রিপন দে, মৌলভীবাজার

১৬ জানুয়ারি, ২০১৮ ২১:০৩

আলোর মশাল হাতে সূর্যদাস তপন

হাজারো শিশুর জীবনকে নিরবে আলোকিত করে যাচ্ছেন আলোর মশাল হাতে ছুটে চলা সূর্যদাস তপন। সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের জন্য কাজ করতে চান আমৃত্যু।

কবিতা লিখতেন সূর্যদাস তপন, ছিলেন প্রকৃতিপ্রেমীও; সে টানেই অবসরে জেলার বিভিন্ন চা-বাগানের সবুজে টানে ছুটে যেতেন। তাতেই নজরে আসে শিক্ষা ও সুবিধাবঞ্চিত চা বাগানের লক্ষাধিক শিশুর প্রতি যাদেরকে সামনে হাতছানি দিচ্ছে নিরক্ষরতার অন্ধকার। বেকার তপনের মনে দাগ কাটে শিশুদের নিশ্চিত অন্ধকার ভবিষ্যৎ। তখনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন এই শিশুদের জন্য কিছু করবেন।

সময় তখন ২০০১ সাল; সদ্য বাবা হারিয়েছেন তপন। সংসারের গুরুদায়িত্ব কাঁধে তার। পৈতৃক ফটো স্টুডিওর দায়িত্ব বুঝে নিয়ে হয়ে যান ফটোগ্রাফার। বাবার রেখে যাওয়া ক্যামেরাই হয়ে ওঠে তার জীবন চলার সম্বল। নিজের সঞ্চয় কিছু নেই জেনেও সংসারের নিত্যদিনের খরচ থেকে টাকা বাঁচিয়ে সীতানাথ বসাকের আদর্শলিপি কিনেন। সেই বই প্রতি শুক্রবার স্টুডিও বন্ধ রেখে চা বাগানের শিশুদের হাতে তুলে দিতেন সূর্যদাস তপন। পরে ভাবলেন শিশুদের জন্য একটু রঙিন চকচকে বই দরকার কারণ রঙিন বই শিশুরা অনেক পছন্দ করে। কয়েকমাস পর নিজেই ‘বর্ণকুড়ি’ নাম দিয়ে রঙিন আদর্শলিপি ছাপাতে শুরু করলেন ঢাকা থেকে। প্রতিটি বইয়ের খরচ পড়ল ১৮ টাকা।

সেই ২০০১ সাল থেকে ‘বর্ণকুড়ি’ বিতরণ করছেন মৌলভীবাজার জেলার দেওছড়া, মিরতিঙ্গা, ফুলছড়া, ভাড়াউড়া, মাইজদিহি, প্রেমনগর, গিয়াসনগর, ভুরভুরিয়া এই ৮টি চা-বাগানে। এছাড়া রাস্তাঘাট, বস্তি যেখানেই সুবিধাবঞ্চিত শিশু দেখেছেন, তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন ‘বর্ণকুড়ি’। হাওর অঞ্চলেও বিতরণ করেছেন অনেক বই।

এ পর্যন্ত প্রায় ১৪ হাজার ‘বর্ণকুড়ি’ বই শিশুর হাতে পৌঁছে দিয়েছেন তপন। শুধু নিজ জেলায় নয় যেখানেই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের দেখেন সেখানেই বই বিলি করেন। ব্যাগে সবসময় বর্ণকূড়ি থাকে। আশেপাশের যে শহরে বা গ্রামে যান সুবিধা বঞ্চিত শিশু দেখলে কাঁধে ঝুলনো ব্যাগ থেকে বের করে সেখানেই বিতরণ করেন ‘বর্ণকুড়ি’।  

ময়মনসিংহে বেড়াতে গিয়ে সেখানে ব্রহ্মপুত্র তীরের শিশুদের মধ্যে বিতরণ করেন ১০০ ‘বর্ণকুড়ি’। এছাড়া ঢাকার সদরঘাট এলাকাতেও একইভাবে ১০০ শিশুর মধ্যে ‘বর্ণকুড়ি’ বিতরণ করেন। এই বছর ফেব্রুয়ারিতে আরও ৪০০ বই বিতরণ করার প্রস্তুতি নিয়েছেন তিনি।

সূর্যদাস তপন তার স্টুডিওতে বসে আলাপকালে জানান, ‘টাকা পয়সা অনেকের আছে কিন্তু মানুষের সেবার মাঝে মানব জীবনের যে সার্থকতা তা কয়জন জানে?

আমি কত রাত নির্ঘুম  কাটিয়েছি  অসহায় এই শিশুদের কথা ভেবে,  যদি সমাজের বিত্তশালীরা তার একটু ভাবত সমাজ বদলে যেত।

তপন আফসোস করে বলেন এই পর্যন্ত সরকার বা বিত্তশালী কেউই পাশে এসে দাঁড়ালো না। এক প্রশ্নের জবাবে তপন জানান, তিনি নিজে কারো কাছে সাহায্য চাননি তবে নিজ থেকে কেউ এগিয়ে আসলে স্বাগত জানাবেন । তার দুজন বন্ধু  আছে যারা মাঝে মাঝে শিক্ষা উপকরণ দিয়ে সাহায্য করেন।

তিনি আরও জানান, চরম অর্থ কষ্টে কাটছে তার জীবন, যেখানে পরিবারের চাহিদা ঠিকমত পালন করতে পারছেন না সেখানে এত শিশুর দায়িত্ব চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায়  নিজের  সন্তানের শখের আবদার মেটাতে পারেন না তপন।  এ সব নিয়ে স্ত্রী তুলি দাস কিছুটা অভিমান করলেও কখনো তার পথচলায় বাধা হননা, মাঝে মাঝে বরং নিজ থেকেই উৎসাহ দেন।

তপন হতাশার স্বরে জানান, যখন চা বাগানগুলোতে শিক্ষার কার্যক্রম শুরু করেন তখন থেকে শিশু ও তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে প্রচুর সাড়া পাচ্ছেন। কিন্তু নিয়মিত গিয়ে পাঠদান করতে যে যাতায়াত খরচ আসে, তা দিয়ে কুলিয়ে ওঠতে না পেরে দুটি ছাড়া বাকিগুলো বন্ধ করে দিয়েছেন।  এখন চলছে মাইজদিহি চা-বাগান ও প্রেমনগর চাবাগানে দুটি পাঠশালার কার্যক্রম। তাতে তপন এবং তার নিযুক্ত দুজন শিক্ষিকার মাধ্যমে নিয়মিত পাঠদান চলছে।

পাঠশালাগুলোতে শিশুদের হাতে প্রতি ছয়মাস পরপর নতুন বই, খাতা ও পেন্সিল তুলে দেওয়া হয়। ঈদ ও পূজায় সামর্থ্য মতো নতুন কাপড়, শীতে শীতবস্ত্র তুলে দেন। প্রতি মাসে একবার অভিভাবকদের সচেতন করতে এবং তার সন্তানের বর্তমান অবস্থা জানাতে তাদের নিয়ে সভা করেন।

সূর্যদাস তপন তার লক্ষ্য সম্বন্ধে বলেন, এ কার্যক্রমের তৃণমূল পর্যায়ে সার্বিক সফলতা আসতে হলে এককভাবে আসবে না। কোনো প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসলে আমি তাদের হয়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে আমৃত্যু মাঠ পর্যায়ে কাজ করে যাবো।

মাইজদিহি চা-বাগানের ঘুরে কয়েকজন অভিভাবকের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের অনেক শিশু বর্ণ জানতো না। নোংরা পরিবেশে থাকত কিন্তু শিশুরা এখন বদলে গেছে; তারা এখন বর্ণ শিখছে। তপন বাবু যে তাদের জন্য এভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছেন এ জন্য তারা কৃতজ্ঞ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত