নিজস্ব প্রতিবেদক

২০ অক্টোবর, ২০১৫ ০১:৩৯

চলচ্চিত্রের দুর্দিন: একের পর এক সিনেমা হল ভেঙ্গে গড়ে উঠছে বিপণী বিতান

বাংলা চলচ্চিত্রের এখন দুঃসময় চলছে। সিনেমা হলে আসছেন না দর্শকরা। ফলে ব্যবসায়িক লোকসান গুণতে হচ্ছে সিনেমা হল ব্যবসায়ীদের। অব্যাহত ব্যবসায়ীক মন্দার কারণে সিলেট নগরীতে সিনেমা হল ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে একের পর এক সিনেমা হল। সিনেমা হল ভেঙ্গে গড়ে উঠছে বিপনী বিতান।

ব্যবসায় মন্দার কারনে গত দুই বছরে সিলেট নগরীর অন্তত ৬ টি সিনেমা হল ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। নগরীতে এখন কেবল নন্দিতা সিনেমা হলই টিকে আছে। নগরীর তালতলায় অবস্থিত নন্দিতা সিনেমা হলের অবস্থাও করুণ।
হল মালিকরা জানিয়েছেন, অব্যাহত লোকসানের সিনেমা হল ভেঙ্গে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন তারা।

এদিকে, একের পর এক সিনেমা হল ভেঙ্গে ফেলার কারনে নগরীতে বিনোদন কেন্দ্রের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বিশেষত নিন্মবিত্ত শ্রেণীর দর্শকরা বঞ্চিত হচ্ছেন চিত্তবিনোদনের সুযোগ থেকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দুই বছর আগেও সিলেট নগরীতে মোট ৭ টি সিনেমা হল ছিলো। তবে দুই বছরের মধ্যে এর ৬ টিই ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। গত দুই বছরে ভেঙ্গে ফেলা হয় নগরীর কদমতলী এলাকার 'দিলশাদ', ‘কাকলি’ ও বন্দরবাজারের 'লালকুঠি' সিনেমা হল। এর আগে ‘অবকাশ’, ‘রংমহল’ ও ‘মনিকা’ সিনেমা হল ভেঙ্গে ফেলা। অধিক মুনাফার আশায় এসব সিনেমা হল ভেঙ্গে এখন নির্মান করা হচ্ছে বহুতল বিপনী বিতান বা অ্যাপার্টমেন্ট।

বটেশ্বরের সেনা অডিটোরিয়াম বাদ দিলে নগরীতে এখনো টিকে আছে কেবল ‘নন্দিতা’ সিনেমা হল।

সরেজমিনে নগরী ঘুরে দেখা যায়, নগরীর বন্দরবাজারে রংমহল সিনেমা হলে স্থলে নির্মিত হয়েছে ‘রংমহল টাওয়ার’ নামের বহুতল বিপনী বিতান, তালতলায় অবকাশ সিনেমা হলের স্থলে খোলা হচ্ছে ‘জননী হাট বাজার’ নামের সুপার শপ। বাগবাড়িতে মনিকা সিনেমা হল ভাঙ্গার পর থেকে এ জায়গাটি খালি পড়ে আছে। মালিকপক্ষ এখানে অ্যাপার্টমেন্ট নির্মানের পরিকল্পনা করছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া নগরীর কদমতলীর কাকলি সিনেমা হল ভেঙ্গে নির্মিত হচ্ছে মার্কেট।

সিলেটের সিনেমা ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্রিটিশ আমলেই সিলেটে সিনেমা ব্যবসা চালু হয়। সিলেটে বঙ্গ বিহারী দাশ নামের এক ব্যক্তি প্রথম রঙমহল ও পরে লালকুঠি সিনেমা হল দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। সিলেট টকিস নামে তা পরিচিত ছিল। এরপর ধীরে ধীরে অপর সিনেমা হলগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়। নগরীর এক তালতলাতেই পাশাপাশি তিনটি সিনেমা হল ছিল। গত দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত সিনেমা হলে প্রচুর দর্শক আসতেন। সেসময় অনেক ভালো ভালো সিনেমা নির্মিত হওয়ায় ও স্যাটালাইট সংযোগের প্রসার না ঘটনায় দর্শকরা সিনেমা হলে এসেই ছবি দেখতেন। কিন্তু গত দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে দর্শকদের সিনেমা হলে আসার প্রবণতা কমতে থাকে। ভালো সিনেমা নির্মিত না হওয়া, ঘরে ঘরে ক্যাবল সংযোগ পৌঁছে যাওয়ার কারনে সিনেমা হল বিমূখ হয়ে পড়েছেন দর্শকরা। ফলে অব্যাহতভাবে লোকসান গুণতে হচ্ছে সিনেমা হল মালিকদের। এছাড়া উচ্চমাত্রায় করের কারনেও সিনেমা ব্যবসায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে অনেকে এ ব্যবসা গুটিয়ে ফেলছেন। ভেঙ্গে ফেলছেন সিনেমা হল। যারা এখনো টিকে আছেন তারাও লোকসানের বিত্ত থেকে বেরোতে পারছেন না।

এ ব্যাপারে নগরীর নন্দিতা সিনেমা হলের ব্যবস্থাপক কয়ছর আহমদ বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই ব্যবসায় মন্দা ছলছে। একমাত্র ঈদ মৌসুম ছাড়া বছরের অন্য সময়গুলোতে হলে দর্শক সমাগম হয় খুবই কম। ফলে মূলধন উদ্ধারই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া সিনেমা হলের জন্য উচ্চমাত্রায় করের বিধান আমাদের জন্য মরার উপর খড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। এ অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণ ঘটানো সম্ভব না হলে একেএকে সব সিনেমা হলই বন্ধ হয়ে যাবে।

এ ব্যাপারে ভেঙ্গে ফেলা কাকলি সিনেমা হলের সত্ত্বাধিকারী, সিটি কাউন্সিলর তৌফিক বকস লিপন বলেন, আমরা ১৯৮৬ সালে হলটি নির্মান করি। প্রথমদিকে ভালো ব্যবসা হলেও পরবর্তীতে ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়। অব্যাহত লোকসানের কারনে আমরা সিনেমা হলটি ভেঙ্গে ফেলি। এখানে এখন বিপনী বিতান ও অ্যাপার্টমেন্ট তৈরির পরিকল্পনা করছি আমরা।

এ ব্যাপারে সিলেটের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিমাংশু বিশ্বাস বলেন, সিলেটে এমনিতেই তেমন কোনো চিত্তবিনোদন কেন্দ্র নেই। তারউপর একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে পড়ার বিনোদনের সুযোগহীন নগরে পরিণত হচ্ছে সিলেট। বিশেষ করে নিন্মবিত্তশ্রেণীর লোকজন পড়ছেন বিপাকে। আর বিনোদনের অভাবের কারনে তরুণ প্রজন্ম বিপথগামী হওয়ারও শঙ্কা রয়েছে। তাই সরকার, সিনেমা নির্মাতা, হল মালিকসহ সকলে মিলে এই অবস্থা থেকে উত্তোরণের পথ খুঁজে বের করা উচিত।

সিলেট সিনেমা হল মালিক সমিতির সভাপতি কলন্দর আলী জানান, সিলেটে এখন এক নন্দিতা সিনেমা হলই টিকে আছে। তবে এটি পরিচালিত হচ্ছে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। ঢাকার প্রতিষ্ঠান লিজ নিয়ে এটি পরিচালনা করছে। কিন্তু এক মাত্র হল হওয়ার পরও সেটি দর্শক শূন্যতায় রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটিও যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ছবি ও হলের মান এবং অশ্লীলতাকে দর্শক কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত