সদরুল আমিন, ছাতক

১৪ জানুয়ারি, ২০১৮ ০৯:৪৪

ছাতকে কালের সাক্ষী ম্যাকনিল এন্ড কিলবার্ন

ছাতকের ঐতিহাসিক নিদর্শন ও ব্যবসায়িক দিকপাল ম্যাকনিল এন্ড কিলবার্ন কোম্পানির কার্যালয় কালের সাক্ষী হিসেবে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। শহরের প্রাণকেন্দ্র বাগবাড়ি এলাকার পৌরসভা অফিস সংলগ্ন সুরমা নদীর তীরঘেষা ঐতিহাসিক ম্যাকনিল এন্ড কিলবার্ন কোম্পানির প্রধান কার্যালয় অবস্থিত।

ছাতক তথা বৃহত্তর সিলেটের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত প্রাচীনতম ব্যবসায়ি প্রতিষ্ঠান ম্যাকনিল এন্ড কিলবার্ন কোম্পানির প্রধান কার্যালয় বর্তমানে অবহেলা ও অযত্নে পড়ে আছে। দেশের চুন ও পাথরসহ বিভিন্ন ব্যবসা মূলত প্রাচীনতম এ ব্যবসায়ি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে।  

আড়াই শতাধিক বছর পূর্বে এ অঞ্চলে সর্ব প্রথম চুন ও চুনাপাথর ব্যবসার গোড়াপত্তন করেন ম্যাকনিল এন্ড কিলবার্ন কোম্পানির সত্ত্বাধিকারী ইংল্যান্ডের নাগরিক ব্যবসায়ি কিম বারকি। তার নামানুসারেই সিলেট অঞ্চলের পাথর, চুনাপাথর, কমলা পরিবহনের জন্য এক বিশেষ ধরনের নৌকার নামকরণ হয়েছিল বারকি নৌকা। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ও ব্যবসায়িক সুবিধার জন্য তিনি তৎকালীন সময়ে সুরমা নদীর তীরে প্রতিষ্ঠা করেছিলে দৃষ্টিনন্দন সু-বিশাল ব্যবসায়ি কার্যালয় ম্যাকনিল এন্ড কিলবার্ন কোম্পানি।

অবহেলায় পড়ে থাকলেও কারুকার্যমণ্ডিত টিনসেডের এ বাহারি ও বিলাসবহুল কার্যালয়টি পথচারীদের নজর এখনো কেড়ে থাকে। পৌরাণিক নির্মাণ শিল্পের সুচারু শৈল্পিক নিদর্শন ম্যাকনিল এন্ড কিলবার্ন নামের কার্যালয়টি এতোটুকু মলিন হয়ে যায়নি।
চুন ও পাথর ব্যবসার সাথে ছাতকের কমলালেবুরও ব্যাপক সুনাম ছিল উপমহাদেশের সর্বত্রই। তখন চুন, চুনাপাথর ও ভোলাগঞ্জের পাথরের সাথে মেঘালয়ের কমলালেবুও ছিল প্রধান ব্যবসায়ি পণ্য।

বৃহত্তর সিলেট মেঘালয় রাজ্যের অধীনে থাকায় তৎকালীন সময়ে মেঘালয়ের চেলা এলাকা ভৌগোলিক ও প্রশাসনিকভাবে ছাতকের অন্তর্ভুক্ত ছিল। চেলা এলাকায় উৎপাদিত প্রচুর কমলালেবু ছাতক শহরের কাস্টম ঘাট হয়ে ‘ছাতকের কমলা’ নামে উপ-মহাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তো ব্যবসায়িদের মাধ্যমে। ছাতকের কমলা এভাবেই স্থান পায় ইতিহাসের পাতায়।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের পর কমলালেবুর সব বাগান ভারতের অংশে পড়ে যাওয়ায় বিশ্বখ্যাত সুস্বাদু এ কমলার ব্যবসা এ অঞ্চলের ব্যবসায়িদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলেও ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে যায় ছাতকের নাম।

ব্যবসায়িক সূত্র ধরে প্রায় আড়াইশ বছর আগে এ অঞ্চলে আগমন ঘটে কিম বারকি নামের এক ইংলিশ ব্যবসায়ির। এ অঞ্চলে সর্ব প্রথম তিনিই চুন ব্যবসা শুরু করেন বলে এলাকায় এখনো জনশ্রুতি আছে। চুন ব্যবসার পাশাপাশি এখানের উৎপাদিত কমলালেবু ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ও ইউরোপে রপ্তানি করে তৎকালীন সময়ে কিম বারকি প্রচুর ব্যবসায়িক মুনাফা অর্জন করেছিলেন। সেই সাথে চুন ব্যবসাকে শৈল্পিক রূপ দিতে তৎকালীন সময়ে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন এ ইংরেজ ব্যবসায়ি। ব্যবসা পরিচালনার জন্য ওই সময় ছাতকের বাগবাড়ি গ্রামের সুরমা নদীর তীরে প্রতিষ্ঠা করেন ম্যাকনিল এন্ড কিলবার্ন কোম্পানি নামের ব্যবসায়ি প্রতিষ্ঠান। টিনসেডের সু-উচ্চ বাহারি চুন-সুরকির দালান বিশিষ্ট ম্যাকনিল এন্ড কিলবার্ন পৌরাণিক নিদর্শন বয়ে চলছে আজও।

দেশ বিভাগের পর কিম বারকি এ দেশ ত্যাগ করে চলে যাওয়ার সময় ঢাকার মাহমুদুর রহমান নামের এক শিল্পপতির কাছে প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করে দেন। পরবর্তী সময় থেকে ম্যাকনিল এন্ড কিলবার্ন নামের এ কোম্পানির ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করে গেছেন ছাতক শহরের বাগবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা রবীন্দ্র কুমার আচার্য।

দীর্ঘদিন তিনি মাহমুদুর রহমানের ম্যাকনিল এন্ড কিলবার্ন কোম্পানি সততা ও নিষ্ঠার সাথে পরিচালনা করেন। তার মৃত্যুর পর এখানের সকল ব্যবসা গুটিয়ে ফেলা হলে ইংরেজ ব্যবসায়ির প্রতিষ্ঠা করা ম্যাকনিল এন্ড কিলবার্ন নামের এ ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি শুধু সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে সুরমার তীরে।

স্থানীয় দু’ব্যক্তি কেয়ারটেকার ও নৈশ প্রহরী হিসেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রাচীনতম ব্যবসায়িক নিদর্শন ম্যাকনিল এন্ড কিলবার্ন এ অঞ্চলের ইতিহাস বহন করে আসছে। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঐতিহাসিক এ নিদর্শনটি যেকোনো সময় হারিয়ে যেতে পারে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত