প্রচ্ছদ করতে গিয়ে লেখকের ভাবনাকেও মাথায় রাখতে হয় : মামুন হোসাইন

বাংলাদেশের অন্যতম প্রচ্ছদশিল্পী মামুন হোসাইনের সাথে প্রচ্ছদ নিয়ে আলাপচারিতা

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-২৩ ২৩:০০:৩১

 আপডেট: ২০১৬-০২-২৩ ২৩:২৮:৫৬

রেজা ঘটক:

শিল্পী মামুন হোসাইনের জন্ম ১৯৭৭ সালের ২১ জুন, ঝিনাইদহ, ব্যাপারীপাড়া।

শৈশব কৈশোরের বড় একটা অংশ কেটেছে গ্রামে। মা ছবি আঁকতেন। ফুল-লতা-পাতা-মাছ-গাছ-নদী-চাষি। সেসব আঁকা ছবি দিয়ে মা নকশি কাঁথা সেলাই করতেন। মায়ের আঁকা দেখতে দেখতে আঁকার প্রতি মামুনের ভালোবাসা তৈরি হয়। ফলে মামুনের ছবি আঁকার বীজ মায়ের থেকেই পাওয়া।

পড়াশুনা নারায়ণগঞ্জ চারুকলায়। কালি, তুলি, পেন্সিল, কলম দিয়েই মামুন আঁকতে পছন্দ করেন। শিল্পী মামুন হোসাইনের সাথে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন কথাসাহিত্যিক রেজা ঘটক

রেজা ঘটক: মামুন, তোমার আঁকাআঁকি’র শুরুর গল্পটা বল?
মামুন হোসাইন: আঁকাআঁকি শুরু সেই ছোটবেলা থেকেই। মা ছবি আঁকত। ফুল, লতা-পাতা, মাছ, গাছ, নদী, চাষি কত রকম যে বিষয় নিয়ে আঁকত। বেশিরভাগই ছিল নকশি কাঁথার মোটিভ। এবং সেগুলো সেলাই করত পরম যত্ন আর অবিশ্বাস্য দক্ষতায়। মায়ের আঁকা দেখতে দেখতে আঁকার প্রতি ভালোবাসা জন্মে। বলা যায় মা’ই আঁকাআঁকির বীজ বুনেছে আমার মধ্যে। আমার শৈশব কৈশোরের বড় একটা অংশ কেটেছে গ্রামে। সবুজ সুন্দর একটা গ্রাম। মায়ের আঁকা নকশি কাঁথার এই সব মোটিভের সাথে।   

রেজা ঘটক: কখন বুঝলে যে তুমি আর্টিস্ট হতে চলেছ?
মামুন হোসাইন: আর্টিস্ট হলাম কিনা সেটা তো এখনো বুঝতেই পারলাম না। এঁকে যাচ্ছি।  আসলে  নারায়ণগঞ্জ চারুকলায় ভর্তি হওয়ার পর থেকে বুঝলাম জীবনে ছবি আঁকা ছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই। করতে চাইও নি, এবং সেটাই করছি এখনো।

রেজা ঘটক: কোন মাধ্যমে এঁকে ভালো লাগে?
মামুন হোসাইন: আঁকাআঁকির সব মাধ্যমেই আলাদা আলাদা আনন্দ এবং সম্ভাবনা আছে। আসলে বিষয়বস্তুর প্রয়োজনে সব মাধ্যমেই আঁকা হয়। তবে কালি, তুলি, পেন্সিল, কলম, ইত্যাদি মাধ্যমে বেশি চর্চা করেছি বলে এগুলোতে দক্ষতাও বেশি।   

রেজা ঘটক: বইয়ের প্রচ্ছদ করছো কত বছর ধরে? এ পর্যন্ত কত প্রচ্ছদ করলা?
মামুন হোসাইন: চারুকলায় ভর্তি হওয়ার পরের বছর (১৯৯৮) থেকেই একটা দুটো করে প্রচ্ছদ করা শুরু। সংখ্যা তো হিসাব করি নাই। কত আর হবে? এই হাজার বারশো হতে পারে।

রেজা ঘটক: প্রচ্ছদ করার সময় তোমার মাথায় কী খেলা করে? কনটেন্টকে কীভাবে বিবেচনায় নাও?
মামুন হোসাইন: কনটেন্ট বা বিষয়বস্তুই সব। বস্তুত লেখাটার জন্মই আগে হয় তারপর না প্রচ্ছদ। তো লেখাটাকে বা লেখকের ভাবনাটাই এখানে প্রধান। একজন প্রচ্ছদ শিল্পীর সেই ভাবনার বাইরে যেয়ে আঁকাআঁকির কোন সুযোগই নেই। লেখকের ভাবনাকে প্রচ্ছদ সাইজ কাগজের মধ্যে যতদূর সম্ভব ফুটিয়ে তোলার জন্য কোন মাধ্যমে, কোন বিন্যাসে, কোন রঙে কোন ঢঙে.. আঁকতে হবে ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় মাথায় রাখতে হয় প্রচ্ছদ করতে গেলে।   

রেজা ঘটক: তোমার প্রিয় প্রচ্ছদ শিল্পী কে কে? কেন তাঁরা প্রিয়?
মামুন হোসাইন: আমার প্রচ্ছদ শিল্পের গুরু হলেন শিল্পী ধ্রুব এষ। প্রতিনিয়তই শিখছি তাঁর কাছ থেকে। আসলে ধ্রুব দা’র এক্সপেরিমেন্টের জগতটা এতটাই বৈচিত্র্যময় যে, আমি সে জগতের প্রেমে পড়ে আছি। আমি আঁকি, তাঁকে দেখাই, প্রশংসা করেন, বিস্মিত হন, আবার ভুল ত্রুটি নিয়েও কথা বলেন। আমি সমৃদ্ধ হই। মেধাবী শিল্পীতো অনেকেই আছেন। কিন্তু মেধা ও মননে? ধ্রুব দা’র মত খুব বেশি কি আছেন? শিল্পী সব্যসাচী হাজরা। প্রিয় শিল্পী, প্রিয় মানুষ। তাঁর কাজে রয়েছে নিজস্ব রঙ ও ঢং। খুব ভালো লাগে। আরও অনেকের কাজই ভাল লাগে। সব্যসাচী মিস্ত্রী, মেহেদী হক, বিপ্লব চক্রবর্তী, সাদাত, এদের কাজ মুগ্ধ করে। এই জগতটা তো ক্রমেই বড় হচ্ছে। নতুন নতুন শিল্পী আসছেন।এই মুহূর্তে নাম মনে করতে পারছিনা। ফেসবুকে দেখি। খুব ভাল করছেন সবাই।   
    
রেজা ঘটক: বাংলাদেশে প্রচ্ছদ শিল্পের ভবিষ্যৎ কেমন?
মামুন হোসাইন: লেখক, প্রকাশক, এবং শিল্পী এই তিনের মধ্যে পেশাদার সম্পর্কের একটা টানাপড়েন রয়েছে। সেটা নিশ্চিত করতে পারলে এই শিল্পের ভবিষ্যৎ ভাল।

রেজা ঘটক: ওপার বাংলার সঙ্গে যদি তুলনা করতে বলি, কাদের এগিয়ে রাখবা? কেন?
মামুন হোসাইন: আসলে এগিয়ে থাকা বা পিছিয়ে পড়ার বিষয়টা মানতে নারাজ। আমি তো কোন দৌড় প্রতিযোগিতায় নামি নাই। যেহেতু আমরা কেউ একই জায়গা থেকে একই সময়ে কাজ শুরু করি নাই, সেহেতু এগিয়ে থাকা বা পিছিয়ে পড়ার কোন ব্যাপারই নেই। যে যার মত কাজ করছে। তবে হ্যাঁ, প্রতিযোগিতা তো একটা আছেই, তা হল নিজের সাথে নিজের। নিজের বর্তমান কাজটাকেই নিজেই অতিক্রম করার চেষ্টা।

রেজা ঘটক: প্রচ্ছদ করার সময় তুমি কী ধরনের এক্সপেরিমেন্ট কর?
মামুন হোসাইন: যেহেতু প্রচ্ছদশিল্প একটা প্রযুক্তি নির্ভর শিল্প, তাই প্রযুক্তি নির্ভর এই যুগে, সমকালীন থাকার জন্য যে কোন ধরনের এক্সপেরিমেন্টই হতে পারে। এক্সপেরিমেন্ট নির্ভর করে বিষয়বস্তুর ওপর। বিষয়বস্তু বা লেখকের ভাবনাটা আমাকে যেভাবে নাড়া দিবে এক্সপেরিমেন্টটাও সেভাবেই হবে। হতে পারে রঙ রেখা ফটোগ্রাফি, ইন্টারনেট... ইত্যাদি নিজের মত করে ব্যবহার করা যেতেই পারে। তবে আমি ড্রইং বেস কাজ করতেই পছন্দ করি।   

রেজা ঘটক: প্রচ্ছদ আর পেইন্টিং-এর মধ্যে তুমি কোনটায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ কর?
মামুন হোসাইন: দুটো একেবারেই আলাদা আলাদা বিষয়। বইয়ের মোড়ক হল একশত ভাগ বাণিজ্যিক। এখানে লেখকের ভাবনা নিয়ে খেলা করা ছাড়া শিল্পীর অন্য কোন কিছু করার সুযোগই নেই। তবে প্রচ্ছদে শিল্পমান থাকাটা জরুরী। প্রচ্ছদ স্বতঃসিদ্ধ কোন বিষয় না। একটা নির্দিষ্ট বইয়ের অসংখ্য প্রচ্ছদ হতে পারে। আজ যেটা সেরা প্রচ্ছদ বলে মনে হচ্ছে আগামীতে সেটাও পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু লেখা পরিবর্তন হয় না। আর পেইন্টিং? এই জগতটা একেবারেই শিল্পীর নিজের। এখানে করো মাতব্বরি চলবে না। একজন শিল্পী যদি মনে করে সারাজীবন ধানক্ষেত এঁকে যাবেন, কোন ক্ষতি নেই।   

রেজা ঘটক: নতুন যারা প্রচ্ছদ শিল্পে আসছেন, তাদের জন্য তোমার পরামর্শ কী?
মামুন হোসাইন: দেখো, ভাবো, আঁক।

রেজা ঘটক: কোন সময় ছবি আঁকতে বেশি ভালো লাগে? রাতে না দিনে? কেন?
মামুন হোসাইন: বেশির ভাগ কাজ রাতেই করি। দীর্ঘদিনের অভ্যাস। সময়টা খুব নিরিবিলি থাকে এটাও একটা কারণ।  

রেজা ঘটক: প্রেমিকা আর আঁকাআঁকির মধ্যে কাকে বেশি সময় দাও?
মামুন হোসাইন: প্রেমিকা আর আঁকাআঁকি দুটোই অভিন্ন শব্দ আমার কাছে।

রেজা ঘটক: সাঁতার জানো? সাইকেল চালাতে জানো? এ দুটো'র মধ্যে কোনটা তোমার কাছে বেশি ক্রিয়েটিভ মনে হয়?
মামুন হোসাইন: হা হা হা । দুটোই জানি। শৈশবেই শিখেছি। একটু চেষ্টা করলে সবাই পারে। তবে মনে হয় সাঁতার শেখাটা একটু কঠিন। কারণ অনেকের পানি ভীতি থাকে।

রেজা ঘটক: শুনলাম ইদানিং তুমি টেলিভিশনে ছবি আঁকা শিখাও। ব্যাপারটা একটু গুছিয়ে বলতো, টেলিভিশন দেখে কী ছবি আঁকা শেখা যাবে তাহলে?
মামুন হোসাইন: ভেতরে তাগিদ না থাকলে, প্রেম না থাকলে, কাউকে আঁকা শেখানো যায় না। টেলিভিশন দেখে কেউ যদি সেটা অনুভব করে, আনন্দ পায় তবে সেটাই অনেক বড় ব্যাপার। পরে সে নিজ দায়িত্বে যেকোনো ভাবেই হোক, আঁকা শিখবে, এই তো।    

রেজা ঘটক: শীঘ্র কোনো আর্ট ক্যাম্প আছে তোমার? থাকলে জানাইবা কিন্তু!
মামুন হোসাইন: আপাতত নাই। অনেক ভাল লাগলো আপনার সাথে গল্প করে। ধন্যবাদ রেজা ভাই।
রেজা ঘটক: তোমার সাথে কথা বলেও আমার খুব ভালো লাগলো। তোমাকেও ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য