নিজস্ব প্রতিবেদক

২৩ জানুয়ারি, ২০১৭ ০১:৫০

শীতে বসন্তের শিমুল!

এখনো শীত শেষ হয়নি। বরং কিছুদিন ধরে তার তীব্রতা আরো বেড়েছে। তবে এবার শীতেই নগরে দেখা মিলেছে বসন্তের বার্তাবাহক শিমুল ফুলের।

মাঘের শুরুতেই টকটকে লালের আভায় সিলেট নগরীর ব্যস্ততম শাহজালাল সেতুর দক্ষিণ পারে শিমুল ফুল প্রকৃতিকে রাঙিয়ে দিয়েছে। সুরমা নদীর উপর থেকে সেতু থেকে নেমে নগরীর হুমায়ুন রশীদ চত্বরে যাওয়ার সময় রাস্তার দু’পাশে গাছে গাছে শিমুল ফুল ফুঁটেছে। আর এই ফুলকে ঘিরে অসময়ে বসন্ত উৎসবে মেতেছে কোকিল, বুলবুলি, শালিকের মত ছোট গানের পাখিরা।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ধরে সিলেট নগরীর প্রবেশদ্বার হিসেবে হুমায়ুন রশীদ চত্বরকে বিবেচনা করা হয়। এই চত্বর থেকে নগরীর উত্তর অংশে আসতে শাহজালাল সেতুতে উঠার রাস্তার দু’পাশে গাছে গাছে শিমুল রঙের পসরা সাজিয়েছে। এই অসময়ে শিমুলের পসরা যেন নগরীতে পর্যটক বরণে প্রস্তুতি।

বাংলার জনপ্রিয় গীতি কবি গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের লিখেছিলেন,- ‘ও শিমুল বন দাও রাঙ্গিয়ে মন/কৃষ্ণচূড়া দোপাটি আর পলাশ দিলো ডাক/মধুর লোভে ভিড় জমালো মৌ পিয়াসী অলির ঝাঁক।’
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কোকিল কন্ঠে এই গানে কত বাঙালির প্রেমিক মনে রঙ লেগেছে!

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিমুলের লাল দেখে লিখেছিলেন, -‘শিমুলের কুঁড়ি/এক রাত্রে বর্ণবহ্নি জ্বলিল সমস্ত বনজুড়ি।’

ইংরেজিতে সিল্ক কটন নামে পরিচিত শিমুলের বৈজ্ঞানিক নাম বোমবাক্সসিইবা। পশ্চিম আফ্রিকা থেকে ইন্দোনেশিয়া হয়ে বাংলাদেশে শিমুল এসেছে। শীতের শেষে প্রায় পুরো বসন্তে শিমুল ফুল ফুটে আর বৈশাখে ঝরে যায়। বর্ণিল হলেও শিমুলের কোন সুবাস নেই। তবে ট্রপিক্যাক জাতীয় এই গাছে পাখিরা বাসা বাঁধে। শিমুলের তুলা হয়; যার চাহিদা ব্যাপক বলে বাজার মূল্যও অনেক। আবার শিমুল কাঠে ম্যাচের কাঠি ভালো হয়। শিমুলে গাছের পাতা ও ফুলের ঔষধি গুণও রয়েছে। শীতে গাছের পাতা ঝরে যাওয়ার পর রিক্ত শাখায় শিমুল ফুল প্রাণের বারতা নিয়ে আসে। তবে গ্রামে-গঞ্জে এখনও কিছু সংখ্যক শিমুল গাছ দেখা গেলেও নাগরিক জীবনে হারিয়ে যেতে বসেছে।

প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অসময়ে শাহজালাল সেতুতে উঠার রাস্তার পাশে অন্তত ১০-১২টি শিমুল গাছ রয়েছে; যাতে শীতের মধ্যভাগেই রক্ত লাল ফুলের দেখা মিলছে। এই পথে আসা-যাওয়ার সময় ইট-পাথরের নগরীর বাসিন্দাদের মনে শিমুল ফুল দেখে ভালোলাগার আবহ ছড়িয়ে যাচ্ছে।

রাস্তার দু’পাশে সবুজ গাছগাছালির ফাঁকে লাল শিমুলকে ‘লাল-সবুজের বাংলার প্রতিকৃতি’ বলে অভিহিত করলেন নগরীর এমসি কলেজের ছাত্র সাব্বির আহমদ। নগরীর মেন্দিবাগের বাসিন্দা সাব্বির জানালেন তাদের এলাকায় জালালাবাদ গ্যাস ভবনের পেছনের সুরমা নদীর উত্তর পারে বিশাল আরেকটা শিমুল গাছ রয়েছে।

আবৃত্তি শিল্পী মোকাদ্দেস বাবুল বলেন, আবহমান বাংলায় শিমুল বাঙালির খুব পরিচিত ফুল। এই ফুল ভালোবাসার প্রতীক। শিমুলের অগ্নিশিখা তুল্য রূপ দ্রোহ এবং বিরহের প্রতীকও। এর দহনে কেউ পোড়ে না ঠিক, কিন্তু মনে ছাপ ফেলে। বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতিতেও শিমুলের প্রগাঢ় উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

অসময়ে শিমুল ফুল ফোঁটার পেছনে আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সিলেট আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়ায় বড় ধরণের অদল-বদল হয়েছে। এতে শুধু যে তাপমাত্রা বেড়েছে তাই নয়, সিলেট অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও বেড়েছে। দীর্ঘ ৫৭ বছরে গত বছর সিলেটে সবচেয়ে বেশি গরম পড়েছে। আবার ওই বছর-ই বৃষ্টিপাত হয়েছে ৪২ শতাংশ; যেখানে অন্য বছর ২৬-২৮ শতাংশ বৃষ্টিপাত হয়। এ সবের প্রভাবে ষড়ঋতুর বাংলাদেশে ঋতুর চারিত্রিক পরিবর্তন হচ্ছে। আর এর প্রভাব পড়ছে পরিবেশ ও প্রকৃতিতে। বসন্ত ঋতু আসার আগে শিমুল ফুল ফোঁটার পেছনেও আবহাওয়ার পরিবর্তণের প্রভাব বলে মনে করছেন তিনি।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. শরদিন্দু ভট্টাচার্য বলেন, তেমন শীত বা গরম নেই এমন আবহাওয়ায় শিমুল ফুল ফোটে বলেই বসন্তে তার আগমনী গান শোনা যায়। এবার তেমন শীত পড়েনি; আর গরমও তেমন নয় বলেই অসময়ে শিমুল ফুটেছে বলে তিনি মনে করছেন। বাংলা সাহিত্যের এই শিক্ষক বলেন, মানুষের শারীরিক আবেগকে প্রভাবিত করে প্রকৃতি। প্রকৃতির সৌন্দর্য তার মনে প্রেম-ভালোবাসার অনুভূতিকে আরো গাড় করে। অন্তত মনের দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে দেয় ক্ষনিকের তরে। শিমুলের রঙ-রূপ তেমনি মানুষের মনকে উদার করে দেয়। কিন্তু রূপে-গুণে অনন্য শিমুল ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক রকমের গাছ আছে। কিন্তু একটাও শিমুল নেই!

একসময় গ্রামে-গঞ্জে অনেক শিমুল গাছ দেখা গেলেও আজকাল কদাচিৎ তার দেখা পাওয়া যায় বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক শরদিন্দু। এমন অবস্থায় অসময়ে সিলেট নগরীতে শিমুলের পসরাকে তিনি দেখছেন প্রকৃতির আশীর্বাদ হিসেবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত