নিউজ ডেস্ক

০৪ জানুয়ারি, ২০১৫ ১৯:৪২

অযত্নে ঐতিহাসিক মন্দির

এক সময় নলডাঙ্গায় কান পাতলে শোনা যেত ঘোড়ার ছুটে চলার শব্দ। রাজা ছিল, রাজ্য রক্ষার জন্য ছিল সৈন্যবাহিনী। সেই রাজ্যও নেই, রাজাও নেই। শুধু কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজবাড়ির আটটি মন্দির।

ঝিনাইদহের ঐতিহাসিক নলডাঙ্গা রাজবংশের প্রতিষ্ঠিত মন্দির

ঝিনাইদহের ঐতিহাসিক নলডাঙ্গা রাজবংশের প্রতিষ্ঠিত মন্দিরের  পাশে এখন ফসলের আবাদ হচ্ছে। ঐতিহাসিক এই মন্দিরগুলো অযত্ন, অবহেলায় প্রাচীন গৌরব হারিয়েছে বহুদিন আগেই। তারপরও বছরের বিভিন্ন সময় ভ্রমণপিপাসু মানুষ ইতিহাসের ঐতিহ্য অনুসন্ধানে মন্দিরগুলো দেখতে আসতেন। কিন্তু বর্তমানে এর আশপাশে চাষাবাদ হওয়ার দর্শনার্থীদের আগমন একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে।


এক সময় নলডাঙ্গায় কান পাতলে শোনা যেত ঘোড়ার ছুটে চলার শব্দ। রাজা ছিল, রাজ্য রক্ষার জন্য ছিল সৈন্যবাহিনী। সেই রাজ্যও নেই, রাজাও নেই। শুধু কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজবাড়ির আটটি মন্দির। এই রাজবংশের ইতিহাস, ঐতিহ্য বিলিন হয়ে গেছে পাকিস্তান আমলেই। ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায়, প্রায় পাঁচশ বছর আগে সুরী বিঞ্চুদাস হাজরা নলডাঙ্গায় রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নবাবের চাকরি করে ‘হাজরা’ উপাধি পান। তার পিতার নাম ছিল মাধব শুভরাজ। তিনিও নবাবের চাকরি করতেন। বৃদ্ধ বয়সে বিঞ্চুদাস ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগী হয়ে সন্ন্যাসী হন। এরপর তিনি ফরিদপুরের ভবরাসুর হতে নলডাঙ্গার খড়াসিং গ্রামে চলে আসেন এবং বেগবতী নদীর তীরে জঙ্গলে তপস্যা শুরু করেন।


১৫৯০ সালে মোগল সুবেদার মানসিংহ বাংলা বিজয়ের পর নৌকাযোগে বেগবতী নদী পথে রাজমহলে যাচ্ছিলেন। তার সৈন্যরা পথিমধ্যে রসদ সংগ্রহের জন্য অনুসন্ধানে বের হয়ে বিঞ্চুদাস সন্যাসী তপস্যারত দেখতে পান। এ সময় বিঞ্চুদাস সৈন্যদের খুব দ্রুত রসদ সংগ্রহ করে দেন। এতে মানসিংহ খুশি হয়ে সন্যাসীকে পাশ্ববর্তী পাঁচটি গ্রাম দান করেন। এই গ্রামগুলোর সমন্বয়ে প্রথমে হাজরাহাটি জমিদারি এবং ক্রমান্বয়ে তা নলডাঙ্গা রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।



অযত্নে ঐতিহাসিক মন্দির

এরপর প্রায় তিনশ বছর বিঞ্চুদাসের বংশধরেরা এই এলাকা শাসন করেন। ১৮৭০ সালে রাজা ইন্দু ভূষণ যক্ষা রোগে মারা গেলে তার নাবালক দত্তক পুত্র রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণদেব রায় রাজ্যের দ্বায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ভূষণদেব কয়েকটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন যা আজও কালের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বেগবতী নদীর তীরে। প্রকৃতপক্ষে রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণদেব রায় ছিলেন বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার কুমড়াবাড়িয়া গ্রামের গুরুগোবিন্দ ঘোষালের কনিষ্ঠ পুত্র। তিনি রাজ বংশের কেউ ছিলেন না। রাজা ইন্দু ভূষণ মারা যাওয়ার দীর্ঘ নয় বছর পর ১৮৭৯ সালে পূর্ণ জমিদারির ভার গ্রহণ করেন রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণদেব রায় ।


১৯১৩ সালে তিনি ‘রাজা বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত হন। সে সময় তিনি শিক্ষার প্রতি অনুরাগী হয়ে পিতা-মাতার নামে ইন্দুভূষণ ও মধূমতি বৃত্তি চালু করেন যা তখনকার সময়ে এক বিরল ঘটনা ছিল। তিনিই ১৮৮২সালে রাজবাড়ির নিকট ‘নলডাঙ্গা ভূষণ হাই স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানটি এখন  কালীগঞ্জে অবস্থিত। রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেব রায় ১৯৪১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের কাশিতে মারা যান। কুমার পন্নগ ভূষণ দেব রায় ও কুমার মৃগাংক ভূষণ দেব রায় নামে তার দুই পুত্র ছিল। ১৯৫৫ সালে এক সরকারি আদেশে অন্যান্য জমিদারির মতো এই জমিদারিও সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং রাজবংশ শেষবারের মতো লোপ পায়। এরপর থেকেই মন্দিরের কোনো সংস্কার হয়নি। তবে গত ২০০৬-০৭ অর্থ বছরে সরকারি বরাদ্দকৃত ৭৫ হাজার টাকা প্রদান করা হয় শ্রী শ্রী লক্ষ্মীদেবী মন্দির উন্নয়নের জন্য এবং শিব মন্দির উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ করা হয় ৬৫ হাজার টাকা।

এরপর স্থানীয় লোকজন নিজেদের টাকায় অন্যান্য মন্দির সংস্কার করে। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত পুনরায় কোনো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ প্রসঙ্গে নলডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম রবি জানান, স্থানটিতে আগে হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটতো। সংস্কার আর যাতায়াতের সুব্যবস্থা না থাকায় এখন দর্শনার্থীরা আসছেন না। দক্ষিণ পাশে বেগবতী নদীর উপর একটি ব্রীজ নির্মাণ হলে পার্শবর্তী কয়েকটি গ্রামের লোকজন সহজেই আসতে পারতো। দেশের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ অতি প্রাচীন এই ইতিহাস আর ঐতিহ্য রক্ষায় এগিয়ে এলে মন্দিরগুলো  হতে পারতো এক অমূল্য সম্পদ।


আপনার মন্তব্য

আলোচিত