দেবব্রত চৌধুরী লিটন

০৫ জুন, ২০১৬ ১০:২৩

একদা দিঘীর শহর নামে পরিচিত ছিলো শহরটি

সিলেট নগরীর ধোপাদিঘীর চিত্র। তিন দিক ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ হয়েছে, আর এখন অবশিষ্ট জলাশয় ভরাটের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। ছবি : মাহমুদ হোসেন

এককালে সিলেটের পরিচিতি ছিলো দিঘীর শহর নামে। সিলেটের প্রায় প্রতিটি পাড়ায়ই ছিলো একেকটি দিঘী।

এই দিঘীগুলোর নামেই পরিচিত হয়ে ওঠে নগরীর বিভিন্ন পাড়া মহল্লা। সাগর দিঘীর পাড়, মাছুদিঘী পাড়, রামেরদিঘী পাড়, ধোপাদিঘীর পাড়, চারাদিঘীর পাড়, লালদিঘীর পাড়- দিঘীর নামে নামকরণ হওয়া নগরীর এই এলাকাগুলো এখনো আগের নামেই পরিচিত। কিন্তু দিঘীগুলোই নেই। দিঘীর শহরই এখন প্রায় দিঘীহীন।

পরিব্রাজক ইবনে বতুতা সিলেটের নাম দিয়েছিলেন ‘সিলিচাতুলা’, অর্থাৎ সাগরের শহর। শহরের বুক চিঁরে বয়ে চলা নদী, ছোট বড়  ছড়া, বড় বড় দিঘী মিলেই তিনি সিলেট শহরকে দেখেছিলেন সাগরের মত। সেই শহরটি আজ দিঘীশূন্য। ছড়া তো দখল হয়ে গেছে অনেক আগেই।

অপরিকল্পিত নগরায়ন আর ভূমিখেকো চক্রের গ্রাসে নগরী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দিঘী। ফলে একদিকে যেমন সিলেটের সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য নষ্ট হচ্ছে অপরদিকে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা কমে আসায় অল্প বৃষ্টিতেই নগরীতে দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা।  বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবেশ।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এখনো হাতেগোনা যে ক’টি দিঘী রয়েছে সেগুলোও দখল হয়ে যাওয়ার উপক্রম। ভূমিখেকোরা অল্প অল্প করে চারপাশ থেকে দখল করে নিচ্ছে দিঘীগুলো। ব্যক্তিমালিকানাধীন দিঘীও ভরাট হয়ে গড়ে ওঠেছে বহুতল ভবন।

জানা যায়, নগরীতে এক যুগ আগেও ছোট বড় অন্তত: ২০টি দিঘী ছিলো। এই দিঘীগুলো শুধু পানির উৎস-ই ছিল না, ছিলো ঐতিহ্যের নিদর্শন। নগরীর উল্লেখযোগ্য দিঘীগুলোর মধ্যে ছিল- লালদিঘী, রামের দিঘী, মাছুদিঘী, বেকাদিঘী, মজুমদার দিঘী, দস্তিদার বাড়ি দিঘী, সাগরদিঘী, চারাদিঘী, ধোপাদিঘী, রাজার মাই দিঘী, মুরারি চাঁদ দিঘী, ইন্দ্রাণীর দিঘী, কাজলদিঘী, কাস্টঘর দিঘী, কাজিরদিঘী, ব্রাহ্মণশাসন দিঘী, লালাদিঘী প্রভৃতি। এসব দিঘীর মধ্যে হাতেগোনা ৪/৫ টি এখনো টিকে আছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরীর প্রাণকেন্দ্রে ছিল বেকাদিঘী। সুরমা উত্তর পার ঘেঁষে ক্বিন ব্রিজের পূর্বেই ছিল বেকাদিঘীর অবস্থান। বর্তমানে দিঘী ভরাট করে সিটি কর্পোরেশন এখানে গড়ে তুলেছে জালালাবাদ পার্ক। এই পার্কটিও পড়ে আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। পার্কের ভূমি দখলের চেষ্টাও চলেছে বিভিন্ন সময়।

নগরীর মজুমদার দিঘী ভরাট হয়ে এখন বিরাট খেলার মাঠ। এক অবস্থা মাছুদিঘীরও । নগরীর মির্জাজাঙ্গাল ও তালতলার পাশে ব্যক্তি মালিকানাধীন সুবিস্তৃত এই দীঘির নামে নামকরণ হয়েছে আবাসিক এলাকার। স্থানীয় একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি দিঘীটি ভরাট করেছেন। লালদিঘীর নামে এলাকার নাম আছে; আছে মার্কেট, নেই শুধু দিঘী। দিঘীর উত্তর পাড়ে রাজা জিসি হাইস্কুল এবং দক্ষিণ পাড়ে পাইলট স্কুল। এক সময় দিঘীটি বিস্তৃত ছিল প্রচুর। ১৮ বছর আগে তৎকালীন সিলেট পৌরসভা দিঘীর একটা বড় অংশ ভরাট করে বিশাল মার্কেট তৈরি করে।

ভরাট হয়ে রামের দিঘীর বুকের উপর এখন বহুতল ভবন উঠেছে। নবাবরা তাদের কাপড় ধোয়ার সুবিধার্থে ধোপাদের জন্য একটি দিঘী খনন করে দেন। সেটিই ধোপাদিঘী। এই দিঘীটিও ভরাট করার প্রক্রিয়া চলছে। ইতোমধ্যে ওসমানী শিশু পার্ক নির্মাণ ও রেড ক্রিসেন্টের ভবন নির্মাণের নামে অনেকাংশই ভরাট করে ফেলা হয়েছে দিঘীর। সম্প্রতি এই দিঘীর পাশে মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সিটি কর্পোরেশন। এতে দিঘীটির বাকী অংশও ভরাট হয়ে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।

চারাদিঘীটিও ভরাট করে বানানো হয়েছে মসজিদ। সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান মসজিদটি উদ্বোধন করেন। নগরীর নাইওরপুল এলাকায় রামকৃষ্ণ মিশনের পাশে আছে কাজলদিঘী। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ কাজলের নামে এ কাজলদিঘীর পাশে কাজলের স্মৃতি রক্ষায় নির্মিত হয় একটি স্মৃতিসৌধ। রাস্তা বড় করতে গিয়ে দিঘীর একটা অংশ ভরাট হয়ে গেছে। ফলে ছোট হয়ে গেছে দিঘীটি। কাজিটুলার কাজিদিঘী ছিল এলাকার সৌন্দর্য। কাজি দিঘী এখন এলাকাবাসীর ময়লা স্তূপে পরিণত হয়েছে। কাস্টঘর এলাকার কাস্টঘর দিঘী ভরাট হতে হতে পরিণত হয়েছে ছোট ডোবায়।

ধোপাদিঘীর পার এলাকার দিঘীটি ভরাটের কারণে সংকুচিত হয়েছে দিঘীটি। সেখানে গড়ে উঠেছে সিটি কর্পোরেশন জামে মসজিদ, পার্ক, মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড। পার্শ্ববর্তী বাসিন্দারা যে যতটুকু পেরেছেন দখল করে দিঘীটিকে সংকুচিত করে ফেলেছেন। যার কারণে অস্তিত্ব প্রায় বিলীন হতে চলছে এই দিঘীটির।

নগরীর সুবিদবাজারে জমিদার সুবিধনারায়ণ দস্তিদারদের পারিবারিক দিঘী দস্তিদার দিঘী সম্প্রতি দখলের উদ্যোগ নেয় একটি ভূমিখেকো চক্র। দিঘীটি রক্ষায় দিঘীতে ব্যতিক্রমী গণগোসল কর্মসূচী পালন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন।

নগরীতে কতটি দিঘী আছে, এর মধ্যে সিটি কর্পোরেশনের মালিকানাধীন দিঘী কতটি তা জানেন না খোদ নগর কর্তৃপক্ষই। দিঘীগুলোর বর্তমান অবস্থা কী-এ তথ্যও তাদের কাছে নেই। অথচ মার্কেট বা মসজিদ নির্মাণের নামে বিভিন্ন সময় সিটি কর্পোরেশনই ভরাট করেছে দিঘী।

সিলেট সিটি কর্পোরেশনে প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান জানান, নগরীতে কতটি দিঘী রয়েছে এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে দিঘী রক্ষায় সিটি কর্পোরেশন সচেষ্ট রয়েছে। তবে দিঘী রক্ষায় তাদের আলাদা কোনো প্রকল্প নেই বলে জানান নুর আজিজ।

দিঘী ভরাট হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম কিম বলেন, দিঘীগুলো সিলেটের ঐতিহ্যের অংশ। দিঘীর নামেই সিলেটের বিভিন্ন এলাকার পরিচিতি। সিলেটকেও বলা হতো দিঘীর শহর। অথচ এই শহরেই এখন দিঘী নেই। পরিবেশ ও ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে দিঘীগুলো সংরক্ষণ করা উচিত। এছাড়া বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে রেহাই পেতেও দিঘীগুলো রক্ষা করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরকে দিঘী রক্ষায় কঠোর হতে হবে এবং জনগণকেও এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।

এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদফতর সিলেটের সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজুর বলেন, সরকারী বা ব্যক্তিমালিকানাধীন দিঘী ভরাট করা আইনত নিষিদ্ধ। কেউ দিঘী ভরাট করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দিঘীগুলো সুরক্ষায় জনগণকেও সচেতন হতে হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত