায় তকমিত করতে!), দুই- ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে গেলে বিজ্ঞান পড়া লাগবে, যেটা বাবা-মা চায়। এর বাইরে খুব কম ছাত্র ছাত্রীই আছে যারা ভালোবেসে বিজ্ঞান পড়েছে আমাদের স্কুলে।
 
বিজ্ঞান-গণিত কিংবা সমাজ বিজ্ঞানের কথা থাক। বাংলাটাই বা আমরা কীভাবে শিখি? -পরীক্ষায় রচনা লিখতে হবে। পাক্কা বিশ নম্বর! পরীক্ষার আগেই প্রাইভেট স্যারের কাছে ধর্না দেয়া
- স্যার সাজেশন দিন্‌না প্লিজ!
-রচনা? ...বন্যা, পাট, শ্রমের মর্যাদা, অধ্যবসায়, জীবনের লক্ষ্য, প্রিয় কবি... এগুলো মুখস্থ করে নাও। পেয়ে যাবে!
কিছুতেই মুখস্থ হতে চাইতোনা বড় বড় রচনাগুলো। বাজারে যেসব নোট বই কিংবা হ্যান্ড নোট পাওয়া যেতো তাতে কী সব কঠিন কঠিন সাহিত্যিক ভাষা লেখা থাকতো। এতো মনে থাকে? যতোই শিক্ষকরা বলুক- ‘নিজে থেকে বানিয়ে লিখার চেষ্টা করো’; মাথায় ঘুরতো একটাই বিষয়- ভালো নম্বর পেতে হবে।  

স্কুলের একটা লাইব্রেরি কক্ষ ছিলো। তিন চারটে বুক শেলফ ঠাসা বই, ধুলো জমে থাকা টেবিল।
একদিন সাহস করে গিয়েছিলাম স্যারের কাছে।
-স্যার একটা বই নিবো।
-অ্যাঁ? কি বই?
-স্যার সুকুমার রায়ের ছড়া বই।
-ওটা প্রাইমারি স্কুলে পড়োনি?......ঐ যে- পাকাপাকি?
-পড়েছি স্যার।
-অ, তাইলে যাও। আর কি পড়বা?  
-স্যার, শ্রেষ্ঠ কিশোর এডভেন্সার বইটা নিতে চাচ্ছিলাম। বুক শেলফ্‌ সামনে দেখিয়ে দিয়ে বলি।
-অ্যাঁ? লাস্ট পরীক্ষায় বাংলায় কতো পেয়েছো?
-স্যার, ৫৩। আমি মাথা নিচু করে জবাব দেই।
-ঐটা ভালো করে পড়ো আগে।
এই ছিলো আমার লাইব্রেরির বই তোলার অভিজ্ঞতা।  

বাংলাদেশের অধিকাংশ স্কুলে এই দ্বন্দ্বগুলো বিদ্যমান বলেই আমার ধারণা। সৃজনশীল প্রশ্নের ফলে কিছুটা পরিবর্তন নিশ্চয়ই হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান শিক্ষার যে হাল তাতে প্রদীপ দেব-এর অর্ক ও সূর্য মামা বইয়ের সবিতা ম্যাডামদের সরব উপস্থিতি এখনো পুরোমাত্রায় বিদ্যমান। এখনো প্রচুর কিশোর ছাত্রের বিজ্ঞানের প্রতি কোলাহল ভরা বিরক্তি স্কুলগুলোতে দৃশ্যমান, যারা একবাক্যে বলে উঠে –‘বিজ্ঞান? বোরিং স্যার’!  

আমি নিশ্চিত- সূর্য সম্পর্কে স্কুল কেনো, কলেজ লেভেলের কোনো ছাত্রকে জিজ্ঞেস করা হলে ‘সূর্য আমাদের পরম আত্মীয়। তাকে আমরা মামা বলে ডাকি’ টাইপের উত্তর না দিলেও বড়জোর এটুকুই বলবে সূর্য আমাদের আলো দেয় কিংবা সূর্যের আলো-তাপ আছে বলে গাছপালা বেঁচে আছে। এরচে’ বেশি কিছু খুব কম ছাত্রই বলার সম্ভাবনা আছে। ঢাকার ছাত্ররা ভাসানি নভো-থিয়েটারের শর্ট ফ্লিম দেখে হয়তো এটুকু বলতে পারবে সূর্য একটি নক্ষত্র, একটি বড় অগ্নিপিণ্ড বা গ্যাস পিণ্ড, কিংবা সূর্যপৃষ্ঠে সৌরঝড়ের কথাও কেউ কেউ বলতে পারে। কিন্তু সৌরঝড়ের কারণ কেউ বলতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে।  ব্রুনো কিংবা গ্যালিলিওর কথা আমরা কিছুটা জানি বটে, কিন্তু গ্রিক বিজ্ঞানী থ্যালিসের কথা কজন জানি? কিংবা সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘুরছে এই সত্যটি সাধারণ সত্য হিসেবে জানলেও জানিনা সেই দার্শনিকের নাম, যিনি প্রথম প্রচার করেছিলেন সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘুরছে। প্রদীপ দেবের ‘অর্ক ও সূর্য মামা বই থেকে আমরা এই এরিস্টার্কাস, কোপার্নিকাস সহ সূর্য নিয়ে কাজ করা বা ধারণা দেয়া প্রায় সব বিজ্ঞানী/দার্শনিক সম্পর্কে জানতে পারি। শত শত বছর আগের ধর্মীয় গোঁড়ামির কুটচালে বাধাগ্রস্ত বিজ্ঞান চর্চা সম্পর্কে কিংবা পাদ্রিদের নির্মমতার কাহিনীগুলোও আমাদের জন্য সহজ ভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন ড. দেব তার এই বইতে।

যেকোনো জিনিষের সৃষ্টি রহস্য জানা থাকলে সেটি সম্পর্কে অলৌকিক এবং আদি ভৌতিক গালগল্প উবে যেতে বাধ্য। সূর্য সম্পর্কে যতোটা মিথ চালু আছে সারা বিশ্বে অন্য কিছু নিয়ে অতটা বোধহয় নেই। এটার অন্যতম কারণ সূর্য সম্পর্কে, এর উৎপত্তি, এর আলোক বা তাপ নির্গমনের লজিক এবং এর সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানের অভাব। এসবের অভাবে যে মিথ আদি যুগে তৈরি হয়েছিলো সেগুলোই শাখা প্রশাখা বাড়িয়ে বা খানিকটা কমিয়ে এখনো চালু আছে সাধারণ মানুষের মনে। সেই যে সম্যক এবং জরুরী তথ্য, সেগুলোকে তুলে এনেছেন ড. দেব তাঁর এই অর্ক ও সূর্য মামা বইতে।  

বিবর্তনবাদ না বুঝলে হোমো সেপিয়েন্স গ্রুপের মানুষের বিবর্তন আজগুবি ঠেকতেই পারে। প্রশ্ন আসতে পারে ‘তাই যদি হবে, তো এখন মানুষ থেকে অন্য প্রজাতিতে বিবর্তন ঘটছে না কেন’?  বিবর্তন বোঝার প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে হাজার কোটি বছরের সভ্যতার টাইম স্কেলটা বুঝতে হবে। চোখের সামনে বড় হতে থাকা সন্তানের বড় হওয়ার সাথে সাথে চেহারার সূক্ষ্ম পরিবর্তনই যেখানে বাবা-মা’র চোখে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় না, সেখানে হাজার কোটি বছরের স্কেলে প্রজাতির বিবর্তন ধরা পড়া আরো দূরহ।
একইভাবে সূর্যের রহস্য বুঝতে গেলে জানতে হবে এর সৃষ্টি রহস্য, বুঝতে হবে সূর্যের চরিত্র, কর্ম পদ্ধতি এবং ভবিষ্যৎ পরিণতি। ‘আমি সূর্যকে বললাম তুমি উদিত হও’ বললেই ‘সাত আসমানের’ উপরে সূর্য উদিত হয়ে যায় না। ১৪ শত কোটি বছর আগে ঘটে যাওয়া বিগ ব্যাং এর পরও প্রায় ১০০০ কোটি বছর লেগেছে একটি সূর্য তৈরি হতে। বিগ ব্যাং-মহাকাশ সৃষ্টি-গ্যালাক্সি-নেবুলা-নিউক্লিয়ার ফিউশন-কোটি কোটি হাইড্রোজেন পরমাণু থেকে কোটি কোটি হিলিয়ামের সৃষ্টি, সূর্যের উপাদান পুড়ে ভর পরিণত হচ্ছে শক্তিতে। প্রতি সেকেন্ডে ৫০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন হাইড্রোজেনকে হিলিয়ামে রূপান্তরিত করছে এই অগ্নিপিণ্ড। প্রতি সেকেন্ডে তৈরি হচ্ছে  ওয়াট শক্তি, প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে হাইড্রোজেনের পরিমাণ।

এভাবে চলতে চলতে ৫০০ কোটি বছর পর হাইড্রোজেন শেষ হয়ে গেলে হিলিয়াম ব্যবহার হবে জ্বালানি হিসেবে, বেড়ে যাবে কেন্দ্রের চাপ, ফলে কেন্দ্রের এক কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে বেড়ে হবে দশ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস, সূর্য প্রায় ত্রিশ গুন সম্প্রসারিত হয়ে গ্রাস করে নেবে বুধ, শুক্রের মতো কাছের গ্রহ গুলোকে, পৃথিবী হয়ে যাবে বাষ্প, এভাবে চলতে চলতে প্রায় কোটি বছর পর শেষ হবে হিলিয়াম, উৎপন্ন হবে না নতুন কোন শক্তি, শুরু হবে দশ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কমা, তৈরি হবে শ্বেত বামন। আবার কোটি কোটি বছর ধরে অন্য কোন নেবুলা থেকে তৈরি হবে নতুন সূর্য, হয়তো তৈরি হবে নতুন কোন পৃথিবী!

এই যে বিশাল কর্মযজ্ঞ এটিকে শুধু কিশোর নয়, বিজ্ঞান বিমুখ বড়দের বোঝার উপযোগী করে দুর্দান্ত ভাবে তুলে এনেছেন বিজ্ঞান লেখক ড. প্রদীপ দেব তাঁর অর্ক ও সূর্য মামা বইতে। কিশোর তো বটেই, বিজ্ঞানকে ভালোবেসে এমন সবার জন্যই অবশ্য পাঠ্য অনবদ্য একটি বই এটি।  

বইটি প্রকাশ করেছে মীরা প্রকাশন।

উল্লেখ্য, লেখক বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দুটি সিরিজ বই আকারে শুরু করেছেন, একটি হলো বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানী, অন্যটি কিশোর বিজ্ঞান। দুটি সিরিজেই দুটি করে বই বেরিয়েছে। অর্ক ও সূর্যমামা কিশোর বিজ্ঞান সিরিজের প্রথম বই।

আপনার মন্তব্য