প্রকাশিত: ২০১৭-০২-০২ ১৯:৪২:০৪
জাকিয়া সুলতানা:
তিনি বলেন, এক অর্থে কবি হওয়াটা পৃথিবীর সবচে কঠিন ধর্ম। জীবনে অনেক কিছুর হওয়ার সম্ভাবনাকে একপাশে রেখে একজন কবিকে কবিত্ব বরণ করতে হয়। কবি মানেই যেন অদৃশ্য আরো কিছু চোখ দিয়ে পৃথিবীকে দেখা। সাধারণ লোকেরা যখন বাতাসকে বাতাসকে বাতাস বলেন কবিরা সেখানে শোনেন বাতাসের মন্ত্রধ্বনি।
এ জীবন কাউকে বেছে নিতে হয়না। জীবনই খুঁজে নেয় তাঁদের।
কবি খান রুহুল রুবেল কবিতা লিখেন খুব অল্প বয়স থেকেই এবং যে বয়সে সকলে ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ার অথবা চাকুরীজীবী হবার কথা ভাবছেন, তখন তার সজীব মস্তিষ্কে কেউ হয়ত কবিতার বীজ বুনে দিয়েছিল। তিনি নিজেই তার এক আত্মকথনে বলেছেন,
২০০৬ সাল। কোন এক মধ্যরাতে। কাজী নজরুল ইসলাম হল, সরকারি বিজ্ঞান কলেজ, ঢাকা। উচ্চ মাধ্যমিকের শেষ দিকে। মাথা ভর্তি চুলের জঙ্গল, এবং মাথার ভেতরে সজীব মস্তিষ্ক আর অজস্র স্বপ্নের ঝিঁঝিঁ। সমাজ বিপ্লব করতে হবে, ঝোলায় থাকবে কবিতা আর গণিতের বই। চাকরী করব না। ঢাকা শহরের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তারাশঙ্করের "কবি" উপন্যাসের চাইতে মহত্তম উপন্যাস লেখার ভাবনা বন্ধুদের বুঝিয়ে বলি।ইত্যকার নির্বোধ ভাবনা।
আবার তিনি জাহাজিও হতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন, একদিন নাবিকের বেশে দূর সমুদ্র পাড়ি দেবেন, দূরে সবুজ ক্যানোপি দেখে তার অরণ্যভ্রান্তি হবে। এসব ভাবতে গিয়ে লিখলেন-
অরণ্যভ্রান্তির ঠিক নিচে তুমি খুলে ফেলো হে নাবিক,
তোমার নিবিড় টুপি, তার্পিন, এরপর কাঠের সীমানা
কিছু পরে কুঠারের দিন এইদিকে শুরু হয়ে গেছে।।
মফস্বলের শ্যাওলা-মাখা গন্ধ নিয়ে ঢাকা শহরে কিছুটা বিব্রতভাবে হাজির হয়েছিলেন একদিন। 'শিরোনামহীন' ব্যান্ডের গানের কথায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছিলেন সেসময় । এই শহরের জনসমুদ্রে নিজেকে একলা জাহাজির মতো আলতো করে সরিয়ে রেখেছেন।
তালতলাকে কবিতার রাজধানী ঘোষণা দিয়ে হঠাৎ একদিন ডুব দিলেন নিজস্ব পৃথিবীতে। গতানুগতিক সমসাময়িকের চেয়ে কিছুটা আলাদা লোকটা প্রচারণার এই যুগে কঠোর কবিসন্ন্যাসী।শুধুমাত্র লিটলম্যাগ আর সাহিত্য পত্রিকাগুলোতে কিছুটা অনিয়মিত ভাবে ছাপানো কবিতাগুলোও ফেসবুকিও নীল দুনিয়ায় কম ভেসে বেড়িয়েছে, কারণ কবি কখনোই অন্যান্য বন্ধুদের ট্যাগ করে পড়ার জন্য পিড়াপীড়ি করেননি।
তাঁর এ নিঃস্পৃহতা অথবা প্রচার বিমুখতা কি নিজের কাছ থেকে, নিজের সহজাত কবি প্রবৃত্তির থেকে পালিয়ে বেড়ানো নয়?
আয়নার নিকটে যাই, গিয়ে কখনো দাঁড়াই না
আয়না তার নিজস্ব সঞ্চয়ে কিছুটা নত হয়ে আছে।
সঞ্চয়ে কেউ নত হয়না আজকাল, সঞ্চয় মানুষকে উদ্ধত করে, অথচ কবি বলেন যেন তিনি বা আয়না হলো ফলদায়ী বৃক্ষের মত, নিজের ফলের ভারে নত।
আর তাই তাঁর প্রথম সন্তানের মত প্রথম বইয়ের নাম হয়েছে "ডুবোপাহাড়"। যে পাহাড়কে আমরা উচ্চশিখর দুর্বিনীত বলে জানি সে যেন সমুদ্রের মতো আরো গভীর, আরো বিশালে নিমজ্জিত, লজ্জিত আর বিনীত।
কবি খান রুহুল রুবেল নিজেকে খুব নারীবান্ধব বলে মনে করেন। তার ভাষায় বন্ধুরা এ ক্ষেত্রে তাঁকে বলে "সোনালী হায়েনা"। নারীবান্ধব কি না, তা পরিমাপের সময় এখনো আসেনি তবু নারীর রহস্যময়তা তাঁকে বিস্মিত করে বইকি।
যেদিকে হাঁটো সেদিকেই হয় পথ
বাগানে দোলাও রহস্যময় নথ
ঘুরিয়ে তাকাও গ্রীবার উচ্চারণ
ভাঙতে গেলেই অশ্রু আয়োজন।
নবীন এ কবি গতানুগতিক ধারায় পথ চললে হয়ত সমসাময়িকের সবচে বেশি আলোচিত গদ্যকারও হতে পারতেন। তিনিই বলেছেন-
যে পাখি গান গায়, সে কখনো ওড়ে না
ওড়ে অথচ গায় এতটা প্রতিভাময়
কোন পাখি আমি আজও কোথাও দেখিনা।
হয়ত তাই একমাত্র কবিতাই লিখতে চেয়েছেন তিনি, যদিও তার গদ্য ফেলিয়ে ছড়িয়ে আছে পথে বিপথে।
কবিতাকে তিনি পাঠ করেন পবিত্র ধর্মীয় স্তবকের মতন আর কবিদের জন্য রয়েছে একপেশে পক্ষপাতিতা। বেছে নিয়েছেন কবি ধর্মের মতো কঠিন ধর্ম। অনেক অপেক্ষার পর এ কবিসন্ন্যাসীর প্রথম বই আসছে গ্রন্থমেলা ২০১৭ তেই।
মেলার মাঝামাঝি সময়ে বাতিঘরের পরিবেশনায় বইয়ের জাহাজ বের করছে "ডুবোপাহাড় "।
বইয়ের জাহাজ, যারা এতো দিন দেশের বাইরে থেকে অলাভজনক ভাবে অন্য ভাষার বই দেশে নিয়ে আসতো। এবারের মেলাতেই প্রথম প্রকাশক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। স্বল্প পরিসরে প্রথম বই নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও তাদের ইচ্ছা ভবিষ্যতে দেশের এমন নিভৃতচারী অনেক লেখক কবিকে নিয়ে কাজ করার। ইচ্ছা রাখছে বাংলার বই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাভাষীদের কাছে পোঁছে দেবার সেতু হিসাবে নিজেদের বই জগতে রাখতে। কবির এই বই পাওয়া যাবে বাতিঘরের ৪১০-৪১১ নাম্বার স্টলে। এ ছাড়াও www.facebook.com/boiyerjahaj/ পেইজে থেকেও কেনা যাবে।
যেহেতু প্রচার বিমুখ তাই পারিপার্শ্বিকেরই প্রচারের দায়। কবিরা মানুন আর না মানুন, পাণ্ডুলিপির সাধ হয় একদিন ডানা লাগিয়ে উড়বে। কবিতার ভুবনে বাঁধানো মলাটে এক শব্দসন্ত্রাসের আবির্ভাব ঘটতে যাচ্ছে। শুভ হোক এ শব্দবিপ্লব।
বই - ডুবোপাহাড়
কবি- খান রুহুল রুবেল
প্রচ্ছদ -রাজীব দত্ত
প্রকাশক- বইয়ের জাহাজ
পরিবেশক- বাতিঘর।
আপনার মন্তব্য