গ্রন্থালোচনা : স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-১৯ ১৪:০৭:৩১

ফারুক আহমদ:

স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা বইটি পেয়ে কবি রফিক আজাদের, ‘যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ’ কবিতার কয়েকটি লাইন বড় বেশী মনে পড়ল:

একে একে নিহত সবাই- স্বাধীনতা যুদ্ধের সৈনিক
বীরোত্তম; কেউ কেউ বিতাড়িত স্বদেশ ভূমি থেকে
কেউবা আবার স্বেচ্ছা নির্বাসনে-
একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা সবাই
ক্ষমতার বারান্দায়, সারি বেধে হাসি মুখে
দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
এই স্বাধীনতা, এইতো আমার প্রিয় জন্মভূমি’।

১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট থেকে ১৯৯০ সালের ১৯৯০ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর। এই সময়ের পুরো ইতিহাস কবি রফিক আজাদ তাঁর ‘যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ’ কবিতার মাত্র ৭টি লাইনে হুবহু তুলে ধরেছেন। কিন্তু কবির জন্মভূমি একাত্তরের পরাজিত শক্তির রাহুগ্রাসে খুব বেশী দিন থাকেনি। একে একে ক্ষমতার বারান্দায় যেভাবে সারি বেধে হাসিমুখে দাঁড়িয়েছিলেন, ঠিক একইভাবে সারি বেধে ফাঁসিকাষ্ঠেও ঝুলেছেন, ঝুলছেন। অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, কেউবা স্বাধীনতাযুদ্ধের সৈনিকদের মতো স্বদেশ ভূমি ছেড়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে।

প্রচলিত কথা হচ্ছে, ইতিহাসের চাকা কোনোদিন থেমে থাকে না। সে তার আপন কক্ষপথে ঘুরতে আছে, ঘুরবে অনাগত কাল পর্যন্ত। যে কোনো জাতীর জীবনে উত্থান-পতন আছে, জয়-পরাজয় থাকে। এইগুলো থেকে শিক্ষা না নিলে জাতীয়ভাবে বিপর্যয় আসে। উত্থান-পতনের এই দিনলিপি ইতিহাসে মোটা দাগে চিহ্নিত থাকে। বাংলার ইতিহাসে, বাঙালির ইতিহাসে এই দাগগুলোই ১৭৫৭, ১৯৪৭, ১৯৫২ ও ১৯৭১ সাল। ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের পূর্বসূরিরা এই দাগগুলো অনুসরণ করেই সামনের দিকে হেঁটেছেন। আমরাও এই দাগগুলো ধরেই ইতিহাসের পথে হেঁটেছি, হাঁটছি। আমাদের উত্তরসূরি, ভাবীকালের মানুষেরাও সে পথে অগ্রসর হবেন। তারাও আমাদের মতো তাকিয়ে দেখবেন জাতীয়-জীবনের উত্থান-পতনের রক্তাক্ত দৃশ্যগুলো। চিহ্নিত করবেন, নব্য মীর জাফর, রায় দুর্লভ, উমিচাঁদ জগৎ শেটদের। যে কোনো পথোন্মুখ কালে তারাও আবার স্বাধীনতার চেতনায় জেগে উঠবেন। পূর্বসূরিদের মতো জীবন বাজী রেখে লড়াই করে মা, মাটি আর মানুষের জন্য কাজ করবেন। সেজন্য এই ধরণের গ্রন্থ তাদের সামনে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করবে, প্রেরণা যোগাবে। উজ্জীবিত করবে এই জাতীয় বীরদের মতো আত্মত্যাগের দৃষ্টান্তই স্থাপন করতে, আরেকটি ইতিহাস গড়তে, ইতিহাস রচনা করতে।

বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, ‘কেউ আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না’। ইতিহাস প্রমাণ দিচ্ছে একাত্তরে পাকিস্তানিরা পারেনি, ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্টের নরঘাতকরাও পারে নি।

আমরা ইতিহাস ও পুরাণে খলনায়কদের পতনদৃশ্য যেমন পড়েছি, তেমনি বাংলার সমকালীন ইতিহাসে আমরাও তাঁদের পতন দৃশ্যও দেখেছি। দেখেছি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাঙালি জাতি আবারও জেগে উঠতে।

তরুণ লেখক আনোয়ার শাহজাহানের, ‘স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা’ গ্রন্থটি বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সময়ের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিয়ে লেখা ইতিহাসের একটি অধ্যায়। যে অধ্যায় আমাদেরকে সেই একাত্তরে নিয়ে যায়। এই গ্রন্থপাঠে আমরা শুধু ‘স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা’দের শুধু পরিচিতিই জানবো না, একইসঙ্গে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের কোথায়, কখন কী ঘটেছিল তারও অনেক অজানা এবং নিখাদ বিবরণ পাবো। যে বিবরণ সাধারণ ইতিহাসে কোনোভাবেই পাওয়া সম্ভব নয়। সেজন্য লেখক অতি অবশ্যই ধন্যবাদ পাবার যোগ্য।

এই ধরনের পরিচিতিমূলক গ্রন্থালোচনায় চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণের সুযোগ কম। তার ওপর স্বয়ং লেখকই যদি হন পরবাসী তা হলে তাকে বিনা বাক্য ব্যয়ে সাধুবাদ জানানো উত্তম বলেই আমি মনে করি। কারণ, এই বইটি লিখে এটাকে ওপরে উঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করবেন না। এটা তার ব্যবসাও নয়। আমি নিজে কাছে থেকে দেখেছি এই গ্রন্থের তথ্যসংগ্রহের জন্য তিনি কত পরিশ্রম করেছেন, কতবার দেশে গেছেন এবং সর্বোপরি তথ্যসংগ্রহের জন্য কত টাকার শ্রাদ্ধ করেছেন।

এই ধরণের বই বাজারে বিরল নয়। কিন্তু গুণগত মানের দিক থেকে অবশ্যই এই বইটি প্রথম সারির একটি গ্রন্থ। দর্শনদারী এই গ্রন্থটি পড়ে যেমন আনন্দ পাওয়া যাবে, মুক্তিযুদ্ধের আদি ও আসল অনেক ঘটনা জানা যাবে, তেমনি প্রায় প্রত্যেকটি রণাঙ্গনের বীরত্বপূর্ণ কাহিনী জানা যাবে। আনোয়ার শাহজাহান একাত্তরের প্রজন্ম। তিনি মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষরণ দেখেছেন, স্বৈরশাসকদের গণতন্ত্র দলন দেখেছেন। দেখেছেন, ক্ষমতায় থাকার জন্য স্বৈরশাসকদের অত্যাচার, উৎপীড়ন আর নানা ছলচাতুরী। দেখেছেন রাজপথে গণতন্ত্রকামী মানুষের বুলেটবিদ্ধ লাশ। এইসকল ঘটনাপ্রবাহ দেখেশুনেই তিনি এই বিষয়টি বেছে নিয়ে বই লিখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। আগেই বলেছি, তিনি প্রবাসে থাকেন। বই লিখে টাকা আয় করা তাঁর উদ্দেশ্য নয়, বরং দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কথা তুলে ধরতে টাকার শ্রাদ্ধ করাতেই তার আনন্দ।

এটি তাঁর ‘স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা’ গ্রন্থমালার প্রথমখণ্ড। এতে বীরশ্রেষ্ঠ, বীর-উত্তম ও বীরবিক্রম এই তিনটি অধ্যায়ে মোট ২৭৫ জনের মধ্যে ২৬৬ জন মুক্তিযোদ্ধার পরিচিতি স্থান পেয়েছে। ৭ জন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে না পারায় সংক্ষিপ্তভাবে পরিশিষ্টে তাঁদের কয়েক লাইনে দেয়া হয়েছে। এছাড়াও পরিশিষ্টে বীরপ্রতিক মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, যাঁরা দুটি করে খেতাব পেয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় সংকেতগুলোর বিশ্লেষণ, বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী, স্বাধীনতাযুদ্ধের সেক্টরসমূহ ও সহায়ক গ্রন্থ তালিকা ও নির্ঘণ্ট দেয়া আছে।

৩১০ পৃষ্ঠার ঝকঝকে ছাপা, উন্নত বাধাই সম্বলিত এই দৃষ্টিনন্দন বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ছয়শ টাকা। উৎসর্গ করা হয়েছে ‘স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদেরকে’। গ্রন্থটি চমৎকার ভূমিকা লিখেছেন, মেজর জেনারেল (অব.) আজিজুর রহমান, বীর-উত্তম। ভূমিকাটি পড়ে মনে হয়েছে এটি গ্রন্থটির মর্যাদা অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ভূমিকায় যেমন সামনের দিকে এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা আছে, তেমনি আছে অনুশোচনা, আত্মসমালোচনা এবং অকপটে নিজেদের ব্যর্থতার কথাও। তারপর আছে অন্ধকারে আলোর-ঝিলিকের মতো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আবারও বাংলাদেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে সেকথাটিও। ব্যাক-কাভারে আছে,  কে এম সফিউল্লাহ, বীরউত্তমের কথাও।

হাসান আজিজুল হক ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মহিলাদের অবদান’ শীর্ষক গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘অতীতকে জানার কাজ কখনোই সম্পূর্ণ হয় না, চূড়ান্ততো হয়ই না। জানার কাজ চলতে থাকে, ইতিহাস সৃষ্টি বা নির্মাণের কাজ একটা চলন্ত প্রক্রিয়া। আগেকার দিনে চশমা তৈরির মতো, কেবলই কাচ ঘষে যাওয়া, তাকে স্বচ্ছ থেকে স্বচ্ছতর করে তোলা, যাতে কাচের স্বচ্ছতার গুণে দৃষ্টিও স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে দৃশ্য ছবি, পুঙ্খানুপুঙ্খতা নিয়ে দেখা দেয় সমগ্রতা।’

এই গ্রন্থটি সম্পর্কে ঠিক একথাগুলোই বলা চলে। এই গ্রন্থেরও ছোটখাটো অপূর্ণতা আছে, থাকবে। কারণ, ইতিহাসে বড়জোর অন্যান্য যতিচিহ্নের ব্যবহার করা যায় কিন্তু কখনো পূর্ণচ্ছেদ ব্যবহার করা যায়।

পরিশেষে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার ভাষায় বলতে চাই:

রাখো নিন্দাবাণী, রাখো আপন সাধুত্ব অভিমান,
শুধু একমনে হও পার
এ প্রলয়- পারাবার
নতুন সৃষ্টির উপকূলে
নতুন বিজয়ধ্বজা তুলে।

আমি বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি।

স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা
লেখক: আনোয়ার শাহজাহান
প্রকাশক: বইপত্র, ঢাকা
প্রচ্ছদ: অনন্ত আকাশ
মূল্য: বাংলাদেশ ৬০০ টাকা, যুক্তরাষ্ট্র: ১০ ডলার

আপনার মন্তব্য