আবদুল হাই আল-হাদী

০৫ জুন, ২০১৭ ০০:৩১

ক্ষ্যাপা একটি নদীর নাম

লালন, নজরুল কিংবা জীবনানন্দের সৃষ্টির ভেতর দিয়ে ক্ষ্যাপা বাংলাভাষী অনেকের কাছেই পরিচিত। কারও-বা আপনজন, কারও আবার প্রাণসখা। রুপকের ভেতর দিয়ে উপস্থাপিত সে 'ক্ষ্যাপা’র রুপ নানাবিধ ও বৈচিত্র্যময়।  কবি, বাউল, ভাবুক ও শিল্পীরা বিভিন্ন অর্থে ক্ষ্যাপাকে ব্যবহার করেছেন নিজেদের সৃষ্টিকর্মে। সে পরিচিত ’ক্ষ্যাপা’র বাইরেও আরেক ’ক্ষ্যাপা’ আছেন যিনি নদীরুপে প্রবাহিত হয়েছেন। এক চিরশান্ত, সৌম্য, পরোপকারী’র প্রতিচ্ছবি হচ্ছে এ ক্ষ্যাপা নদী।

ক্ষ্যাপা একটি নদীর নাম। নিসর্গের বুক চিরে নদীটি ক্রমশ: চলে গেছে দিগন্তের পানে। পশ্চিম হতে আঁকা-বাঁকা পথ ধরে চলতে চলতে আস্তে আস্তে সে চলে গেছে পূর্বদিকে। চলতি পথে সে মোলাকাত করেছে আরও অনেক নদীর সাথে। মিলনে সে নিজেকে পুষ্ট করেছে, বাড়িয়েছে আপন গতি। সে ছুঁয়ে গেছে অনেক জনপদকে, সখ্য করেছে সেখানকার প্রাণ ও প্রকৃতির সাথে। পলি দিয়ে সে বাড়িয়েছে জনপদের উর্বরতা, সহায়তা করেছে চাষাবাদে। জনপদের মানুষেরাও তাঁর সাথে পেতেছে মিতালী, ভাগাভাগি করেছে নিজেদের সুখ-দু:খ ও আনন্দ-বেদনার পাঁচালী। হাওর-বাওরকে সে যেমন প্রাণসঞ্চারণ করেছে তেমনি মানুষদেরও সেগুলোর সাথে সখ্যতা পোক্তকরণে সে পালন করেছে অনুঘটকের ভূমিকা। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকাভূক্ত নদীগুলোর অন্যতম একটি নদী এটি।  

অনাদিকাল থেকে ক্ষ্যাপা ছুটে চলেছে আনমনে । নদীটির নামকরণ ’ক্ষ্যাপা’ করে যেন তাঁর সাথে অবিচার করা হয়েছে ! কারণ ক্ষ্যাপা নামটির সাথে এক ধরণের নেতিবাচকতা ও বিদ্রোহী ভাব জড়িয়ে আছে। প্রকৃতি ও জীবনের চিরসখা এ নদীটির নামের সাথে কাজের কোন মিল তেমন একটা পাওয়া যায়না। নামই যেন তাঁর এক আজন্ম কলংক ! আঁকা-বাঁকা পথে কল-কল জল নিয়ে খলখলিয়ে সে চলেছে তো চলছেই। একুল ভেঙ্গে ওকুল গড়ার চিরচেনা কলংকের লেশমাত্র নেই তার মধ্যে। বর্ষার ভরা যৌবনে সে জল বয়ে নিয়ে আসে, একুল-ওকুলে হিসেবি হাতে ছড়িয়ে দেয় সে জল। জলের সাথে বয়ে নিয়ে আসা পলিতে উর্বর করে কৃষকের ফসলী ময়দান। মাছেরা প্রশান্ত জলে জলকেলী করে, পয়দা করে আপন বাচ্চা-কাচ্চা। নদীর যৌবনসুধায় ক্রমশ: বড় হয়ে নিজেদের প্রজন্মের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। তীরের মানুষেরা হরেক পদ্ধতিতে শিকার করে সেসব মাছ। সে নদীর জলকেলীতে মেতে উঠে বালিহাঁস, ডাহুক আর কানাবক । বাসা বাঁধে নদীতীরের বিন্না-ইকড় আর ছনের ঝোপে। নদীর তীরে মাঝে মাঝে দেখা যায় হিজল আর করচের সারি। মনে হবে যেন একঝাঁক সন্ন্যাসী জনমানবহীন নদীতীরে মগ্ন আছে গভীর ধ্যানে।
 
ক্ষ্যাপা নদীটি জন্মলাভ করেছে সারি নদী হতে। সারি ব্রিজের পশ্চিম দিকে সে পুড়াখাই নাম ধারণ করে প্রবেশ করেছে খলাগ্রাম হাওরে। এর তীরেই বানইনয়াখেল গ্রাম। প্রায় তিন মাইল পশ্চিমে  ’রাঙারডওয়ার’ নামক স্থানে এটি বাঁক নিয়ে ক্রমশ: প্লাবিত করেছে বেদু হাওর ও পাঁচভাগ হাওরকে। এটির প্রায় ১ মাইল পূর্বে বিছনাটেক, ডাইয়া, ফান্দু ও ডৌডিক গ্রামের অবস্থান। হাওরের ভেতর দিয়ে দক্ষিণ দিকে  প্রায় ৫ মাইল পথচলার পরে এটি কুটাপারা-নয়ামাটি-লাতু গ্রামের কাছে এসে আবার পূর্বদিকে বাঁক নিয়েছে। পূর্বদিকে প্রায় ৩ মাইল পর এটি দামড়ি নামক স্থানে এসে খানিকটা থিতু হয়েছে। দামড়িতে এসে এটি সিলেট-তামাবিল সড়ককে ভেদ করে আবার দক্ষিণ দিকে নব যাত্রা করেছে। এ দামড়িতেই নদীটির তীরে এককালে গড়ে উঠেছিল বিখ্যাত দামড়ি বাজার । পাহাড় আর সমতলের মানুষের পণ্য কেনা-বেচার এক জনপ্রিয় স্থানে পরিণত হয়েছিল বাজারটি।

যাহোক, সেখান থেকে নদীটি এঁকেবেঁকে দক্ষিণ দিকে প্রায় দু’কিলোমিটার পর আবার পূর্বদিকে মুখ ফিরিয়েছে। এরমধ্যে ক্ষ্যাপা মেশিনের ভাঙ্গা নামক স্থান দিয়ে যুক্ত হয়েছে মেদল বিলের সাথে। প্রাকৃতিক মাছের এক অফুরন্ত ভান্ডার এ মেদল বিল। এর সাথে যুক্ত হয়েছে পনিয়া বিল।  এ বিলটির প্রাণ ও প্রকৃতির প্রাণভোমরা কিন্তু এ ক্ষ্যাপা নদী। বিলটির পারের হিজলের ঘন সারি সত্যিই যেন নিসর্গের এক অপরুপ সৃষ্টি।  

এরপর ক্ষ্যাপা তার আপন গতিতে ক্রমশ: হাওর-বাওরের মধ্য দিয়ে চলে গেছে পূর্বদিকে। সে মেলাইন, দুপনি, হাড়ি পাবিজুরি ওরফে ফাল্লি, ধলাইর হাওর, মেধার হাওর, মরা কান্দি, ডেঙ্গাইর হাওর, লুনি বিল, উত্তর ইলাকুঞ্জি প্রভৃতি  বিল ও হাওরকে যুক্ত করেছে এর সাথে। মেশিনের ভাঙ্গা অতিক্রম করে ক্ষ্যাপা আরও পূর্বদিকে প্রায় ৫ মাইল চলার পর কুইরমুখ নামক স্থানে পাবিজুরি-কুশিগাঙ-কুশিয়া নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। অনেকে জায়গাটিকে তেগাঙ্গা বলে পরিচিত। সেটির মিলনে ক্ষ্যাপা হয়েছে আরও যৌবনা। ক্রমশ: এটি পূর্বদিকে যেতে যেতে মিলিত হয়েছে পাবিজুরি নদীতে । এ পাবিজুরিতেই কিন্তু সারির আরেক শাখা নদী লাইন এসে মিলিত হয়েছে। তাবে সেখানে নদীটি সুন্দ্রাকান্দি-ইছবা নামে পরিচিত।  মূলত: এ তিন গাঙ্গের সঙ্গমস্থল থেকে প্রবাহিত দক্ষিণমুখী নদীটি কুশিগাঙ নামে পরিচিত । কুসিগাঙ সিলেটের ঐতিহ্যবাহী 'বড়হাওর’ দিয়ে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়েছে। এটি হাওরের মধ্য দিয়ে চলতে চলতে কানাইঘাট, গোলাপগঞ্জ আর সিলেট সদরের সীমানা পৃথক করে ছুঁয়ে টুলটিকরে বুরহানউদ্দিন (রহ.) এর মাজার সংলগ্ন স্থানে সুরমার সাথে মিলিত হয়েছে।   

পানি উন্নয়ন বোর্ডের 'বাংলাদেশের নদ-নদী’ শীর্ষক গ্রন্থে 'ক্ষ্যাপা নদী’ সম্পর্কে বলা হয়েছে 'ক্ষ্যাপা নদীটি সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার আলীরগাঁও ইউনিয়নে পোড়াখাল-খাইয়া থেকে উৎপত্তি হয়ে সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলার দরবস্ত ইউনিয়নে পাবিজুরি-কুশিগাঙ-কুশিয়া নদীতে পতিত হয়েছে। নদীটির পানি খুবই স্বচ্ছ ও পরিস্কার থাকে বলে এর মাছ খুবই সুস্বাদু হয়। নদীতে কোন ভাঙ্গন নেই এবং বর্ষাকালে দু’কুল প্লাবিত হয়। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১১ কিলোমিটার এবং গড় প্রস্থ প্রায় ২৪ মিটার।’
    
'রাজার বাড়ীরঘাট’ নামক স্থানে একটি স্থান আছে ক্ষ্যাপা’র তীরে । প্রাচীন কোন নিদর্শন না থাকলেও জায়গাটি নিয়ে লোকমুখে ছড়িয়ে আছে মজার এক কাহিনী। কাহিনীটি এরকম, জৈন্তিয়া রাজ্যের রাজারা নিজেদের রাজ্য দেখাশুনা ও ভ্রমণের জন্য নির্দিষ্ট কিছু নৌপথ ব্যবহার করতেন। রাজ্যের দক্ষিণ দিকে যাতায়াতের জন্য ক্ষ্যাপা নদীকে ব্যবহার করা হত। একবার জনৈক রাজা অনেক লোকলস্কর নিয়ে ক্ষ্যাপা দিয়ে দূরযাত্রায় বের হন। ক্ষ্যাপা নদী  দিয়ে যাত্রাকালে ’রাজার বাড়ীরঘাট’ নামক স্থানে পৌছলে অনেক রাত হয়ে যায়। তখন হাওর ও গহীন জনমানবহীন অরণ্যে সামনে না এগিয়ে এস্থানেই রাত্রিযাপনের সিদ্ধান্ত নেন। সাথে সাথে তাবু খাটিয়ে বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হয়। রাজা পরদিন এখান থেকে পুনরায় যাত্রা করেন। এরপর থেকেই স্থানীয় মানুষদের কাছে স্থানটি ’রাজার বাড়ীর ঘাট’ নামে পরিচিত।  

ক্ষ্যাপা আবহমান কাল থেকে আপন গতিতে ছুটে চলছে। ছুটে চলাতেই যেন তার সব আনন্দ। কিন্তু সে ক্ষ্যাপা ক্রমেই তাঁর গভীরতা হারিয়ে ফেলছে । তাঁর তীরে তৈরি করা হচ্ছে ইটভাটা। সে ইটভাটার জন্য মাঝে মাঝে নদীর তলদেশ থেকেও মাটি খুঁেড় নেওয়া হয়। মানুষের আপনজন চিরহিতৈষী ক্ষ্যাপার যৌবন যেন চিরঅটুট থাকে সেজন্য  নদীর তলদেশ খনন করা প্রয়োজন। ক্ষ্যাপা-ই স্থানীয় অসংখ্য হাওর-বাওর, বিল-ঝিল, নালা-ডোবার প্রতিবেশ ও বাস্তুসংস্থানের প্রাণভোমরা। ক্ষ্যাপার বাঁচা-মরা-জীবনের সাথে এগুলো অস্তিত্ব অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত।  ক্ষ্যাপা তীরের বাসিন্দা, তরুণ সমাজসেবী ও ইউ/পি সদস্য মো. আব্দুর রকিব এ ব্যাপারে বলেন, ক্ষ্যাপা নদী আমাদের দিয়েছে অনেক। নিরীহ নদীটির কারও ক্ষতি করার কোন রেকর্ডও পাওয়া যায়না। ঐতিহাসিক এ নদীকে রক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাই আরোও মনোযোগী হবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। আনমনা উদাসী ক্ষ্যাপা’র দিগন্তপানে ছুটে চলা দেখে মনে পড়ে লালনের সে গানটি-
 
’ক্ষ্যাপা তুই না জেনে তোর আপন খবর যাবি কোথায়।
আপন ঘর না বুঝে বাহিরে খুঁজে পড়বি ধাঁধায়।

আমি সত্য না হইলে
হয় গুরু সত্য কোন কাজে
আমি যেরুপ দেখ না সেরুপ দীন দয়াময়।
আপনার আপনি না চিনে
ঘুরবি কত ভুবনে
ঔালন বলে, অন্তিম কালে নাই রে উপায়।’
কিংবা
’খেপা তুই বাধবি কোথা ঘর,
এনের মানুষ থাকলো যখন
ওঙ্গ-রসের ভেতর... ।’

লেখক : প্রাবন্ধিক; সভাপতি, সারি নদী বাঁচাও আন্দোলন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত