বিনোদন ডেস্ক

০৭ মে, ২০১৯ ১৭:১৪

‘আমার শবদেহের কাছে এসে সবাই যেন গান শোনায়’

তাঁর অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছিলো। তবু আশায় ছিলেন ভক্তরা। সে আসা আর পূর্ণ হলো না। সুস্থ হয়ে আর ফিরলেন না তিনি। বরং সব আশার ইতি টেনে না ফেরার দেশে চলে গেলেন নন্দিত সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দী। টানা ২২ দিন পর মঙ্গলবার(৭ মে) ভোর সাড়ে ৪টার দিকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়েছেন, চিরতরে।

সুবীর নন্দী যাওয়ার আগে কাটিয়ে গেছেন একটি পূর্ণাঙ্গ, পরিচ্ছন্ন ও সফল জীবন। কাছের মানুষদের কাছে বলে গেছেন, তার মৃত্যুতে যেন কেউ না কাঁদেন। তাঁর শবদেহের পাশে এসে সবাই যেনো গান শোনায়- এমনটিই ইচ্ছে ছিলো গুণি এই শিল্পীর।

সুবীর নন্দীর মেয়ের মতোই ছিলেন কণ্ঠশিল্পী ফাহমিদা নবী। মৃত্যুর খবরটি পেয়ে অন্য অনেকের মতো তিনিও বিমর্ষতায় ডুবে যান।

স্মৃতি থেকে উদাস কণ্ঠে বলেন, ‘‘সুবীর কাকার সাথে আমি আর সুমা (সামিনা চৌধুরী) ‘ফেরারী বসন্ত’ ছবিতে গান করেছিলাম। ছবিতে বাবা এবং দুই কন্যার কণ্ঠে গানটি ছিলো। বাবার কণ্ঠ দিয়েছেন সুবীর কাকা আর দুই মেয়ের কণ্ঠ দিয়েছি আমরা দুই বোন। কাকার সঙ্গে এই গানটি গাওয়া আমাদের কাছে সৌভাগ্যের মতোই ছিলো।’’

ফাহমিদা আরও বলেন, ‘সুবীর কাকা আব্বার (কিংবদন্তি শিল্পী মাহমুদুন্নবী) গানের ভক্ত ছিলেন। আব্বাকে অনুসরণ করতেন। আব্বার ১০টি গান দিয়ে একটি অ্যালবামও করেছেন তিনি। সেই তখন থেকে কাকার প্রতি আমাদের ভক্তি ছিলো বাবা আর সন্তানের মতো। সবসময় আমাদেরকে তিনি মা বলে ডাকতেন, যেমন ডাকতেন তার একমাত্র সন্তান মৌকে।’

স্মৃতি হাতড়ে ফাহমিদা নবী বলেন, ‘‘আমি ‘সুরের আয়না’ নামের একটি নিয়মিত অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতাম। সেটির প্রথম পর্বে সুবীর কাকাকে পেয়েছিলাম। সেই পর্ব করতে গিয়ে কাকাকে নানান কথা জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেয়েছিলাম। বললাম, কাকা প্রতিটি মানুষের কতরকমের ইচ্ছা থাকে। আপনার একটা ইচ্ছার কথা বলেন। এমন প্রশ্নের জবাবে একটু আবেগ ভরা কণ্ঠে সুবীর কাকা বলেছিলেন একেবারে অচেনা অসাধারণ একটা কথা। যেমন কথা আমরা সচরাচর শুনি না। তিনি আমাকে বললেন, ‘আমার শেষ ইচ্ছা, মৃত্যুর পর কেউ যেন না কাঁদে। আমি চাই আমার শবদেহের কাছে এসে সবাই যেন গান শোনায়।’’
ফাহমিদা নবী

টানা ১৬ দিন রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) লাইফ সাপোর্টে ছিলেন সুবীর নন্দী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ৩০ এপ্রিল ঢাকার সিএমএইচ থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় একুশে পদকপ্রাপ্ত এই সংগীতশিল্পীকে। সেখানে দফায় দফায় হার্ট অ্যাটাক হয় তার।

গত ১৪ এপ্রিল রাতে সিলেট থেকে ঢাকায় ফেরার পথে ট্রেনে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন সুবীর নন্দী। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী ও কন্যা। রাত ১১টার দিকে তাকে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) নেওয়া হয়। হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে হার্ট অ্যাটাক করেন এই নন্দিত শিল্পী। এরপর তাকে দ্রুত লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে কিডনি ও হার্টের অসুখে ভুগছিলেন সুবীর নন্দী।

১৯৬৩ সালে তৃতীয় শ্রেণী থেকেই গান গাওয়া শুরু করেন সুবীর নন্দী। এরপর ১৯৬৭ সালে তিনি সিলেট বেতারে গান করেন। তার গানের ওস্তাদ ছিলেন গুরু বাবর আলী খান। লোকগানে ছিলেন বিদিত লাল দাশ।

সুবীর নন্দী গানের জগতে আসেন ১৯৭০ সালে ঢাকা রেডিওতে প্রথম রেকর্ডিংয়ের মধ্যদিয়ে। প্রথম গান ‘যদি কেউ ধূপ জ্বেলে দেয়’। গানটি লিখেছেন মোহাম্মদ মুজাক্কের এবং সুরারোপ করেন ওস্তাদ মীর কাসেম।

৪০ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে গেয়েছেন আড়াই হাজারেরও বেশি গান। বেতার থেকে টেলিভিশন, তারপর চলচ্চিত্রে গেয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান। চলচ্চিত্রে প্রথম গান করেন ১৯৭৬ সালে আব্দুস সামাদ পরিচালিত ‘সূর্যগ্রহণ’ চলচ্চিত্রে। ১৯৮১ সালে তার একক অ্যালবাম ‘সুবীর নন্দীর গান’ ডিসকো রেকর্ডিংয়ের ব্যানারে বাজারে আসে। তিনি গানের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ব্যাংকেও কর্মরত ছিলেন।

সুবীর নন্দী জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন চারবার। সংগীতে অবদানের জন্য এ বছর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক পান তিনি।

তার গাওয়া উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে- আমার এ দুটি চোখ, বন্ধু হতে চেয়ে, আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি, চাঁদের কলঙ্ক আছে, দিন যায় কথা থাকে, একটা ছিল সোনার কন্যা, হাজার মনের কাছে, কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো, পাহাড়ের কান্না, বন্ধু হতে চেয়ে তোমার প্রভৃতি।

১৯৫৩ সালের ১৯ নভেম্বর এই শিল্পী জন্মগ্রহণ করেন হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং থানায় নন্দীপাড়ার এক কায়স্থ সম্ভ্রান্ত সংগীত পরিবারে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত