জাহিদুর রহমান তারিক, ঝিনাইদহ থেকে

০৮ জুন, ২০১৬ ২১:৩২

কেঁচো চাষ করে স্বাবলম্বী!

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর ও রায়গ্রাম ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের হাজারো দরিদ্র নারী কেঁচো চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন।
তাঁরা কয়েক বছর ধরে সংসারের দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি এ কাজ করছেন। ফলে একদিকে কেঁচো ও সার বিক্রি করে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা আয় করছেন, অন্যদিকে কৃষি জমিতে বিষমুক্ত স্বাস্থ্যকর ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। এতে কৃষি খরচ অর্ধেক কমে গেছে।

কালীগঞ্জ উপজেলার মোস্তফাপুর গ্রামের ৮৫, দাপনা গ্রামের ৭৫, মহেশ্বরদাচা গ্রামের ৯০, নিয়ামতপুর গ্রামের ৬৫, মহিষাডোরা গ্রামের ৪৬, বলরামপুর গ্রামের ১৬১, অনুপমপুর গ্রামের ৬১, হরিগোবিন্দপুর গ্রামের ৫৬, আড়ুয়াশলুয়া গ্রামের ৬১, বলাকান্দর গ্রামের ৫১, ভোলপাড়া গ্রামের ৫৩, বারোপাখিযা গ্রামের ১২৬, খামারমুন্দয়া গ্রামের ১৪, আগমুন্দিয়া গ্রামের ২৫ এবং মল্লিকপুর গ্রামের ৮১ জনসহ সহস্রাধিক নারী নিজেদের জীবিকা নির্বাহে কেঁচো চাষ করছেন।

দিন দিন তাঁদের এই চাষ পদ্ধতি গ্রামের পর গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে। এসব গ্রামের নারী কৃষকরা গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি কেঁচো কম্পোস্ট সার উৎপাদনের কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। এদের বেশিরভাগই স্বামী পরিত্যক্তা ও বিধবা।

কেঁচো কম্পোস্ট তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে তারা জানান, বাড়ির আঙ্গিনায় মাটিতে গর্ত বা পাকা হাউজ করে খুব সহজেই কেঁচো কম্পোস্ট তৈরি করা যায়। এরপর গর্ত বা হাউজে গরুর গোবর, গরুর মূত্র, নিমগাছের পাতাসহ বাড়ির ময়লা আবর্জনা দিয়ে ভরাট করার পর বিশেষ ধরনের কেঁচো ছেড়ে দেয়া হয়। এসব কেঁচো ময়লা আবর্জনা খেয়ে আদর্শ জৈব সার উৎপাদন করে। এতে সময় লাগে ৩০ থেকে ৩৫ দিন। নিজের জমিতে দেয়ার পর অতিরিক্ত সার ১০ টাকা কেজি দামে বিক্রি করা হয়। প্রতি কেজি কেঁচো ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকায় বিক্রি হয়।

উপজেলার নিয়ামতপুর ইউনিয়নের মোস্তফাপুর গ্রামের কৃষাণী মনোয়ারা বেগম জানান, অনেক নারীর সাথে তিনিও জাপান ভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। বর্তমানে তিনি সচ্ছল। প্রতি মাসে কেঁচো ও সার বিক্রি করে প্রায় ১৫ হাজার টাকা আয় হয়। আগে তাঁর কাঁচা ঘর ছিল, এখন পাকা ঘর। একটি গাভী কিনেছেন। এছাড়া বিষমুক্ত সবজি ও ফসল উৎপাদন করছেন। মনোয়ারা বেগম কৃষি ও সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য এ পর্যন্ত ৫ বার জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পুরস্কৃত হয়েছেন।

বলরামপুর গ্রামের কেঁচো চাষি মরজিনা খাতুন জানান, নারীদের অধিকার আদায়ে সংগঠিত করা ও কৃষিতে বিশেষ অবদান রাখায় ২০১৩ সালে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হয়ে ভিয়েতনাম পরিদর্শন করেছেন। সেখান থেকে জৈব সার ব্যবহার করে উন্নত চাষ পদ্ধতি রপ্ত করেছেন। বর্তমানে তিনি প্রতি মাসে ১২ হাজার টাকার বেশি আয় করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও বিশেষ সাফল্যের জন্য ২০১৪ সালে তাঁকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার প্রদান করেছেন।

একই গ্রামের রাজিয়া খাতুন জানান, কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন এবং বিক্রি করে তিনি ৪৫ শতক জমি কিনেছেন। পাশাপাশি পাকা বাড়িও করেছেন। তাঁর প্রতিবন্ধী স্বামীর সংসারে একমাত্র আয়ের উৎস এখন কেঁচো কম্পোস্ট।

নিয়ামতপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সাজেদুর রহমান লিটন জানান, কেঁচো কম্পোস্ট এলাকার কৃষিতে বিশাল এক বিপ্লব সৃষ্টি করেছে। পুরুষের পাশাপাশি এলাকার স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবা ও দরিদ্র মহিলারা কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন করেন। এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে কেঁচো চাষ হচ্ছে। তিনি এসব পিছিয়ে পড়া নারীদের সফলতা দেখে মুগ্ধ বলে জানান।

কৃষি বিশেষজ্ঞ ড. এম গুল হোসেন জানান, কেঁচো দিয়ে তৈরি কম্পোস্ট সারাদেশের কৃষিক্ষেত্রে বিরাট এক পরিবর্তন ঘটিয়ে চলেছে। কৃষি জমিতে কেঁচো কম্পোস্ট পর পর ৩ থেকে ৪ বছর ব্যবহার করলে রাসায়নিক সার ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে না। এমনকি কোনো জৈব সার ও কীটনাশক ব্যবহার না করেই চাষ করা সম্ভব। দেশের উর্বর মাটিতে যেসব উপাদান থাকে, তার চেয়ে কেঁচো কম্পোস্ট সারে নাইট্রোজেন ৫ গুণ, ফসফরাস ৭ গুণ এবং পটাশ ১১ গুণ বেশি। এছাড়া এই সার সালফার, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, বোরন, ম্যাগনিজ, কপার, অ্যালিমুনিয়াম ও জিঙ্কসমৃদ্ধ । ফলে মাটির গুণাগুণ অনুযায়ী প্রতিবছর শতকে ৫ থেকে ১০ কেজি কেঁচো কম্পোস্ট ব্যবহার করা হলে ৩ থেকে ৪ বছরে মাটির পূর্ণতা ফিরে আসবে। তখন জমিতে কোনো রাসায়নিক সার ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে না। এমনকি কোনো ধরনের জৈব সার এবং কীটনাশক ছাড়াই চাষাবাদ করা যাবে।

ঝিনাইদহ জেলা কৃষি অফিসার আকরামুল হক জানান, কেঁচো কম্পোস্ট বা জৈব সার কৃষি চাষাবাদে দারুণ ফলপ্রসূ ।
এ সার মাটি যেমন সুস্থ রাখে, তেমনি এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত সবজি ও ফসল খেলে সুস্থ জীবন উপভোগ করা যায়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত