ফয়সাল খলিলুর রহমান

২৬ জুন, ২০১৬ ১৪:৪৫

বৃষ্টি ঘিরে উৎসব

ছবি: মোরশেদ আলম

প্রখর সূর্যতাপে সারাদেশ যখন গরমে হাপিতেশ করে তখন সিলেটে নামে মিষ্টি বৃষ্টি। বর্ণহীন ধূসর গ্রীষ্মেই রং রূপ রস নিয়ে বৃষ্টি নামে এখানে। স্তব্ধ পৃথিবীতে যেন প্রাণের সঞ্চার। সিলেটের আরেক নাম সবুজ শহর। বৃষ্টি হয় বলে এখানে গাছও আছে অনেক। ছোট ছোট টিলা বেয়ে মূল শহরটা গড়ে উঠেছে। বৃষ্টি নিয়ে গান কবিতার শেষ নেই। আর বাঙালির বৃষ্টিবিলাশ নতুন করে ব্যাখ্যা করার কিছু নাই। সিলেট অঞ্চলে জন্ম নেয়া বিখ্যাত শিল্পী বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম লিখেছিলেন, বর্ষা যখন আইতো, গাজির গান হইতো, রঙে ঢঙে গাইতো আনন্দ পাইতাম। এভাবে বর্ষার সাথে সারা বাংলার লোকজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য মিশে রয়েছে। সুরমা, কুশিয়ারাতে যখন পানির ঢল নামে তখন এক অপরূপ দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। এ অঞ্চলে তখন ঝিলমিল ঝিলমিল ময়ূরপঙ্খি নাও সাজিয়ে নৌকাবাইচ হয়, সারি গান হয়। বৃষ্টিকে ঘিরে হয় আরো অনেক উৎসব।




ছবি: আমিনা আক্তার




ধামাইল: সিলেটের বর্ষাতেই বেশির ভাগ বিয়ে হয়। আর বিয়ে মানেই ধামাইল গান। লোক সংস্কৃতি গবেষক সুমন কুমার দাশের বইয়ে পাওয়া যায়, ধামাইল গান ও ধামাইল নাচ সিলেট অঞ্চলে প্রচলিত একজাতীয় কাহিনী সম্বলিত নৃত্য যা এই অঞ্চলের লোকসাহিত্যের একটি অংশ। ধামাইল নামকরণ ও এই গানের পরতে পরতে বাংলার পল্লী নারীদের সুখ, দুঃখ, আশা, আকাঙ্ক্ষা গভীর ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। ভারতের শিলচর- করিমগঞ্জ অঞ্চলে জনশ্রুতি রয়েছে, দেশ বিভাগের পূর্বে তৎকালীন সিলেট অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই বর্ষাকালে অবসর সময়ে মহিলারা একত্র হয়ে একসঙ্গে বসে হাঁসি, ঠাট্টা, ও গল্প গুজব করতেন। আর গল্প গুজবে মত্ত থাকার এ মুহূর্তটাকে বলা হতো ‘ধুম্বইল’ এবং গল্প গুজবের চরম পর্যায়ে এই কথা ও আড্ডা এক সময় নাচে গানে রূপ নিত । এই ধুম্বইল থেকেই ধামাইল এসেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ধামাইল গানের প্রচলন থাকলেও সিলেট অঞ্চলে হিন্দু সম্প্রদায়ে বিয়েতে আনন্দ উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে যে ধরনের ধামাইল গানের আয়োজন করা হয়ে থাকে সেটা আর কোথাও হয় না। মূলত রাধারমণ দত্ত ধামাইল গানকে বেশি জনপ্রিয় করেছেন। এ ছাড়াও শাহ্ আব্দুল করিম, প্রতাপ রঞ্জন তালুকদার, ভরত চন্দ্র সরকার, শিখা রানী দাস, সুনীল চন্দ্র সরকার প্রমুখ শিল্পী ধামাইল গান রচনা করেছেন । ধামাইল নাচের অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে এ নাচ স্ত্রীসমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ১০ থেকে ২৫ জন স্ত্রীলোকে বাড়ির খোলা কোনো স্থানে চক্রাকারে দাঁড়িয়ে তালে তালে করতালি দিয়ে গীত সহযোগে এই ধামাইল নাচ পরিবেশন করেন। ধামাইল নাচ যেহেতু একটি বিশেষ সম্পর্কের ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে পরিবেশিত হয়, তাই এ নাচে শ্যালিকা, বৌদি, দাদি, নানী সম্পর্কের মহিলারাই এ পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করেন। ধামাইল নাচ পরিবেশনের জন্য বিশেষ কোনো স্থান কিংবা মঞ্চের প্রয়োজন পড়ে না। বাড়ির ভেতর অথবা বাইরের উঠানে, ঘরের মেঝেতে কিংবা সামান্য একটু খোলা জায়গায় ১০/১৫ জন মহিলা গোল হয়ে এই নাচ পরিবেশন করেন।  ১৯৯০ সালের অক্টোবরে যাত্রা শুরু করে সাংস্কৃতিক সংগঠন হাওরপারের ধামাইল (হাপাধা)- বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠার পর প্রথমে ধামাইল গানের শিল্পীদের খুঁজে বের করে সংগঠনটি। বিলুপ্তপ্রায় গানগুলো সংরক্ষণ করতে শুরু করে।  এরপর প্রতি বর্ষায় তারা আয়োজন করে ধামাইল গানের উৎসব। এতে অংশ নেয় সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার লোকশিল্পীরা। ধামাইল আসরের পাশাপাশি থাকে কিসসা পালা, লোকনৃত্য, গাজীর গীত, সিমিস্যা গান, পুঁথিপাঠের আসর।


নৌকাবাইচ: সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই, কালনী ইত্যাদি সিলেটের নদী। এক একটি নদী ঘিরে হাজার বছরের জনপদের ইতিহাস। সেই মোঘল আমল থেকে বাংলার ভাটি অঞ্চলে প্রশাসনিক অন্যতম উপায় ছিল নৌশক্তি। বাংলার বারো ভুঁইয়ারা নৌবলে বলিয়ান হয়ে মুগলদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও খেলাধুলায় নদ-নদীর উপস্থিতি প্রবল এবং নৌকা বাইচ এদেশের লোকালয় ও সংস্কৃতির এক সমৃদ্ধ ফসল। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে অনেকগুলো নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়ে থাকে। তবে সিলেট বিভাগের নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতাটিকে সাধারণত সিলেট বিভাগীয় ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আয়োজনগুলোর একটি বলে মনে করা হয়। প্রতি বর্ষায় সুরমা নদীতে এই নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়।  এছাড়া সুনামগঞ্জের কালনী নদীতেও আরেকটি বড় নৌকাবাইচ অনুষ্ঠিত হয়।  সিলেট অঞ্চলে বাইচের জন্য সাধারণত সারেঙ্গী নৌকা ব্যবহার করা হয়। এটি সাধারণত ১৫০ ফুট থেকে ২০০ ফুট লম্বা এবং এর প্রস্থ একটু বেশি (৫ থেকে ৬ ফুট) হয়ে থাকে। এগুলির সামনের ও পিছনের দিকটা হাঁসের মুখের মতো চ্যাপ্টা এবং পানি থেকে ২-৩ ফুট উঁচু থাকে। এক সুরে নৌকার প্রতিযোগীরা গান গায় এবং এসব গানের কথায় থাকে প্রায়শ আল্লাহ বা ঈশ্বর ও প্রকৃতির কাছে সাহস সংগ্রহের আবেদন। নৌকার গতি অনুসারে অনেকে নৌকার সুন্দর সুন্দর নাম রাখেন। যেমন ঝড়ের পাখি, পঙ্খিরাজ, সাইমুন, তুফান মেল, ময়ূরপঙ্খি, অগ্রদূত, দীপরাজ, সোনার তরী ইত্যাদি।


যাত্রাপালা: চাবাগান আর প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর সিলেটকে ঘিরে রেখেছে ভারত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি যেন এ অব্জল। তবে এর একদিকে যেমন উঁচু আরেকদিক খুব নিচু। বর্ষাকালে নিচু অব্জল অর্থাৎ হাওরগুলো ফুলে ফেঁপে যেন সাগর হয়ে যায়। যেদিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। ভাটি অঞ্চলের মানুষ হয় তখন পানিবন্দী। তখন কয়েকগ্রাম মিলে আয়োজন করে যাত্রাপালা। ভাটি বাংলার বিনোদনের উৎস বিভিন্ন ধরনের যাত্রাপালা। তবে কালের আবর্তনে আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় সেই গভীর রাতে হাজারো নির্ঘুম দর্শকের সামনের যাত্রাপালার আবেদন দিন দিন কমে আসছে। এ অঞ্চলের বিখ্যাত পালাগুলোর মধ্যে রয়েছে সিরাজ-উদ-দৌলা, সোহরাব-রুস্তম, বেহুলা-লক্ষ্মীন্দর, রূপবান ইত্যাদি। যে গ্রামে যাত্রা হয় মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে সে গ্রামে যাত্রা দেখতে আসে মানুষ। সারা রাত ধরে ঢুলু ঢুলু চোখে কুপির আলোতে দেখে রঙিলা স্বপ্ন।


বর্ষাকালের সিলেটের বড় সৌন্দর্য্য মেঘ। কালো-মেঘ, সাদা-মেঘ ভেলার মতো মাথার উপর দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। দুষ্টু মেঘেরা হুট করেই সূর্যটাকে আড়াল করে ঝুমবৃষ্টি নামিয়ে দেয়। মেঘ-বৃষ্টি-ভালোবাসা যেন কাদাজলের সাথে মিলে মিশে একাকার। উৎসবে-পার্বণে বর্ষাকাল সিলেটে নিয়ে আসে আনন্দের বার্তা। মেঘমেদুর আকাশে কাকভেজা বিকেলে জানালায় দাঁড়িয়ে এককাপ চা হাতে নিয়ে জলের গানের মতোই গাইতে মন চায়- বানের জলে  পুকুর ভাসলো আমার গান, বন্ধু আইসো রে..

আপনার মন্তব্য

আলোচিত