রাশেদ নবীর ছোটগল্প সংকলন ‘আমাদের কেউ না’

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-২৪ ০২:৩১:৫৩

হাসান গোর্কি:

বাংলাদেশের সমকালীন ছোটগল্প প্রেম-পরিণয়, দারিদ্র্য-ক্ষুধা, আকাঙ্ক্ষা-অনাচার বা সমাজ-সভ্যতার ছকবাঁধা ও কষ্টকল্পিত কাহিনীর পৌনঃপুনিকতায় আক্রান্ত। এই বাস্তবতা-সাহিত্য নিয়ে যারা কাজ করেন  সম্ভবত তাদের সবাই মানেন। এ সহজ সত্যটি স্বীকার করতে দোষ নেই যে  রবীন্দ্রনাথ যাকে “সহস্র বিস্মৃতি রাশি” বলেছেন বাংলাদেশের সমকালীন গল্পকারদের খুব কম সংখ্যক তাদের গল্পে সেটা তুলে আনার ক্ষমতা রাখেন।

কানাডা প্রবাসী গল্পকার রাশেদ নবী সেই ব্যতিক্রমীদের একজন যিনি মানব-মনন ও তার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সাবলীলভাবে তাঁর গল্পে ফুটিয়ে তুলতে পারেন, দৃশ্যমানতাকে অতিক্রম করতে পারেন এবং স্পষ্টতা ও অস্পষ্টতার সীমারেখায় লীন হতে পারেন।

এবারের বইমেলায় সমগ্র  প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে রাশেদ নবীর ছোটগল্প সংকলন “আমাদের কেউ না”। সংকলনটি ইতোমধ্যেই পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে গল্পগুলোর আঙ্গিকের ভিন্নতা এবং বলার ধরনে অসাধারণ নৈর্ব্যক্তিক ব্যঞ্জনার কারণে।

পটভূমি ও চরিত্র চিত্রণ এবং কাহিনী বিন্যাসে লেখকের ভাবাবেগহীন স্বতঃস্ফূর্ততা গল্পগুলোকে স্রোতস্বিনীর মত প্রবাহিত হতে দিয়েছে। গল্পের চরিত্রগুলো সুস্পষ্ট স্বাতন্ত্র্যে  চিত্রিত কিন্তু এক অদ্ভুত অভিন্ন বৈশিষ্ট্য আছে তাদের। সেট হতে পারে বৈপরীত্যের ঐক্য অথবা চিরায়ত মানবীয় প্রবৃত্তি।

প্রকাশকের ভাষায়, “ ...উপেক্ষা তাদের বিচলিত করেনা, অনুরাগ তাদেরকে আত্মপরায়ণ করে তোলে না। গভীর বোধের সাথে তারা অবলোকন করে সমাজের সাথে তাদের নৈকট্য ও দূরত্ব। কখনও কখনও তারা বিস্ময়ের সাথে আবিষ্কার করে সবচেয়ে অজটিল সম্পর্কও অদৃশ্য রহস্যের মোড়কে আবৃত...।”

যেমন “ণত্ব বিধান” গল্পে টিকেট ম্যানেজারের “... মুখাবয়বের রঙ বদলায়। বলিরেখায় বশ্যতা, বিনয় ও অনমনীয়তা পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়।” আলবার্ট ক্যামুর “দ্য আউটসাইডার” উপন্যাসে মখসো যেভাবে পরম নির্লিপ্ততায় তার পরিপার্শ্বকে দেখে,“ণত্ব বিধান” গল্পের মূল চরিত্রের মধ্যে আমরা তার ছায়া দেখতে পাই যদিও এই দুই গল্পের কাহিনীতে কোন মিল নেই।  

অন্য গল্পের চরিত্রগুলোও নিজেদের মত হেঁটে চলে পৃথিবীর পথে; মানব সমাজকে গভীর শিক্ষা দেওয়ার জন্য তার স্বাভাবিক পরিসরকে অযাচিত নীতিবাক্যে প্লাবিত করে না, কোন তত্ত্বকথা ছড়ায় না। মানুষ যেমন তার অবশ্যম্ভাবিতাকে সঙ্গী করে, নিয়তিকে মেনে নিয়ে প্রায়শ: প্রতিবাদহীনভাবে পথ পরিক্রম করে, রাশেদ নবীর গল্পের চরিত্ররাও সেভাবেই হেঁটে চলে।

“আমাদের কেউ না” গ্রন্থে প্রকৃতি এসেছে আড়ম্বরহীন, সহজ ঐশ্বর্যে, জলরঙে; সেখানে কোন আরোপিত মহিমা নেই। বরং সেখানে স্বতঃপ্রবৃত্ত অন্তর্নিহিত একটা দর্শন আছে: ঈশ্বর-নিরীশ্বর নয়, কোন বিধায়ক নয়; প্রকৃতিই প্রাণ ও প্রাণহীনতা, পুনরুজ্জীবন ও অপার বিস্মরণ।  হেরম্যান হেসের সিদ্ধার্থ “ওম” বা পূর্ণতার যে প্রতিধ্বনিতে ঈশ্বরের সন্ধান পেয়েছিলেন “কাহারা” গল্পের প্রথম পুরুষও প্রকৃতিকে দেখেছে অনেকটা সেভাবে:  “দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আমরা এই প্রান্তরে এসে দাঁড়াই। আমাদের পেছনে বিস্তৃত পতিত ভূমি, সামনে নিম্নভূমিতে উর্বর, দিগন্ত-ছোঁয়া সোনালি ধানের খেত। দিগন্ত-ছোঁয়া ধান খেতের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে মনে হয় এক নদী উর্বর ভূমির কাছে হৃদ্যতাবশত আবক্ষ জল নিয়ে অতলে নিমজ্জিত হয়েছে। আমরা সেই নিমজ্জন ও উজ্জীবনের পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছি।”

“আমাদের কেউ না”-র  মানুষগুলো এক অনির্ণেয় অস্পষ্টতা এবং পার্থিবতার দুর্জ্ঞেয় দুর্বিপাকের মধ্যে বাস করে।

রাশেদ নবী গল্পকার হিসেবে অন্যদের থেকে আলাদা এ কারণে যে তিনি জোর করে তার চরিত্রগুলোর বাহ্যিক বা অন্তর্গত অস্পষ্টতাকে দূর করতে চেষ্টা করেননি, যে অসীম দুর্জ্ঞেয়তা মানুষের অন্তহীন যাত্রাকে ঘিরে রেখেছে তিনি পাঠককে সঙ্গে নিয়ে তার দর্শক হিসেবে থাকতে চেয়েছেন; যেন সহযাত্রীকে সাথে নিয়ে কু-ঝিকঝিক ট্রেনের জানালা দিয়ে আলস্যে তাকিয়ে দূরে নদীর বুকে চলমান কোন ডিঙির মাঝির বৈঠা চালানো দেখা।  খুব আটপৌরে ঘটনায় উঠে এসেছে তার অবলোকন।

“আমাদের কেউ না” গল্পে আমরা দেখি  যুদ্ধ থেকে ফিরে না আসা কালুর জন্য তার মা গোপনে কাঁদে। লোকে ভাবে জিনের কান্না। এ কান্না এবং তা থেকে গ্রামময় সৃষ্ট রহস্য মানব সমাজের চিরায়ত অতৃপ্তি ও দুর্বোধ্যতার প্রতিচিত্র হিসাবে উপস্থাপিত হয়। কালুর মা খিদিরপুরে গিয়ে হলদি পরীর শরণাপন্ন হয়। পরী সারাদুপুর কড়ি চালান করে জানায় কালু ফিরে আসবে। কালু আসে না। চরণফকির যখন ভবানিগঞ্জে আস্তানা গেড়ে লাঠির মাথায় ধুলো চালান দিয়েও কালুকে ফেরাতে পারেনা তখন কালুর মা মহাস্থানগড়ের বাবাজির কাছে গিয়ে নতুন আশ্বাস নিয়ে ফিরে আসে, “কালু বেঁচে আছে।” ক্রমঅপসৃয়মান সম্ভাবনায়, নিরাশায়ও ফিকে বিবর্ণ প্রত্যাশাকে খড়কুটোর মত আঁকড়ে ধরে কালুর মা বেঁচে থাকে এবং মরে যায়। এ গল্পটির শেষ অনুচ্ছেদ পড়লে মনে হয় কাহিনীর বর্ণনাকারীর মত সমাজের অনেকেই ভুল, কিন্তু অসততহীন বিশ্বাস নিয়ে বাস করে: “তবে বড় হতে হতে আমরা যখন অতীত নিয়ে তর্ক করতে শিখলাম, যখন যুদ্ধ আর মৃত্যু নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে দলাদলি করতে ভালবাসতে শিখলাম, তখনও কালুর মা আর সোনা ফুফুর মত আমি, জামিল ভাই, হিটু, মধু আমরা বিশ্বাস করতাম, ‘কালু বেঁচে আছে।’ ”

রাশেদ নবী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে নেদারল্যান্ডস সরকারের বৃত্তি নিয়ে পাড়ি জমান ইউরোপে। পড়াশোনা শেষে কানাডায় গিয়ে নাগরিকত্ব নেন। বর্তমানে স্থায়ীভাবে বাস করছেন অটোয়ায়। সরকারি চাকরি করার পাশাপাশি নিয়মিত গল্প-প্রবন্ধ লেখেন।

“আমাদের কেউ না” প্রকাশ করেছে সমগ্র প্রকাশন। চার রঙা চমৎকার প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ। তেরোটি ছোট গল্প আছে এ সংকলনটিতে। বইটির মুল্য ধরা হয়েছে ২০০ টাকা। পাওয়া যাচ্ছে বই মেলার সমগ্র প্রকাশনের স্টলে। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে বইটি পেতে যোগাযোগ করুন (+১)৭৭৮ ৫৩৩ ৬৬৯১ নাম্বারে।

আপনার মন্তব্য