সিলেটটুডে ডেস্ক

০২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০১:৫৮

‘চল চল চল’ কবিতাকে রণসংগীত করেছিলেন জেনারেল ওসমানী

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ কবিতার প্রথম দুই স্তবক বাংলাদেশের রণসংগীত। সংশ্লিষ্ট উৎসব-অনুষ্ঠানে এই কবিতার প্রথম ২১ চরণ বাজানো হয় রণসংগীত হিসেবে। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না এই রণসংগীত কে চূড়ান্ত করেছিলেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনী ও সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি ছিলেন মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী, যিনি জেনারেল এম এ জি ওসমানী নামে অধিক পরিচিত। তিনি পাকিস্তান ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মার্চ সঙ্গীত হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের জনপ্রিয় বাংলা কবিতা ‘চল চল চল’কে অনুমোদন করিয়েছিলেন।

মূলত তিনি বেঙ্গল রেজিমেন্টর সৈন্যদের বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করতে একটি মনোবল বাড়ানোর স্লোগান বা মন্ত্র ঠিক করতে চেয়েছিলেন। এজন্য শুধু তার রেজিমেন্টের জন্যই তিনি রণসংগীত ঠিক করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালি কর্মকর্তাদের ওপর ওসমানীর প্রভাব ছিল অনেক বেশি। এ কারণে রণসংগীতটিও অতি দ্রুত সবাই গ্রহণ করেন। পরে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বিভিন্ন প্রশিক্ষণে এই রণসংগীত ব্যবহার করেছিলেন উপস্থিতদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। পরবর্তী সময়ে এই কবিতা বাংলাদেশের রণসংগীত হিসেবে চূড়ান্ত হয়।

১৯১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জে মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী জন্ম নেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সামরিক নেতৃত্ব দেন। অসাধারণ বীরত্ব আর কৃতিত্ব প্রদর্শন করে তিনি পশ্চিমাদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করেন।

বঙ্গবীর ওসমানী ১৯৩১ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। পরের বছরেই তিনি সামরিক শিক্ষা শেষ করে বৃটিশ কমিশনপ্রাপ্ত হন। ১৯৪১ সালে ক্যাপ্টেন এবং ১৯৪২ সালে তিনি মেজর পদে উন্নীত হন। তিনিই ছিলেন তখনকার বৃটিশ সাম্রাজ্যের সর্বকনিষ্ঠ মেজর। মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি একটি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হয়ে সামরিক ইতিহাসে অনন্য নজির স্থাপন করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর তিনি আত্মনিয়োগ করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী গঠনে। এ সময় তিনি ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন। ১৯৫৭ সালে উন্নীত হন কর্নেল পদে। ইপিআর প্রতিষ্ঠায় রয়েছে তার বিশাল অবদান। তারই ধারাবাহিকতায় একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনায় গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয় তার ওপর। ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে তিনি দুবার জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ধোপাদীঘির পাড়ের বঙ্গবীর ওসমানীর পৈতৃক বাড়িটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ শেষে তিনি নিজ উদ্যোগে বাংলো টাইপ ঘর নির্মাণ করেন সেখানে। ১৯৭৬ সালের ১৮ মে এ বাড়ির ২ বিঘা জায়গায় তিনি তার বাবা-মার নামে গঠন করেন জুবেদা খাতুন খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ট্রাস্ট। এ ট্রাস্টের মাধ্যমে মেডিক্যাল ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট ক্যাটাগরিতে বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। একই সঙ্গে ঢাকার ধানমন্ডির রোড ১০-এ, বাড়ি নং ৪২-এর সুন্দরবন নামক ওসমানীর নিজস্ব বাড়ির সম্পত্তি দিয়ে আর্তমানবতার সেবার লক্ষ্যে গঠন করা হয় ওসমানী ট্রাস্ট।

বঙ্গবীর ওসমানীর মৃত্যুর পর ১৯৮৭ সালে তৎকালীন এরশাদ সরকার সিলেটে ওসমানীর নামে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার আগ্রহ প্রকাশ করেন। সে অনুযায়ী জুবেদা খাতুন-খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ট্রাস্টের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে ৯৯ বছরের জন্য ধোপাদীঘির পাড়ের বাড়িটি লিজ নেয় সরকার। ১৯৮৭ সালের ৪ মার্চ এ বাড়িতে ওসমানী জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সেই থেকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় জাদুঘরের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে এটি।

যুদ্ধপরবর্তী জীবনে ১৯৭১ সালের ২৬ ডিসেম্বর তাকে বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সের জেনারেল পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৭২ সালে দায়িত্ব থেকে অবসর নেন। মন্ত্রিসভায় যোগ দেন অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ, জাহাজ ও বিমান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে। ১৯৭৩ সালের মার্চে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে ওসমানী তার নিজের এলাকা থেকে অংশ নেন এবং নির্বাচনে অভাবনীয় সাফল্য লাভ করেন।

১৯৭৩ এর নির্বাচনে ওসমানী ৯৪ শতাংশ ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন। ডাক, তার, টেলিযোগাযোগ, অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ, জাহাজ ও বিমান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন। ১৯৭৪ সালের মে মাসে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি সংসদ সদস্য পদ এবং আওয়ামী লীগের সদস্য পদ ত্যাগ করেন। সে বছর ২৯ আগস্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদের প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা পদে নিয়োগ পান, তবে ৩ নভেম্বর জেলহত্যার ঘটনার পর পদত্যাগ করেন। ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওসমানী জাতীয় জনতা পার্টির নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৭৮ ও ১৯৮১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করেন।

ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার্থে লন্ডন থাকাকালীন ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন এই বীর। তার অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী হজরত শাহজালালের (র.) দরগাহ সংলগ্ন কবরস্থানে মায়ের পাশে লাশ সমাহিত করা হয়। তিনি পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় সিলেটে সমাহিত হন।

সূত্র : রাইজিং বিডি

আপনার মন্তব্য

আলোচিত