নিজস্ব প্রতিবেদক

২৭ মে, ২০১৫ ১৮:৩১

কীনব্রিজের ‘ঠেলাওয়ালা’

নগরবাসীর কাছে তাদের পরিচয় ‘ঠেলাওয়ালা’ হিসেবে। যদিও তারা কেউই ঠেলাগাড়ি চালান না। সিলেট নগরীর কীনব্রিজ দিয়ে চলাচলকারী রিকশা ও ঠেলাগাড়ির পেছনে ধাক্কা দিয়ে ব্রিজে তুলতে সাহায্য করেন তারা। এই ‘ঠেলা’ দিয়ে দিয়েই টেনে চলেন নিজের জীবনের চাকাও।

তারা সংখ্যায় প্রায় দেড় হাজার। একেক জনের দৈনিক আয়ও হাজারখানেক টাকা। বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা শ্রমিকদের বেশিরভাগকেই ‘কীন ব্রিজের ঠেলাওয়ালা’ হিসেবেই শুরু করতে হয় সিলেটে নিজেদের পেশাদারি জীবন।

কীন ব্রিজ সিলেট নগরীর প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত। সিলেটের ঐতিহ্যেরও অংশ হয়ে ওঠেছে দৃষ্টিনন্দন এই সেতুটি। ১৯৩৬ সালে নির্মিত এই সেতুটি আসামের তৎকালীন গভর্নর মাইকেল কীন’র নামে নামকরণ করা হয়। স্টিলের তৈরী এই ব্রিজটি দৈর্ঘ্য ৩৯৫ মিটার। কীন ব্রিজে চলাচল করা অনেকটা পাহাড় চড়ার মতো। উঁচু সেতুটিতে খাড়া পথ দিয়ে উঠে ঢালু পথ দিয়ে নামতে হয়।

পুরনো হয়ে যাওয়ায় সেতুটি এখন ভারি যানচলাচলের অনেকটা অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ফলে দীর্ঘদিন ধরেই কেবল রিকশা ও ঠেলাগাড়িই চলাচল করে এই ব্রিজ দিয়ে। উঁচু সেতুটিতে এসব রিকশা ও ঠেলাগাড়িকে টেনে তুলতে প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত লোকবলের। এই প্রয়োজনীয়তা থেকেই ‘কীনব্রিজের ঠেলাওয়ালা’ পেশা হয়ে গেছে অনেকের।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ব্রিজের দুইপাশেই অনেকটা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন ‘ঠেলাওয়ালারা’। ব্রিজ দিয়ে চলাচলকারী রিকশা ও ঠেলাগাড়ি চালকরাই তাদের ডেকে নেন সহযোগীতার জন্য। আবার অনেক সময় ঠেলাওয়ালারাই রিকশা ও ঠেলাগাড়ি দেখলে হাঁক দেন, ‘এই, ঠেলা লাগবো, ঠেলা...’।

দিনভর পরিশ্রম করে শ্রমিকরা কীন ব্রিজের গোড়া, সিলেট রেলস্টেশন আবার কেউ কেউ বিভিন্ন কলোনিতে রাত কাটান। ব্রিজ এলাকায় গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি খাবারের দোকান। এসব দোকানেই শ্রমিকরা খাওয়া-দাওয়া করেন।

কীনব্রিজের কয়েকজন ঠেলাওয়ালার সাথে আলাপ করে জানা যায়, ঠেলা দিয়ে ব্রিজ পার করার জন্য তারা প্রতিটি রিকশার কাছ থেকে নেন ৫ টাকা করে আর ঠেলাগাড়ির কাছ থেকে নেন ১০ টাকা করে। এই টাকা রিকশাযাত্রী আর ঠেলাগাড়ির পণ্যের মালিককেই দিতে হয়।

তারা জানান, কীনব্রিজে সহস্রাধিক ‘ঠেলাওয়ালা’ রয়েছেন। তারা কাজ করেন দুই শিফটে। যারা সকালে আসেন তারা দুপুর হলেই চলে যান। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত
আরেক দল আসেন ঠেলা দিতে। নিজের মধ্যে আলপ আলোচনা করেই এই সময় বন্টন করে নিয়েছেন তারা।

ঠেলা দিয়ে একেকজনের প্রতিদিন ৫শ’ থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হয়। বিভিন্ন জেলা থেকে সিলেটে আসা বেশিরভাগ শ্রমিককেই প্রথমে কিছুদিন ‘কীনব্রিজের ঠেলাওয়ালা’ হিসেবে কাজ করতে হয় বলে জানান শ্রমিকরা। তবে এই কাজ অত্যন্ত শ্রমসাধ্য ও কষ্টদায়ক বলে দাবি সকলের।

এই পেশায় থাকা মিঠু নামের এক যুবক বলেন, ‘রিকশা ঠেলানি খুব কষ্টের, রিকশা ঠেলানির সময় পেটের ক্ষুধায়ও ঠেলা দেয়। সারাদিন ঠেলা দিয়ে রাত হলেই শরীরে হাড়ে হাড়ে ব্যথা করে।’ মিঠু জানান, রিকশা ঠেলে প্রতিদিন তার ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় হয়। এ আয় দিয়েই তার সংসার চলে। তবে হরতাল হলে বেকার থাকতে হয়।

রংপুরের বাসিন্দা আজগর নামের আরেকজন শ্রমিক জানান, বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিদিন প্রচুর সংখ্যক শ্রমিক সিলেটে আসেন। সিলেট নগরীতে আসা এসব শ্রমিকদের প্রথম ঠিকানা হলো কীনব্রিজ। আর প্রথম পেশা হলো এখানে রিকশা ঠেলা।

তিনি বলেন, বাইরে থেকে সিলেটে এসে প্রথমে কেউই কাজ পায় না। তাই নতুন শ্রমিকরা এসে রিকশা ঠেলার কাজে যোগ দেয়। এখানে কিছুদিন কাটানোর পর তারা অন্য কাজ খোঁজে নেয়। এই কাজের জন্য কোনো দালাল ধরতে হয় না এবং কাউকে চাঁদা দিতে হয় না বলে জানান তিনি।

বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার টংরাখালি গ্রামের নুরুল ইসলাম জানান, গত ৯ বছর ধরে এই ব্রিজে রিকশা ঠেলার কাজ করছেন তিনি। তিনি বলেন, কষ্টদায়ক হলেও এটি একেবারে স্বাধীন পেশা। কাজ না করলেও কেউ কিছু বলার নেই। কাউকে জবাবদিহীতা করতে হয় না।  

তিনি বলেন, অনেক দালাল কাজ দেওয়ার কথা বলে উত্তরবঙ্গ থেকে সিলেটে শ্রমিক নিয়ে আসে। কিন্তু সিলেটে এনে কাজ না দিয়ে দাললরা পালিয়ে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে এসব শ্রমিকদের প্রথমে কীনব্রিজে রিকশা ঠেলার কাজ করতে হয়।


আপনার মন্তব্য

আলোচিত