আসাদুজ্জামান

৩০ এপ্রিল, ২০১৫ ১৯:২৯

আইএস এর হাত থেকে বেঁচে ফেরা একজন মানুষের গল্প

আইএসআইএস(ইসিলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড সিরিয়া) বর্তমান সভ্যতার বিরুদ্ধে জন্ম নেওয়া ভয়ঙ্কর এক দানব। অন্ধকারে ওদের বসবাস,আলোকে ওদের প্রচণ্ড ভয়।মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে এহেন কোন কাজ নেই যা তাঁদের দ্বারা সংগঠিত হয়নি বা করছে না।মানুষ হত্যা থেকে শুরু করে ইরাকের মাসুল শহরের মিউজিয়ামে ধ্বংসলীলা চালিয়ে হাজার বছরের পুরাতন সম্পদ নষ্ট,কি না করেনি আইএস আইএস।
 
সৌভাগ্যক্রমে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে এই আইএস এর হাত থেকে বেঁচে ফেরা কেবক নামের একজনের সাথে আমার পরিচয় হয়।পরবর্তিতে তাঁর সাথে ধীরে ধীরে সম্পর্ক একটু ঘনিষ্ট হয়।এর মাস দুয়েক পরে একদিন একসাথে কফি পান করার সময় কোন এক কথা প্রসঙ্গে বলেন ”আইএস কি জিনিস তা আমার থেকে ভাল কে জানবে”।
 
একথা শুনার পর আমি একটু চেপে ধরলে বলেন,আইসিস এর হাত থেকে আমি এবং আমার স্ত্রী সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরেছি। বললাম,বলা যাবে কি ঘটেছিল? উনার উত্তর ছিল,আজ না অন্য কোনেকদিন বলব। তারপর অনেকদিন চলে যায় আমি আর জিজ্ঞেস করিনি।মনে মনে ভাবছিলাম হয়ত সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি তিনি আর মনে করতে চাচ্ছেন না।
 
গত সপ্তাহে( ২০ এপ্রিল) আমাকে বললেন,আজ তোমাকে আমার সেই বেঁচে ফেরার ঘটনাটা বলি।সত্য কথা কি জান,আজকাল ভরসা করতে বড্ড ভয় হয়,বিশ্বাস করতে ভয় হয় তাই এতদিন বলা হয়ে উঠেনি। উল্লেখ্য,গত ১৩ তারিখে সিরিয়ার অবস্থা নিয়ে একটি অনুষ্টান হয়,যেখানে ভিক্টিমেরা তাঁদের কথা বলেন এবং পরবর্তিতে সিরিয়ায় প্যালেস্টাইন অধ্যুষিত ইয়ারমুক ক্যাম্প নিয়ে "The Shebabs of Yarmouk” নামে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম প্রদর্শিত হয়।টিকেট কিনে যাওয়ার জন্য সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখার পরও ওইদিন সন্ধ্যায় কোন একটি ঝামেলার কারণে আর যাওয়া হয়নি।
 
চলেন,আইএস এর হাত থেকে বেঁচে ফেরা মানুষটির মুখ থেকেই শুনা যাক তাঁর বিভীষিকাময় সেই অভিজ্ঞতার কথা।
 
২০১৪ সালের মার্চ মাসে আমি এবং আমার স্ত্রী নিজেদের প্রাণ রক্ষার্থে আমাদের নিজেদের শহর আলেপ্প (Aleppo,সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর) আর দেশ সিরিয়া ছেড়ে তুরস্ক
 
চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই।আমার স্ত্রী তখন প্রায় তিন মাসের অন্ত:সত্ত্বা। ততদিনে শহরের আশপাশ আর আলেপ্প থেকে তুরস্ক যাওয়ার প্রধান ফটক বাব আল-হাওয়া (Bab al-Hawa) আইসিসরা দখল করে নিয়েছে।
 
আমাদের ধর্ম ক্রিশ্চান। যদিও ধর্মর সাথে খুব ভাল সখ্যতা আমার হয়ে উঠেনি কোনদিন।ওদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমরা শহরের একজন মুসলিম চালকের কার ভাড়া করি।তাঁর সাথে চুক্তি ছিল। বাব আল-হাওয়া পার করে আমাদের নিরাপদ দূরত্বে কোন স্থানে নামিয়ে দেওয়া। বাব আল-হাওয়া পৌছার পর আমাদের গাড়ি থামানো হয়।চালককে জিজ্ঞাসাবাদের পর আমাদেরকেও জিজ্ঞাসা করতে ডাকা হয়।

প্রথমে আমার নাম আর স্ত্রীর নাম বলতে বলা হয়।আমি যখন আমার নাম কেবক এবং আমার স্ত্রীর নাম বলি।সাথে সাথে বলা হয় তোমরা মুসলিম নও? আমি বললাম না। তখন আমাদেরকে ঘিরে ফেলা হয় এবং কিছুক্ষণ পর আমাদেরকে একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। আরও কিছুক্ষণ পর ওদের একজন নেতা ধরনের(হয়ত) লোক কক্ষে প্রবেশ করে। তারপর আমাদের সাথে থাকা সব কাগজপত্র নিয়ে নেওয়া হয়।সে বলে,তোমরা মুসলিম নয় এর অর্থ কি তোমরা জান? তোমাদের এখন মৃত্যুবরণ করতে হবে,প্রস্তুত হও। আমি বললাম,আমার স্ত্রী ৩ মাসের অন্ত:সত্ত্বা,আমাদের যেতে দেয়ার জন্য অনুরোধ করলাম। বলা হল,তোমরা মুসলমান নও,তার একটাই অর্থ,মৃত্যু।তোমাদের মৃত্যু লেখা হয়ে গেছে।

অনুরোধ করে বললাম,আমাদের হত্যা করে তোমাদের কি লাভ হবে বল। তারপর সে বেরিয়ে গেল কক্ষ থেকে।কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলল তোমাদের দুজনকে দশ হাজার ডলার দিতে হবে অথবা মৃত্যু।কোনাটা নিবে তোমাদের পছন্দ কর? আমার কাছে সব মিলিয়ে তখন পাঁচ হাজার ডলার ছিল,বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে।

অনেক মিনতি আর অনুরোধ করলাম ওদেরকে,আমার পাঁচ হাজার থেকে চার হাজার ডলার নিয়ে নিতে এবং দয়া করে এক হাজার ডলার আমাকে দিতে।আমাদেরকে এখান থেকে যদি মুক্তি দেওয়া হয় তাহলে এখান থেকে গিয়ে বেঁচে থাকার জন্য হলেওতো আমাদের কিছু টাকা লাগবে। রাজি না হয়ে কিছু না বলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল পুনরায়।প্রায় অনেকক্ষণ চলে যাওয়ার পর সে আবার ফিরে এল কক্ষে।অনেক মিনতি করার পর আমাদের ছেড়ে দিবে তবে টাকা দেওয়া হবে না।

তারপর আমাদের ওরা ফটকের বাইরে নিয়ে আসে ছেড়ে দেওয়ার জন্য।ছেড়ে দেওয়ার পুর্ব মুহুর্তে আমাদেরকে এক হাজার ডলার ফিরত দিয়ে বলল-আর কিছুক্ষণ পর যদি আমাদের আশেপাশে দেখা যায় তাহলে সাথে সাথেই গুলি করা হবে,এখনি যেন সিরিয়া ছেড়ে চলে যাই। অতঃপর অনেক কষ্টে স্ত্রীকে নিয়ে তুরস্ক পৌছাই।সেখান থেকে পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে টাকা আনিয়ে আবার অনেক কাটখড় পুড়িয়ে ফ্রাঞ্চ এসে পৌছি।

সবশেষে তিনি যা বললেন তা বর্তমান সময়ের একেবারে বাস্তব সত্য।ওরা এখন বর্বরতার চূড়ান্ত সীমাও অতিক্রম করেছে। বললেন,আমরা অনেক ভাগ্যবান ছিলাম যে বেঁচে চলে আসতে পেরেছি এবং তা ২০১৪ সালের প্রথম দিকে ছিল বলে।এখন যাদের আটক করা হয় তাঁদের কোন ধরনের সুযোগ না দিয়ে সরাসরি হত্যা করা হয়।পরিচিত অনেককেই হারাতে হয়েছে।এদের থামানো না হলে মানব সভ্যতা হয়ত নিকট ভবিষ্যতে হুমকির মুখে পতিত হবে। প্রায় ২-৪ ঘণ্টার মত আটক ছিলেন তাঁরা।আটক থাকা অবস্থায় তাঁদের সাথে কি ধরনের ব্যবহার আর অত্যাচার করা হয়েছে সে বিষয়ে বলার মত সাহস বা মানসিকতা আমার অবশিষ্ট নেই তা শুনার পর।উনাকেও ভাল করে জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি। পুরো নাম না দেওয়ার অনুরোধ করায় উনার সংক্ষিপ্ত নামটা ব্যাবহার করেছি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত