জহিরুল হক বাপী

৩০ অক্টোবর, ২০১৫ ১০:৫৫

তাহিরপুর থানা : যেন এক পাখি অভয়াশ্রম!

মেঘালয় থেকে নেমে আসা ত্রিশটি ঝর্ণার স্রোতে বেঁচে থাকে সুনামগঞ্জের হাওরগুলো।

সীমান্ত উপজেলা তাহিরপুরের নাম খুব কম মানুষের জানা। কিন্তু টাঙ্গুয়া, মাইট্টা, শনির হাওরের কারণে তাহিরপুর নামটা একটু একটু করে পরিচিতি পাচ্ছে । বিখ্যাত এ তিন হাওর ছাড়াও এখানে আরও বেশ কয়েকটি হাওর আছে।

হাওর এলাকা দেশিও জলজ পাখিদের অভয়ারণ্য হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হয়নি। স্থানীয় একজন বৃদ্ধ বললেন তারা খেয়ে শেষ করে ফেলেছেন। এরপর এও জানালেন এখন যেমন চলছে তেমন চললে আরও বিশ বছর লাগবে পাখিদের আগের অবস্থায় ফিরতে।

সরকার, আইন এখন কঠিন হওয়াতে শীতে টাঙ্গুয়া, মাইট্টার হাওড়ে বিদেশি পাখি আসে প্রচুর। সেই সাথে দেশি পাখিও আসে। অথচ পুরো বছরই দেশি পাখি থাকার কথা। নাই। এটা কোন তথ্য না। বেশ কবার হাওর এলাকায় ঘুরাঘুরি করার অভিজ্ঞতা। শিকার বন্ধ হলেও পাখি না থাকার কারণটা এবার পরিস্কার হলো।

গাছের অভাব। সাধারণ গাছ লাগানোর তো জায়গাই নেই কিন্তু করচ, হিজল যে পরিমাণ থাকার কথা, নাই। কিছু দিন আগে "হাওর পাড়ের ধামাইল ( হাপাধা)" এর সজল সরকার ও বিমান তালুকদারের আমন্ত্রণে আমি ও আনোয়ার স্যার (ড. মো. আনোয়ার হোসেন) যাই জাতীয় হাওর উৎসবে।

গতবার মধ্যনগরে হলেও এবার হলো তাহিরপুরের শনির হাওরের পাড়ে। সেখানে পরিচয় ওসি শহীদুল্লাহ ও ওসি ( তদন্ত ) মো হানিফ সাহেবের সাথে। আমাদেরকে তাঁরা থানায় পাখি দেখতে যাওয়ার আমন্ত্রণ করলেন। আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েক জনও থানায় যেতে বলল পাখি দেখতে। আনোয়ার স্যারের তখনকার মনোভাব জানি না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল ওসি শহীদুল্লাহকে তেল দেওয়ার জন্য বাকিরা উৎসাহ দিচ্ছে ।

ওসি সাহেবকে কিছুটা মৃদুভাষী মনে হলো। রাতে থানায় যাই। ঢোকার সাথে সাথে বাজে গন্ধ নাকে আসল। রাত আটটার মতো বাজে। থানায় আসলে এসেছি দাওয়াত খেতে। ওসি সাহেব পাখি দেখাতে চাইলেও আনোয়ার স্যার বা আমি রাজী হলাম না। টর্চ মারলে পাখিদের সমস্যা হবে ভেবে। তারা বললেন সমস্যা নাই। টর্চ মারলেন। শব্দ শুনলাম কিন্তু স্পষ্ট দেখলাম না কিছু।

আমার ধারণা ছিল, কোন গাছে পাঁচ দশটা পাখি বাসা বেঁধেছে। এ নিয়ে মাতামাতি। পাখি দেখা যায় খুব ভোরে আর বিকেলে। পরদিন ভোরে ওসি সাহেব টাঙ্গুয়া, টেকেরহাট নিয়ে যাবেন। খুব ভোরে আসা হলোনা। থানায় আসতে আসতে রোদ ওঠা শুরু । থানার কাছাকাছি আসতেই পাখিদের কিচির মিচির শুনলাম। থানা কম্পাউন্ড ভর্তি গাছ গাছালি তাই তখনও ডালে ডালে অন্ধকার জমেছিল। তখনও স্পষ্ট কিছু দেখলাম না । তবে একটা গাছে বেশ কিছু বাসা বলে মনে হলো।

ওসি সাহেব বললেন পাখিরা নাই। আরও আগে চলে যায়। এখন কিছু বাচ্চা আছে। একটু রোদ ওঠার পর দেখলাম পুরা থানা কম্পাউন্ড পাখিদের পায়খানায় সাদা। রোদ উঠলেও থানা কম্পাউন্ড ছায়া। একটা গাছ দেখে আমরা দুজনেই অবাক। আমার সারা জীবনে এতো পানকৌড়ি দেখেছি সব যোগ করলেও এর চেয়ে কম হবে। হানিফ সাহেব খুব আক্ষেপ নিয়ে বললেন এখন তো সব চলে গেছে। বিকালে ফিরবে।

স্যার এবং আমি দুজনই মোবাইলে ছবি তোলার চেষ্টা করি। গাছগুলো অনেক উঁচু উঁচু। থানাতে পচা মাছ বা শুটকির গন্ধ কেন বুঝতে পারলাম ।

ওসি সাহেব জানালেন তিনি এসেছেন এখানে দশ মাস। বৃষ্টি-বাদলার সকালে গাছের নিচে পাখিদের বাচ্চা পড়ে থাকতে দেখে আর বড় পাখিদের বাচ্চা বাঁচানোর চেষ্টা তার সহ্য হতো না। মানুষজন ধরে নিয়ে যেত। তিনি এ বিষয়ে কঠিন হন। বড় গাছে বাচ্চা সব সময় তুলে দেওয়া সম্ভব না। মা বাচ্চা তুলতে না পারলে বাচ্চা নিচেই থাকবে। মরলে এখানেই মরবে।

সেই শুরু। ওসি সাহেব আরও জানালেন তিনি যতদিন থাকবেন ততদিন এই শুটকির গন্ধ সহ্য করতে হবে। জিজ্ঞেস করলাম, এ জন্য বাড়তি খরচ হয় কিনা? জানালেন হয় না। পাখিদের খাবার পাখিরাই যোগাড় করে। সপ্তাহে একদিন থানার ক্লিনারকে একটু বেশি কষ্ট করতে হয়। কখনও কখনও বিষ্ঠা, গন্ধ খুব বেশি হয়। তখন বাইরে থেকেও লোক নেওয়া হয়। পঞ্চশ/একশ' খরচ। তবে রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা নজর রাখে সবাই। সেন্ট্রিরা নজর রাখে কেউ পাখি ধরতে গাছে উঠে কিনা।

সকালের দিকে আমিই দেখেছি বাচ্চাদের ব্যাগ চেক করতে। ফজরের পরপর বাচ্চারা গাছের নিচে পাখি খুঁজতে আসে। পেলেই ব্যাগ,বাড়ি এবং খাওয়া। তবে বাচ্চাগুলো বড় হওয়াতে পড়ে কম। অনেক সময় মানুষজন গুলতি, ঢিল ছুড়ে পানকৌড়ি ফেলে দিত গাছ থেকে। এখন অকল্পনীয়। পুরো তাহিরপুর জানে পাখিদের গায়ে হাত দিলে মাফ নাই। সামাজিক বিচার/অনুরোধ/চাপ কিছুতেই কিছু হবে না। আইনের মূখোমূখি হতে হবেই।

সৎ সঙ্গে লোহা ভাসে- তার প্রমাণ এ থানা। থানার সবাই এখন পাখিপ্রেমিক। হাট তে চলতেই নজর রাখেন তাঁদের পাখিগুলোর প্রতি।

খুব কম বয়স্ক একজন সিপাহী জানালো প্রথম দিকে গন্ধে তার কষ্ট হতো। অবাক হতো পানকৌড়িদের জন্য আলাদা নজর, বাচ্চা পড়ে গেলে, না খাওয়া দেখে। এখন রাতে পেশাব করতে উঠলে একবার হলে দেখে যাওয়ার চেষ্টা করে। ডিউটি না থাকলেও ঝড় বাদলার রাতে, ভোরে থানার সবার সাথে সেও নেমে পড়ে বাচ্চা বাচাতে। বলার সময় তাঁকে কিছুটা গর্বিত মনে হচ্ছিল।

থানার আশেপাশের মানুষজনও গর্বিত। থানার লাগোয়া দুই একটা গাছেও পাখিরা বাসা বাঁধা শুরু করেছে। একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ি খুব গর্ব নিয়ে বলেছিলেন আর দুই তিন বছরের মধ্যে তাহিরপুর টাউনের পাতা দেখা যাবে না পাখির জন্য। থানার গাছগুলোতে ইদানীং "মৌলভী পাখি"ও (স্থানীয় নাম) বাসা বাধা শুরু করেছে।

এ থানাটি হতে পারে মডেল থানা। বড় শহরের বাইরে প্রায় প্রতিটি থানা কম্পাউন্ডই বড়। গাছগাছালি আছে। একটা বটে এবং ছোট একটা বাঁশ ঝাড় করলে পাখি আসবেই। তার সাথে ফল,বিচি হয় এমন দু একটা গাছ লাগালে তো কথাই নেই। থানার মানুষজন একটু খেয়াল রাখলেই প্রতিটি থানা হয়ে ওঠবে পাখিদের অভয়াশ্রম। এর জন্য শ'শ কোটি টাকার বাজেট প্রয়োজন নাই। পরিবেশ ও সরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইচ্ছে দরকার কেবল। একটা নির্দেশনা আর একটু মনিটরিং। থানার নিয়মিত কাজেরও ক্ষতি হবে না। বরং সুন্দর একটা কাজের সাথে থাকার কারণ আত্মিক উন্নয়ন হচ্ছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত