উজ্জল মাহাতো

০৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ১০:৫৪

সমতলের আদিবাসী ও কারাম উৎসব

“তেঁলি ঘাঁরেক তেঁলিআ
ধোবি ঘাঁরেক ব্যাঁতিআ
বারোরেত্র দিঁআরা আঁইজহোক্যা র‌্যাঁতিআ
বারএ লাঁগাআঁল দিআরা চ্যামেক লাগাল ব্যাতিআ।”

কি ভাবছেন? চর্যাপদের কাহৃপার কোন কবিতার অংশ বিশেষ, ব্যাপারটা অনেকটা সে রকমই। এটি হল সমতলের আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী দ্বিতীয় প্রধান ধর্মীয় উৎসব “কারাম” এর সূচনা গীত (মাহাতো জাতির ভাষা ও সংস্কৃতি সংবলিত গ্রন্থ কারাম থেকে সংকলিত)। যা আদিবাসী মাহাতো জাতির নাগরী ভাষায় লিখিত। এ গীতের মধ্য দিয়ে কারাম উৎসব শুরু হয়।

সমতলের আদিবাসী মাহাতো ও উঁরাওদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব “সোহরায়”। এই উৎসব কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে হয়ে থাকে। এর পরেই স্থান পায় দ্বিতীয় প্রধান ধর্মীয় উৎসব কারাম। কারাম ভাদ্র মাসের এই একাদশীতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সমতলের বিশেষ করে রাজশাহী, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, জয়পুরহাট, রংপুর, দিনাজপুর, খুলনা, সিলেট, অঞ্চলে এই সময় অনেক চঞ্চলতা ও ধর্মীয় উদ্দীপনার সাথে কারাম উৎসব পালন করা হয়। সাঁওতাল, উরাও, মাহাতো, বড়াইক, কুর্মি, সিং, পাহান, মাহালি সহ আরো কতিপয় আদিবাসী গোষ্ঠী তাদের নিজ নিজ রীতিতে পালন করে থাকে।

কারাম নামক গাছের ডাল কেটে বিভিন্ন প্রাচীন প্রথা মান্য করে এই উৎসব করা হয় তাই এর নাম কারাম। ডাল গেড়ে পুঁজো করা হয় তাই এটি কোথাও কোথাও ডাল পুঁজো নামে পরিচিত।
    
কারাম উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা ৫ দিনের। কোথাও কোথাও ৭ দিন যাবত এই অনুষ্ঠান করা হয়। প্রথম দিন থেকেই কেরমেতিদের আমিষ হলুদ, তেল ও সকল প্রকার মসলা জাতীয় খাদ্য পরিহার করতে হয়। কেরমেতি বলতে যারা কারাম পুঁজায় অংশ গ্রহণ করে তাদের বোঝায়। তারা বিশ্বাস করে যদি এই খাবার পদ্ধতির কেউ অনিয়ম করে তাহলে ওরা অংশের জাঁওয়া মরে যায়। জাঁওয়া বলতে বোঝায় মাটি, বালি, মুং, কুর্থি, ছোলা ইত্যাদি উপকরণ সামগ্রীর সমন্বয়ে চারা গাছের যে ডালা তৈরি করা হয়। এটি আসলে অর্থে বৃক্ষের অঙ্কুরোদগমকেই বোঝায়।

বৃক্ষের সাথে আদিবাসীদের আত্মার সম্পর্ক। বিভিন্ন রকম আচার ও গীত এর মাধ্যমে জাঁওয়া তোলা হয়। প্রত্যেক দিন রাতে একই রকম আচার, গীত ও ঝুমুর এর মধ্য দিয়ে জাঁওয়াতে পানি দেওয়া ও জাগানো হয়। অর্থাৎ প্রকৃতির বন্দনা করা হয়। নিয়মিত পরিচর্যায় বীজগুলো এ সময় দুই পাতা বিশিষ্ট হলুদাভ সবুজ চারাগাছে পরিণত হয়। প্রতীকী অর্থে বৃক্ষ রোপণ করার পর তার পরিচর্যাকে বোঝানো হয়।

শেষের দিন কেরমেতিরা রাতে আঙ্গিনায় কারাম ডাল গেড়ে শাপলা ফুল, শসা, ফিতা প্রভৃতি দিয়ে সাজিয়ে, ডালের গোড়ায় ডালাগুলো রেখে জ্বলন্ত প্রদীপ ও বরণ সাজে সজ্জিত কাসার থালা নিয়ে অধীর আগ্রহে কাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রথা বুকে লালন করে পুঁজোয় মনোনিবেশ করে। কার্মা ধার্মার উপদেশ মূলক গল্প জানা বৃদ্ধার নীতি গল্প শুনতে শুনতে এবং সঠিক সময়ে ডালকে প্রণাম ও ফুল ছিটয়ে ঐ রাতেই পুঁজোর কাজ সমাপ্ত হয়। গল্পটি সকলের চরিত্র গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। পরক্ষণে রাতভর কারাম ডালকে ঘিরে ঢোল, কাশি ও নিজ নিজ বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে ঝুমুর ও গীত পরিবেশিত হয়। শিশু কিশোর, যুবক যুবতী, বয়স্কদের সমন্বয়ে ঢোলের বাড়ি ও প্রদীপের আলোর পুরো আদিবাসী পল্লীগুলোতে নৈসর্গিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পরের দিন সকালে সকলে মিলে বিভিন্ন আচার সেরে গীত গাইতে গাইতে কারাম ডালকে নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয়।

বিসর্জন গীত:

“জাঁওয়া জাঁওয়া কারাম গাঁসা
কাঁস ন্যাদিই পার
ঘুঁরি ভাঁদার মাসে
আনাবোও ঘুরাইকে,
দিহে দিহে কারাম গাঁসা দিহে আশিস।”

কারাম উৎসবে মূলত কেরমেতিরা তার বাবা ও ভাই এর দীর্ঘায়ু কামনা করে। সেই সাথে বৃক্ষের বন্দনা করে থাকে।
    
২০১৩ সালের শেষের দিকে সমতলের মাহাতো জাতির ভাষা ও সংস্কৃতি সংবলিত গ্রন্থ “কারাম” প্রকাশিত হয়। যুগে যুগে কারাম নিয়ে গান, কবিতা, উপন্যাস, বিভিন্ন রকম প্রবন্ধ তৈরি হলেও তার সংখ্যা অতি নগণ্য। পার্বত্য অঞ্চলের বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক প্রভৃতি উৎসবের মত কারাম উৎসবের তেমন জনপ্রিয়তা নেই। কারাম ঐতিহ্যবাহী হওয়া সত্ত্বেও এটি অনেকের কাছে অপরিচিত।
    
সারা বিশ্ব যখন বিভিন্ন বড় বড় গণমাধ্যম Television, Newspaper, Internet, Twitter, Whats app, Facebook ইত্যাদি নিয়ে মাতোয়ারা; মানুষ সারা বিশ্বকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে ঠিক এই সময়েও সমতলের আদিবাসীরা বাড়ীর আঙ্গিনায় কারাম ডাল গেড়ে পুঁজো করছে। এক বিংশ শতাব্দীতে এসেও সমতলের আদিবাসীরা তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি ধরে রাখতে এবং পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞ।

আদিবাসি হওয়া সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে সমতলের মাহাতো, কুর্মি, পাহান, সিং, বড়াই, প্রভৃতি জনগোষ্ঠী বাদ পড়ে যায় আদিবাসীর তালিকা থেকে। আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিয়েও রয়েছে বিভিন্ন রকম ধুম্রজাল। সংশ্লিষ্ট সকলের সহায়তা পেলেই রক্ষা পাবে সমতলের আদিবাসীদের বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে থাকা নিজ নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি।

 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত