অঞ্জন আচার্য

২৩ এপ্রিল, ২০১৫ ১৫:১২

স্মরণ: জানা-অজানা সত্যজিৎ রায়

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক, বহুমাত্রিক প্রতিভাধর সত্যজিৎ রায় প্রয়াত হন ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল। ১৯২১ সালের ২ মে কলকাতায় জন্ম হলেও তাঁর আদি পৈত্রিক ভিটা ছিল বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার মসুয়া গ্রামে। পৈত্রিক বাড়িটি এখনও রয়েছে সেখানে। ওখানেই তাঁর পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং বাবা সুকুমার রায়ের জন্ম। 

ডাক নাম তাঁর মানিক। পোশাকি নাম সত্যজিৎ রায়। সত্যজিতের জন্মের মাত্র তিন বছর বয়সেই মারা যান বাবা সুকুমার। মা সুপ্রভা দেবী বহু কষ্টে বড় করেন তাঁকে। বড় হয়ে সত্যজিৎ কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে যান অর্থনীতি পড়তে। যদিও চারুকলার প্রতি সবসময়েই ছিল তাঁর বিশেষ দুর্বলতা। 

১৯৪০ সালে সত্যজিতের মা তাঁকে পীড়াপীড়ি করতে থাকেন শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য। তবে কলকাতাপ্রেমী সত্যজিৎ শান্তিনিকেতনের শিক্ষার পরিবেশ সম্পর্কে খুব একটা উঁচু ধারণা পোষণ করতেন না। কিন্তু শেষে মায়ের প্ররোচনা ও রবিঠাকুরের প্রতি শ্রদ্ধার ফলে রাজি হন তিনি। শান্তিনিকেতনে গিয়ে সত্যজিৎ প্রাচ্যের শিল্পের মর্যাদা উপলব্ধি করতে সক্ষম হন।

পরে তিনি স্বীকার করেন, সেখানকার বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু এবং বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে তিনি শিখেছিলেন অনেক কিছু। পরবর্তী সময়ে বিনোদবিহারীর ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্রও বানান সত্যজিৎ। অজন্তা, ইলোরা এবং এলিফ্যান্টায় ভ্রমণের পর ভারতীয় শিল্পের ওপর সত্যজিতের গভীর শ্রদ্ধা ও অনুরাগ জন্মায়।

এদিকে নিয়মানুযায়ী বিশ্বভারতীতে সত্যজিতের পাঁচ বছর পড়াশোনা করার কথা থাকলেও এর আগেই ১৯৪৩ সালে তিনি শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন এবং সেখানে ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থা ডিজে কিমারে ‘জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার’ হিসেবে যোগ দেন মাত্র ৮০ টাকা বেতনে।

চিত্রসজ্জা বা ভিজুয়াল ডিজাইন সত্যজিতের ছিল পছন্দের একটি বিষয় এবং সংস্থাটিতে তিনি ছিলেন ভাল সমাদরেই। কিন্তু সংস্থাটির ইংরেজ ও ভারতীয় কর্মচারীদের মধ্যে তখন বিরাজ করছিল চাপা ক্ষোভ। কারণ একই পদে থেকেও ইংরেজ কর্মচারীদের দেয়া হতো অনেক বেশি বেতন।

১৯৪৩ সালের দিকে সত্যজিৎ জড়িয়ে পড়েন ডিকে গুপ্তের প্রকাশনা সংস্থা সিগনেট প্রেসের সঙ্গে। ডিকে গুপ্ত তাঁকে সিগনেট প্রেস থেকে ছাপা বইগুলোর প্রচ্ছদ আঁকার অনুরোধ করেন, একই সঙ্গে এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ শৈল্পিক স্বাধীনতা দেন তাঁকে। ওই প্রতিষ্ঠানে থেকে অসংখ্য বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ করেন সত্যজিৎ। এছাড়া তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা কালজয়ী বাংলা উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’র একটি শিশুতোষ সংস্করণ ‘আমআঁটির ভেঁপু’র ওপরেও কাজ করেন তিনি।

বিভূতিভূষণের লেখা এ উপন্যাসটি সত্যজিৎকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে এবং এটিকেই পরবর্তীকালে সত্যজিৎ তাঁর প্রথম চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু হিসেবে নির্বাচন করেন। বইটির প্রচ্ছদ আঁকা ছাড়াও তিনি এর ভেতরের অলঙ্করণও করেছেন। এই ছবিগুলোই পরে দৃশ্য বা শট হিসেবে স্থান পায় তাঁর সাড়া জাগানো চলচ্চিত্রে।

এদিকে ১৯৪৭ সালে সত্যজিৎ চিদানন্দ দাশগুপ্ত ও অন্যদের সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি। সোসাইটির সদস্য হওয়ার সুবাদে তাঁর সুযোগ হয় অনেক বিদেশী চলচ্চিত্র দেখার। এ সময় তিনি প্রচুর ছবি গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতায় অবস্থানরত মার্কিন সেনাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন; তাদের কাছ থেকে শহরে আসা নতুন মার্কিন চলচ্চিত্রগুলোর খবর নিতেন তিনি। এ সময় তিনি নরম্যান ক্লেয়ার নামের রয়েল এয়ার ফোর্সের এক কর্মচারীর সান্নিধ্যে আসেন, যিনি সত্যজিতের মতোই চলচ্চিত্র, দাবা ও পাশ্চাত্যের ধ্রুপদী সঙ্গীত পছন্দ করতেন।

১৯৪৯ সালে সত্যজিৎ বিয়ে করেন তাঁর দূরসম্পর্কের বোন ও বহুদিনের বান্ধবী বিজয়া দাশকে। সত্যজিৎ দম্পতির ঘরে ছেলে সন্দ্বীপ রায়ের জন্ম হয়, যিনি নিজেও বর্তমানে একজন প্রথিতযশা চলচ্চিত্র পরিচালক। ওই একই বছরে জ্যাঁ রেনোয়ার তাঁর দ্য রিভার চলচ্চিত্রটির শূটিং করতে আসেন কলকাতায়। রেনোয়ারকে গ্রামাঞ্চলে চিত্রস্থান খুঁজতে সহায়তা করেন সত্যজিৎ। ওই সময়েই রনোয়ারের সঙ্গে ‘পথের পাঁচালী’র চলচ্চিত্রায়ণ নিয়ে কথা বলেন তিনি। রেনোয়ার এ ব্যাপারে তাঁকে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দেন।

১৯৫০ সালে ডি জে কিমার সত্যজিৎকে লন্ডনে তাদের প্রধান কার্যালয়ে কাজ করতে পাঠান। লন্ডনে তিন মাস থাকাকালেই সত্যজিৎ প্রায় ৯৯টি চলচ্চিত্র দেখেন। এদের মধ্যে ইতালীয় নব্য বাস্তবতাবাদী ছবি ‘লাদ্রি ডি বিচিক্লেত্তে’ (‘সাইকেল চোর’) তাঁর ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। পরবর্তীকালে সত্যজিৎ একসময় বলেছেন, ওই ছবিটি দেখে সিনেমা হল থেকে বের হওয়ার সময়েই তিনি ঠিক করেন যে, তিনি একজন চলচ্চিত্রকার হবেন।

সত্যজিৎ ঠিক করেন যে, বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদী ‘পথের পাঁচালী’ই হবে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্রের প্রতিপাদ্য। ১৯৫২ সালের শেষ দিকে সত্যজিৎ তাঁর নিজের জমানো পয়সা খরচ করে দৃশ্যগ্রহণ শুরু করেন। তিনি ভেবেছিলেন প্রাথমিক দৃশ্যগুলো দেখার পরে হয়ত কেউ ছবিটিতে অর্থলগ্নি করবেন। কিন্তু সে ধরনের আর্থিক সহায়তা মিলছিল না তাঁর।

‘পথের পাঁচালী’র দৃশ্যগ্রহণ তাই থেমে থেমে অস্বাভাবিকভাবে প্রায় দীর্ঘ তিন বছর ধরে সম্পন্ন হয়। কেবল তখনই দৃশ্যগ্রহণ করা সম্ভব হতো যখন সত্যজিৎ বা নির্মাণ ব্যবস্থাপক অনিল চৌধুরী প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান করতে পারতেন। শেষপর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের থেকে ঋণ নিয়ে ১৯৫৫ সালে ছবিটি নির্মাণ সম্পন্ন হয় এবং ওই বছরই সেটি মুক্তি পায়। মুক্তি পাওয়ার পর পরই ছবিটি দর্শক-সমালোচক সবার অকুণ্ঠ প্রশংসা লাভ করে এবং সেই সঙ্গে বহু পুরস্কার জিতে নেয়। বহুদিন ধরে ভারতে ও ভারতের বাইরে প্রদর্শিত হয় ছবিটি। সেটি নির্মাণের সময় অর্থের বিনিময়ে চিত্রনাট্য বদলের জন্য কোন অনুরোধই সত্যজিৎ রাখেননি। এমনকি ছবিটির একটি সুখী সমাপ্তির (যেখানে ছবির কাহিনীর শেষে অপুর সংসার একটি ‘উন্নয়ন প্রকল্পে’ যোগ দেয়) জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুরোধও তিনি উপেক্ষা করেন।

ব্যক্তিগত জীবনের ওপর কর্মজীবনের সাফল্যের তেমন কোন প্রভাব পড়েনি সত্যজিতের। তাঁর নিজস্ব কোন বাড়ি ছিল না; মা, মামা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে এক ভাড়া বাড়িতেই সারাজীবন কাটিয়ে দেন তিনি। আয়ের পরিমাণ কম হলেও নিজেকে বিত্তশালীই মনে করতেন সত্যজিৎ। কেননা পছন্দের বই বা সঙ্গীতের এ্যালবাম কিনতে কখনই কষ্ট হয়নি তাঁর। অন্যদিকে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সংবাদমাধ্যমে কখনই তেমন একটা আলোকপাত করা হয়নি। তবে কারও কারও মতে, ষাটের দশকে অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাঁর।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত