দেবজ্যোতি দেবু

১৯ আগস্ট, ২০১৬ ১৩:৩৯

‘স্কুলে গেলে তো টাকা পাবো না’

এক ঝাঁক শিশু ছোট ছোট বেলুন একটা কাঠির মাঝে বেঁধে ছুটতে থাকে মানুষের পিছু পিছু। "আপা একটা বেলুন কিনেন না, মাত্র ১০ টাকা"। কেউ ইচ্ছে হলে কিনছে, আবার কেউ এড়িয়ে যাচ্ছে। চেষ্টা ব্যর্থ হলে আরেকজনের পিছনে ছুটছে। মাঝখানে একটু জিড়িয়ে নিয়ে গল্প করছে, হাসি-ঠাট্টায় সময় কাটাচ্ছে।

সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজারের এটি নিয়মিত দৃশ্য। প্রতিদিনই এমন প্রায় অর্ধশত শিশুর দেখা পাওয়া যায় জিন্দাবাজার এলাকায়। শুধু জিন্দাবাজার বললে ভুল হবে, বেশি লোক সমাগম হয় এমন যেকোন জায়গায় এদের পাওয়া যায় ছোট ছোট বেলুন নিয়ে মানুষের পিছু পিছু ছুটছে।

শুধু যে বেলুন বিক্রি করছে তা না। বেলুন শেষ হয়ে গেলে এর ফাঁকে ফাঁকে ভিক্ষাবৃত্তিও চালিয়ে যাচ্ছে তারা। গাড়ি করে কাউকে নামতে দেখলেই দৌড়ে গিয়ে "দশটা পাউন্ড দেন না" বলে পিছনে পিছনে ছুটতে থাকে এদের কেউ কেউ। পাউন্ড না পেলেও মাঝে মধ্যে দশটা টাকা ঠিকই উঠে আসে তাদের হাতে। টাকার বদলে ধমক দিলে তারা উল্টো খাওয়ার জন্য কিছু কিনে দেয়ার আবদার করে বসে। এক কথায়, সহজে কাউকেই ছাড়তে চায় না তারা।

কথা হয় পারভিন নামে এক বেলুন বিক্রেতা শিশুর সাথে। সে দক্ষিণ সুরমা এলাকায় থাকে। সেখানেই রেলওয়ের স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। গর্ব করে জানায় নিজের নাম বানান করে বলতে এবং লিখতে পারার কথা। বলে, তার বাবা একজন পানের দোকানদার। মা রাস্তায় পড়ে থাকা বোতল কুড়ানোর কাজ করেন। পারভিন সকালে ৬০ টাকার বেলুন কিনে এনেছিল। সারাদিনে বেলুন ফুলিয়ে বিক্রি করে ৫০০ টাকা আয় হয়েছে তার। প্রতিদিন কম বেশি এমনটাই আয় হয়। গাড়ি ভাড়া বাদ দিয়ে বাকি টাকা নিয়ে মায়ের হাতে তুলে দেয়। এটুকু বলেই মুচকি হাসি দিয়ে বেলুন বিক্রির জন্য ছুটে যায় ক্রেতার পিছনে।

পারভিনের পাশেই ছিল আরেক শিশু বেলুন বিক্রেতা রূমন। সে স্কুলে যায় না। যাওয়ার ইচ্ছাও নাই তার। বাবা নেই। মা ভিক্ষা করেন। ৪ বোন ৩ ভাইয়ের মাঝে সে ৫ম। বড় এক বোনের বিয়ে হয়েছে। ভাইবোনদের কেউই স্কুলে যায় না। রুমনও দক্ষিণ সুরমা এলাকায় থাকে। সকালে ৫০-৬০ টাকার বেলুন কিনে নিয়ে এসে ফুলিয়ে সারাদিন বিক্রি করে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হয় তার। টাকা নিয়ে মায়ের হাতে তুলে দেয়।

স্কুলে যেতে চায় না কেন জিজ্ঞেস করতে বলে, "বেলুন বিক্রি করলে টাকা পাই। স্কুলে গেলে তো টাকা পাবো না।" লেখাপড়ার কথা বললেই বারবার এড়িয়ে যাচ্ছিল সে। এরপরই ওর সাথী অন্য শিশুদের সাথে খুনসুটি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

যে বয়সটাতে তাদের স্কুলে যাবার কথা, মায়ের কোলে শুয়ে রূপকথার গল্প শোনার কথা, বাবার হাত ধরে ঘুরতে যাওয়ার কথা, সেই বয়সে তারা বেলুন বিক্রি করছে, ভিক্ষা করছে রাস্তায় রাস্তায়। কখনো কারো ধমক খাচ্ছে, তো কখনো বা কেউ যত্ন করে কথা বলে দুইটা বেলুন বেশি কিনছে। মাঝে মধ্যে কিছু শিশুকে কৌতুহলের বশে গাঁজা, সিগারেটের মারাত্মক আসক্তিতে জড়িয়ে পড়তেও দেখা যায়।

সভ্য শ্রেণী এবং রাষ্ট্রের কাছে ভিক্ষাবৃত্তি এবং শিশুশ্রম খারাপ হলেও তারা এই পেশাটাকে খুব উপভোগ করছে। শিশু অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে সভা সেমিনারে ঝড় উঠলেও এতে কোন পরিবর্তন আসেনি এই শিশুদের জীবনে। স্কুলে গিয়ে শিক্ষা অর্জনের চেয়ে রাস্তায় থেকে অর্থ উপার্জনকেই তারা প্রাধান্য দিচ্ছে।

শহরের রাস্তার প্রায় প্রতিটি শিশুর দৈনন্দিন জীবন হচ্ছে এরকম। এদের নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। শিশু শ্রম নিয়ে আইন থাকলেও শিশুদের এভাবে ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়া, বেলুন বিক্রির নাম করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো নিয়ে কারো কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তাপানুকূল রুমে বসে সভা-সেমিনারে বক্তারা শিশুদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বললেও বাইরে এসে এসব শিশুদের পুনর্বাসিত করার কোন ব্যবস্থা করছেন না কেউ। আইন আছে কাগজে কলমে। কিন্তু বাস্তব জীবনে সেই আইনের প্রয়োগ নেই।

ওরা শিশু। ওদের অধিকার আছে সুস্থ সুন্দর স্বাভাবিক জীবন যাপন করার। কিন্তু দারিদ্র্যের অজুহাতে এদের অভিভাবকেরা এদের নামিয়ে দিচ্ছে রাস্তায় অর্থ উপার্জনের স্বার্থে। এতে করে নষ্ট হচ্ছে এই শিশুরা, নষ্ট হচ্ছে এই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ। এই বয়সে যে হাতে বই থাকার কথা, সেই হাত টাকা রোজগারের জন্য মানুষের সামনে মেলে ধরছে বিনা সংকোচে। হাত ভর্তি টাকা পাওয়ার লোভে বেলুন, বাদাম, পানি বিক্রিতে নিজেদের ব্যস্ত করে রাখছে। কখনো কখনো জড়িয়ে পড়ছে অন্ধকার জগতের সাথেও।

সভা সেমিনারে বসে শুধু শিশু অধিকারের কথা বললেই হবে না। প্রয়োজন এইসব শিশুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। প্রয়োজন এদের সুশিক্ষা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা। দেশের সুন্দর আগামীর জন্য এই শিশুদের সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। না হলে অদূর ভবিষ্যতে স্বপ্নের সোনার বাংলা শুধু কাগজে কলমেই থেকে যাবে। বাস্তবায়িত করা যাবে না।

 

ছবিঃ লেখক

আপনার মন্তব্য

আলোচিত