অহী আলম রেজা

১৪ ফেব্রুয়ারি , ২০১৬ ১৩:৪৮

আজ শুধু ভালোবাসার দিন

আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা/ কেমনে ভুলিব আমি বাঁচি না তারে ছাড়া…। হ্যাঁ, মনের মানুষটি ছাড়া বাঁচা দায়। ভালবাসাহীন জীবন ভাল লাগে না কারও! আর তাই ভালোবাসার জন্য এত আকুলি বিকুলি। অনায়াসে ঘর ছাড়ে মানুষ। রাধারমণের ভাষায়- আমি রবো না রবো না গৃহে বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না…। একই কারণে মরমি সাধক হাসন রাজায় কয়- নিশা লাগিলরে, বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিলরে…।

ভাটি বাংলার এই লোককবির নিশা আর কাটেনি কোন দিন। বরং অনলে পুড়েছে ভেতর বাহির। কাউকে বলে তা বোঝাবার নয়। ভাটি বাংলার অসহায় প্রেমিক কবি তাই সুর তোলেন ধাক্ ধাক্ কইরা উঠল আগুন ধৈল আমার প্রাণে/সুরমা নদীর জল দিলে নিভে না সে কেনে…। বলা বাহুল্য, এ আগুন দ্বিগুণ করতে আবারও এসেছে ১৪ ফেব্রুয়ারি। ভালবাসার বিশেষ দিন ভ্যালেনটাইন্স ডে আজ। শাশ্বত প্রেমের কাছে নত হওয়ার দিন। ভালবাসার মহাঅনুভূতির কাছে নিজেকে নিশ্চিন্তে সঁপে দেয়ার উপযুক্ত সময়।

পাশ্চাত্যের প্রেমেপাগল মানুষ বহুকাল ধরে দিবসটি পালন করে আসছে। কিন্তু ভালবাসা যে একলা ঘরে বন্দী রাখার নয়। এর কোন পূর্ব-পশ্চিম হয় না। আর তাই নিজস্ব নিয়মে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ভ্যালেনটাইন্স ডে। পৌঁছে যায় বাংলাদেশেও। দিবসটি বর্তমানে বাঙালির বসন্ত দিনের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। প্রথম দিকে ফিস ফিস করে কাটিয়ে দিয়েছেন অনেকেই। এখন আর তা নয়। বিপুল আবেগ আর উন্মাদনায় দিবসটি পালন করেন প্রেমিক-প্রেমিকারা। আজও চঞ্চল হবে অসংখ্য হৃদয়। রাজপথে, ক্যাম্পাসে, পার্কে, রেস্টুরেন্টে প্রকাশ্যে ও গোপনে মিলবে তারা। একে অন্যের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলবে- নিরাশ্রয় পাঁচটি আঙুল তুমি নির্দ্বিধায়/ অলংকার করে নাও, এ আঙুল ছলনা জানে না…। প্রিয়জনের হৃদয়ে চিরকাল বাঁচার আকুতি জানিয়ে বলবে ভালবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে/ আমার নামটি লিখো- তোমার/ মনের মন্দিরে। আর যারা একলা মানুষ তারা হয়ত গুন গুন করে গাইবেন হাজার লোকের মাঝে রয়েছি একেলা যে-/ এসো আমার হঠাৎ-আলো, পরাণ চমকি তোলো…।

কারও কারও ভেতরে ভালবাসার সকল অনুভূতি তৈরি হয়ে থাকে। কিন্তু কার জন্য ব্যাকুল মন সেটি আর বোঝা হয় না। কবির ভাষায় যদি জানতে আমার কিসের ব্যথা তোমায় জানাতাম।/ যে আমায় কাঁদায় আমি কি জানি তার নাম…। কেউ আবার সবই জানেন। প্রিয় মানুষটির আশপাশে থাকেন সারাক্ষণ। কিন্তু মুখ ফুটে তা বলতে পারেন না। এমন প্রেমিক-প্রেমিকাদের মনের কথা তুলে ধরতেই হয়ত কবিগুরু বলেছিলেন আমি যে আর সইতে পারি নে।/ সুরে বাজে মনের মাঝে গো, কথা দিয়ে কইতে পারি নে। অন্যভাবে বললে লাগে বুকে সুখে দুখে কত যে ব্যথা,/ কেমনে বুঝায়ে কব না জানি কথা…। এভাবে নানা কথায় হরেক সুরে বাজবে প্রেম। প্রকাশিত হবে ভালবাসা।

তবে যে ভ্যালেনটাইন্স ডে ঘিরে এত আয়োজন উত্তেজনা সেটি নিয়ে আছে ভিন্ন ভিন্ন গল্প। কারও মতে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে উদ্যাপন শুরু হয় প্রাচীন রোমে। তখন ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল বিয়ের দেবি জুনোকে সম্মান জানানোর পবিত্র দিন। দিবসটি অনুসরণ করে পরের দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি উদযাপন করা হতো লুপারকেলিয়া উৎসব।

সে সময় তরুণ-তরুণীদের খোলামেলা দেখাসাক্ষাতের তেমন সুযোগ ছিল না। জীবনসঙ্গী নির্বাচনে তাদের জন্য ছিল লটারির মতো একটি আয়োজন। উৎসবের সন্ধ্যায় বেশ কিছু কাগজের টুকরোয় তরুণীদের নাম লিখে একটি পাত্রে রাখা হতো। একটি করে কাগজের টুকরো তুলত তরুণরা। কাগজের গায়ে যার নাম লেখা থাকত তাকে সঙ্গী হিসেবে পেত তরুণটি। কখনও কখনও ওই দু’জনের মিলনের ক্ষণ এক বছর স্থায়ী হতো। কখনও কখনও তা গড়াত বিয়েতে। নিষ্ঠুর সম্রাট ক্লদিয়াসের শাসনামলে রোম কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্তু তার সেনাবাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা কম ভর্তি হওয়ায় ক্লদিয়াস উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন।

তিনি ধারণা করতেন, পরিবার ও ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কারণেই যুদ্ধে যেতে রাজি হতো না পুরুষরা। ফলে ক্লদিয়াস সমগ্র রোমে সব ধরনের বিয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সে সময় রোমে ধর্মযাজকের দায়িত্ব পালন করছিলেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামের এক ব্যক্তি। তিনি এবং সেন্ট ম্যারিয়াস খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী তরুণ-তরুণীদের গোপনে বিয়ে দিতেন। বিবাহিত যুগলদের সহযোগিতা করতেন। এ অপরাধে রোমের ম্যাজিস্ট্রেট তাকে গ্রেফতার করে করাগারে নিক্ষেপ করেন। বন্দী থাকা অবস্থায় অনেক তরুণ তাকে দেখতে যেত। জানালা দিয়ে তার উদ্দেশে লেখা চিরকুট ও ফুল ছুড়ে দিত। হাত নেড়ে জানান দিত, তারা যুদ্ধ নয়, ভালবাসায় বিশ্বাসী। এদের মধ্যে একজন আবার ছিল কারারক্ষীর মেয়ে। তার বাবা তাকে ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিতেন।

এক পর্যায়ে তারা একে অপরের বন্ধু হয়ে যায়। শিক্ষকদের আগে ভ্যালেন্টাইন মেয়েটির উদ্দেশে একটি চিরকুট লিখে রেখে যান। এতে লেখা ছিল লাভ ফ্রম ইয়র ভ্যালেন্টাইন। বিচারকের নির্দেশ অনুসারে সে দিনই ভ্যালেনটাইনকে হত্যা করা হয়। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের এই আত্মত্যাগের দিনটি ছিল ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি।

কালের ধারাবাহিকতায় ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্রটি হয়ে ওঠেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। নানা সামাজিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বাহারি ফুল, কবিতা ও উপহার বিনিময়ের মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বে দিনটি ব্যাপকভাবে উদ্যাপিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মিস্ এস্থার হাওল্যান্ড প্রথম ভালেন্টাইন কার্ড পাঠানোর প্রচলন করেন। ১৮০০ সাল থেকে দিনটি বাণিজ্যিকভাবে উদ্যাপন শুরু হয়। বর্তমানে পাশ্চাত্যে এ উৎসব মহাসমারোহে উদ্যাপন করা হয়।

যুক্তরাজ্যে মোট জনসংখ্যার অর্ধেক প্রায় ১০০ কোটি পাউন্ড খরচ করে ভালবাসা দিবসের কার্ড, ফুল, চকোলেট, অন্য উপহার সামগ্রী ও শুভেচ্ছা কার্ড কিনতে। আনুমানিক আড়াই কোটি শুভেচ্ছা কার্ড আদান-প্রদান করে এ দিনে। তবে তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে অনেক কিছুই বদলে যাচ্ছে। এখন মোবাইল ফোন, এসএমএস, ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলো ভালবাসা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয়। প্রিয় মানুষের হাত ধরে বেড়ানোর পাশাপাশি এসব মাধ্যমে আজ যথারীতি সক্রিয় থাকবেন বাংলাদেশের প্রেমিক প্রেমিকারা।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত