নূরুল মোহাইমীন মিল্টন, কমলগঞ্জ(মৌলভীবাজার)

০৭ মার্চ, ২০১৫ ০৮:৫৫

সম্ভাবনাময় ফুল, শলা ঝাড়– তৈরির ক্ষুদ্র শিল্প

পুঁজি স্বল্পতা ও পৃষ্টপোষকতার অভাব

ঘরের কাজের পাশাপাশি দরিদ্র প্রায় শতাধিক পরিবারের নারী পুরুষরা নিরলসভাবে তৈরি করে যাচ্ছেন রেমা ফুল ও নারিকেল শলা দিয়ে তৈরি ফুল ও শলার ঝাড়–। বাঙালি পরিবারের অনেক নারী পুরুষরা ঘরে বসে টাকা উপার্জন করলেও স্বল্প পুঁজি ও পৃষ্টপোষকতার অভাবে দরিদ্র এসব শিল্প উদ্যোক্তারা দীর্ঘ দিনের এই ক্ষুদ্র প্রয়াসকে বাণিজ্যিক রূপ দিতে পারছেন না। গ্রামের অনেকেই জীবিকার সন্ধান হিসাবে বাড়ি বাড়ি ফুল ঝাড়–, শলা ঝাড়– ও চুনা ব্রাশ তৈরির শিল্প গড়ে তোলেছেন। মৌলভীবাজার জেলার মধ্যে একমাত্র এই শিল্পটি কমলগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের বাঘমারা গ্রামে গড়ে উঠলে ঝাড়– তৈরী শিল্পীরা নানা সমস্যায় জর্জরিত ।

    সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বাঘমারা গ্রামের দরিদ্র পরিবার সমূহের মধ্যে স্কুল ছাত্র থেকে শুরু করে ঘরের নারী, পুরুষ কাজের ফাঁকে ফাঁকে ফুল ও শলা ঝাড়– তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এলাকায় প্রচার বিমুখ এই শিল্পটি তাদের বাপ দাদার আমলের ঐতিহ্যকেই ধারণ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। প্রায় শতাধিক পরিবার এই পেশার সাথে যুক্ত রয়েছেন। ফলে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০ হাজার টাকার ফুল ঝাড়– ও নারিকেল শলার ঝাড়– বিভিন্ন স্থানে পাইকারি হারে বিক্রি হচ্ছে। এই শিল্প উদ্যোক্তাদের অধিকাংশেরই ভিটেমাটি ছাড়া আর কোন জমিজমা নেই। তারা শিল্পকে আকড়ে ধরে রাখলেও পুঁজির অভাবে শিল্পের উন্নতি ঘটাতে পারছেন না। গ্রামের ৫৫ বছর বয়সি ফুল ও শলা ঝাড়– শিল্পকারক খলিল মিয়া বলেন, ‘জন্মের পর থেকে আমি আমার স্ত্রী ও দুই মেয়ে সহ ফুল ও নারিকেল শলার ঝাড়– তৈরি করে বিক্রি করছি। হবিগঞ্জের মিরপুর, বাহুবল, তেলিয়াপাড়া সহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নারিকেল শলা ও রেমা ফুল সংগ্রহের পর দুই, তিনজন মিলে দিনে গড়ে ২শ’ পিছ ঝাড়– তৈরি করলে সবকিছু বাদ দিয়ে ৩ থেকে ৪শ’ টাকা আয় হয়। এই আয় থেকে ৩ মেয়ে বিয়ে দিয়ে কোনমতে এখন সংসার চালাই।’ খলিল মিয়ার স্ত্রী আমেনা বেগম বলেন, ‘আমরার ভিটামাটি ছাড়া আর কোন জমি নাই। এই কাজ করার মতো পুঁজিও নাই। ঋনের জন্য বিভিন্ন জনের কাছে গিয়েছি। ব্যাংক থেকে কম লাভে ঋন পাইলে আরও বেশি কাজ করা যাইতো।’

    পার্শ্ববর্তী বাড়ির দানিস মিয়ার একটি ঘরে নারিকেল শলার ঝাড়– তৈরির কারখানায় ঝাড়– বাঁধাইয়ের টিন হিসাবে দুধের পট, কাঠের টুকরো ও লোহা দিয়ে দ্রুত হারে তৈরি হচ্ছে এসব ঝাড়–। আহমদ ইকবাল উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেনি পড়–য়া  উসমান গনি জানায়, ‘অবসরে দানিস মিয়া বাড়িতে ঝাড়– বাঁধাইয়ের কাজ করি। দৈনিক ১শ’ ঝাড়– বাঁধলে ১শ’ টাকা পাই।’ এভাবে গ্রামের অনেকেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এই শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন। ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তা দানিস মিয়া বলেন, ‘আগে বাবা এই কাজ করতেন। এখন ২ বছর যাবত তিনি এই কাজ করছেন। তবে পুঁজি না থাকায় কষ্ট হচ্ছে। যেখানে লাখ টাকার প্রয়োজন সেখানে মাত্র ১৫ হাজার টাকা ব্যাংক ঋন নিয়ে কোনমতে ধার দেনা করে এই শিল্পকে ধরে রেখেছি। নিজের রোজ ধরে হিসাব করলে দৈনিক ছয় থেকে সাতশ’ টাকা আয় হয়।’ দানিস মিয়া, সিরাজ মিয়া সহ ঝাড়– শিল্প উদ্যোক্তারা জানান, শতাধিক পরিবার এই শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও কমলগঞ্জ জনতা ব্যাংক থেকে মাত্র ১০ জনকে মাথাপিছু ১০ হাজার করে ঋন দেয়া হয়। সরকারিভাবে পৃষ্টপোষকতা ও সহজ শর্তে ব্যাংক ঋন পাওয়া গেলে এই শিল্পের ব্যাপক প্রসার লাভ করবে। তারা বলেন, শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, বড়লেখা, জুড়ি, শমশেরনগর ও মৌলভীবাজার জেলা সদর সহ বিভিন্ন স্থানে পাইকারি হারে এসব ঝাড়– বিক্রি করা হয়।

    বাঘমারা গ্রামের তাহের মিয়া, মতিন মিয়া, নূরজাহান বেগম, আনু বেগম, জোহারা বিবি, আবু মিয়া, সত্তার মিয়া, মিজান মিয়া সহ প্রায় শতাধিক পরিবারে রেমা ফুলের ও নারিকেল শলার ঝাড়– তৈরি হচ্ছে। স্বউদ্যোগে বাড়ি বাড়ি এসব ক্ষুদ্র শিল্পের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করলেও প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা পাওয়া গেলে শিল্প বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। কমলগঞ্জের ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তা সংগঠক লেখক গবেষক আহমদ সিরাজ বলেন, মনিপুরীরা বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ভোগ করলেও সম্ভাবনাময় এসব বাঙালি শিল্প উদ্যোক্তারা সেই সব সুবিধা পাচ্ছেন না। ক্লাস্টার পোগ্রামের মাধ্যমে যে পক্রিয়ায় মনিপুরীদের ঋন সুবিধা প্রদান করা হয়েছে, ঠিক সে পক্রিয়ায় বাঙালি এসব শিল্প উদ্যোক্তাদের ঋন প্রদান করলে ক্ষুদ্র শিল্প বিকাশের পথ প্রশস্ত হবে এবং এক সময়ে কমলগঞ্জে ক্ষুদ্র শিল্পের প্রসার লাভ করবে।    

আপনার মন্তব্য

আলোচিত