তপন কুমার দাস

০১ ফেব্রুয়ারি , ২০১৫ ২০:৪৮

প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর পাথারিয়া পাহাড়

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুপম সৃষ্টি উপজেলার উত্তর ও পূর্বে পাথারিয়া পাহাড় অঞ্চল। উত্তর-দক্ষিণে প্রায় পঁচিশ মাইল বিস্তৃত।


মৌলভীবাজার জেলার উত্তর প্রান্তিক জনপদ বড়লেখা উপজেলা। অনিন্দ্যসুন্দর নিসর্গের এক মায়াপুরী এ উপজেলা। পূর্বে ভারতের প্রায় বিশ কিলোমিটার স্থল সীমান্ত। দক্ষিণে জুড়ী ও কুলাউড়া। পশ্চিমে প্রান্তে রয়েছে সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলা। শুধু নামে নয়, বড়লেখা গুনেও বড়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত ও এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকি এ উপজেলায়। আতরের জন্য প্রসিদ্ধ এ উপজেলার সুজানগর ইউনিয়ন। আছে দু’টি বিশেষ আদিবাসী সম্প্রদায় খাসিয়া ও মণিপুরী। সুন্দর মণিপুরী নৃত্য কমনীয়তার জন্য সুবিখ্যাত।

আধা পাহাড়ি জায়গা। আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়। সর্বাঙ্গে মেঘের ওড়না। ভারত সীমান্তে কাঁটতারের বেড়া। ছোট ছোট গ্রাম। সুনাই, জুরী, ধামাই-এর সরু সরু আঁকাবাঁকা নদী। পাহাড়ি টিলা কেটে নির্মাণ করা হয়েছে বাড়ি। উঁচু উঁচু বাঁশের সিঁড়ি। লেপামোছা মাটির দেয়াল। নিকানো উঠান। ফুলের বাহার। রঙ্গিন প্রজাপতি। ছড়ার কলকল ধ্বনি। বাঁশের ঝাড়ের মাঝে ছায়া¯িœগ্ধ পায়ে চলার পথ। শান্তি যেন জড়িয়ে সর্বত্র। এর মাঝে মিলেমিশে বাস করে বাঙালি ও পাহাড়ি। বাহুল্য নেই কোথাও, তবু দিন চলে। শিশুদের মাতামাতি ও হাসি কান্না আনে বৈচিত্র্য।

আয়তন ও ইতিহাস

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুপম সৃষ্টি উপজেলার উত্তর ও পূর্বে পাথারিয়া পাহাড় অঞ্চল। উত্তর-দক্ষিণে প্রায় পঁচিশ মাইল বিস্তৃত। পাথারিয়ার চিরহরিৎ বনাঞ্চল বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ। পাথারিয়া পাহাড়ের জন্ম প্লায়োস্টিসিন কালের মধ্যভাগে, অর্থাৎ দেড় থেকে দু’-কোটি বছর আগে। বড়লেখার পাথারিয়া বনভূমি থেকে হাকালুকি হাওর যেন বড়লেখা থানার পূর্ব-পশ্চিম পাড়ের গীতিময় কথোপকথন। পাথারিয়া পাহাড়ে আছে তিনটি উল্লেখ যোগ্য শৃঙ্গ। যথা দূরবীনটিলা, গগনটিলা ও রাজবাড়ি টিলা ইত্যাদি। এগুলোর উচ্ছতা প্রায় দুই শত চুয়াল্লিশ মিটার। হাতের মাপে প্রায় পাঁচশত চৌত্রিশ হাত।
 
আমার অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল পাথারিয়া পাহাড়ে যাওয়ার। একদিন ঠিকই সুযোগ হাতের মুঠোয় ধরা দিল। গত ১৭ জানুয়ারি শনিবার সকালে বড়লেখা পৌর শহরের দক্ষিণ বাজার থেকে সিএনজি যোগে পৌঁছলাম ডিমাই বাজারে। আমার সঙ্গে ছিলো অনুজ এজে লাভলু। ডিমাই বাজারে পৌঁছার পর আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন স্থানীয় ৫নং পুঞ্জির বাসিন্দা বিজয় লন্ড, কলেজ শিক্ষক মুফিজুর রহমান রাসেল, ব্যবসায়ী সাহেদ আহমদ, সুরমান আলী। একটা ছোট পাহাড়ি গ্রাম পেরিয়ে একেবারেই পাহাড়ের পাদ দেশ হেঁটে হেঁটে গিরি পথে প্রবেশ করতে শুরু করলাম। কিছু দূর গিয়ে সামনে পড়ল স্বচ্ছ জলের একটি ছড়া। যার কলকলিয়ে বয়ে চলা ঠান্ডা জল সুনসান প্রকৃতিকে দিয়েছে অন্যরকম এক ছন্দ। গিরি পথে প্রায় ৩০ মিনিট হাটার পর ছড়ার পাশের বিশাল পাথরের উপর কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলাম। সাদা সাদা নুড়ি পাথরের উপর দিয়ে কল কলিয়ে বয়ে যাচ্ছে টলমলে জল। দেখলে যে কারোরই চোখ জুড়িয়ে যাবে।

প্রাকৃতিক তেলকূপ
পাহাড়ের চারদিকে সবুজের পরিবেশ। ওপরে নীল আকাশ, নিচে থরে থরে সাজানো আকাশ চুম্বি পাথারিয়া পাহাড়। বিশাল পাহাড় মাথা উঁচু করে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিধাতা যেনো পাহাড়টিকে তুলির অপূর্ব আঁচড়ে অপরূপ রূপে রূপায়িত করেছেন।
এই পাহাড় প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ। পাথারিয়া পাহাড়ে আছে তেলকূপ, এখান থেকে তেল উত্তোলনের জন্য বার্মা অয়েল কোম্পানি (বিওসি) ১৯৩৩ সালে তেলকূপ খননের চেষ্টা চালানোর সময় পাইপ ফেটে যায়। তেলের উর্ধ্বচাপে তা উপত্যকা ও পাশ্ববর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে জনমনে ভীতির সঞ্চার হয়। কয়েকদিন তেলের বন্যা বয়ে যায়। বর্তমানে এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে তবে এখনও তেলকূপের ঢাকনির ওপর কান রাখলে তেলের গমগম শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। এক সময়ে স্থানীয় লোকেরা এই তেল সংগ্রহ করে পিদিম বা কুপির জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করত।

জীববৈচিত্রে পাথারিয়া
পাথারিয়া পাহাড়ের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র সম্পর্কে এই এলাকারই বেড়ে ওঠা সন্তান বোটানিস্ট ও অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা বলেন- পাথারিয় পাহাড়ে বড়বড় গাছ, বাঁশঝাড়, অজস্র জাতের লতা, ঢাউস পাতার বুনো রামকলার ঝোঁপ। ফুলের মধ্যে আছে আশোক, দেবকাঞ্চন, কনকচাঁপা, পারুল, জংলীজুঁই, নাগবাল্লী, লুটকি, নীললতা, টালি, ল্যডিস আম্ব্রেলা, ডুলিচাঁপা, ম্যাগনোলিয়া এবং আরো নানান জাতের ফুল। ফল-ফসলের মধ্যে আছে বিভিন্ন রকমের শাক, কচু, লতি, বাঁশের খোড়ল (করিল), লেবু, রামকলা, ডেউয়া, লুকলুকি, ক্ষুদিজাম, চালতা, জাম, বহেড়া, হরিতকি, বুনো আম, কাঠাল, আমলকি, গোলাপজাম, সাতকরা লেবু, তৈকর, আশফল, গুঙ্গাআলু এবং আরও নানা জাতের পাহাড়ি ফলমূল। এই পাহাড়ে রয়েছে বিচিত্র রকমের বন্যপ্রাণী জংলী হাতি, বানর, হনুমান, বাগডাস, মেছোবাঘ, বনরুই, হরিণ, খরগোস, অজগর সাপ প্রভূতি। পাখ-পাখালির মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। বনমোরগ, শকুন, ঈগল, তিতির, শ্যামা, ভিমরাজ ও আরো বিভিন্নজাতের পাখি। তবে অবাধে বন্যপ্রাণী শিকার করার কারণে এখন আর আগের মতো দেখতে পাওয়া যায়না।
পাথারিয়া পাহাড়ের বুকে সৃষ্ট বড়লেখার ঐতিহ্য মাধবতীর্থ মাধবকুন্ড দেশের তথা বিশ্বের পর্যটন মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে। মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের ধারাপতনের অবিরাম শব্দ সৃষ্টি করছে মায়াময় পরিবেশের। প্রকৃতি যেন বর্ণনার উৎস নিয়ে সামনে দাঁড়ায়। পাথারিয়া পাহাড় কঠিন পাথরে গঠিত। পাহাড়ের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে প্রবহমান ছড়া রয়েছে। উপরের অংশ গঙ্গামারা আর নীচের অংশ মাধবছড়া। মাধবছড়া পাথারিয়া পাহাড়ের গঙ্গামারা থেকে গড়িয়ে আসা জল প্রায় দুই শত ফুট উঁচু থেকে নীচে খাড়াভাবে গড়িয়ে পড়ছে।
পাথারিয়া পাহাড় এখন আর আগের মতো নেই। এখন এখানে রাস্তা তৈরি হয়েছে। ট্রাক ও নানান জাতের গাড়ি চলছে। পাহাড়ের শান্ত পরিবেশ, পাখিদের গুঞ্জন নানান রকমের গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দে চাপা পড়ে যাচ্ছে। ট্রাক্টর ও টেম্পু ইঞ্জিনের শব্দের সঙ্গে ছাড়ছে বিষাক্ত ধোঁয়া। পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি তেরি হচ্ছে। চলছে পুকুর খনন। উঠছে দালান, অপরিকল্পিত দোকান পাট ইটভাটা আর করাতকল। বন ছাই হচ্ছে ইটলোকার জ্বালানী হয়ে। অবাধে চলছে বৃক্ষ নিধন। দেখার লোক আছে। হায়! ঠেকাবার কেউ নেই।



আপনার মন্তব্য

আলোচিত