সাপের গ্রাম যেখানে বসে সাপের হাট। সাপকেন্দ্রিক জীবনযাত্রা হলেও সেখানেও স্বভাবিক প্রকৃতি, শিশুর নির্ম

০২ জুলাই, ২০১৫ ০০:৪৭

বংশীপারের সাপের পল্লী

ফারুখ আহমেদ

বংশী নদীর তীরে একটাই নৌকা বাঁধা। মাঝির নাম নুরুল ইসলাম। ‘নদীতে ঘুরব। কত?’ জিজ্ঞেস করতেই লাজনম্র হাসিতে বললেন, ‘দিয়েন আপনেগো খুশি মতোন।’ আমরা নৌকায় চড়ে বসলাম। বর্ষাকাল নয়। নদী ভর ভর নয়, পানি স্বচ্ছ। মাঝি নৌকা ঘোরালেন। বললেন, ‘ভাই, ওই পারে আমার বাড়ি। বরইতে রং ধরেছে, খাইবেন? চাইলে মুড়ি-গুড়ও দিতে পারব।’

বর্ষাকালের ভরা নদীর মতো আমার বুকটা ভরে গেল ভাললাগায়। হেসে বললাম, ‘চলেন।’

একি দেখি সাপের হাট: সাভারের পশ্চিম পাশ দিয়ে চলে গেছে বংশী নদী। সেখানকার বেদে গ্রাম বা সাপের পল্লীর কথা দীর্ঘদিন শুনে আসছি। তাই নিয়ে ছিল বিরাট কৌতুহল! শেষে একদিন বেরিয়ে পড়লাম। গুলিস্তান থেকে আমিনবাজার, গেণ্ডা পার হয়ে এক ঘণ্টায় পৌঁছলাম সাভার। সেখানে নেমে রিকশায় পোড়াবাড়ি পৌঁছলাম ২০ মিনিটে। এটাই বেদেপল্লী। লোকে বলে, ‘সাপের গ্রাম।’

শুনেছি, দেশের বেদে সমাজের সবচেয়ে বড় আস্তানা এটি। হাজার তিনেক সাপুড়ে থাকে এখানে। খুব সকালে এখানে প্রতিদিন সাপের হাট বসে। দুপুর পর্যন্ত চলে কেনাবেচা। রাজশাহী, ফরিদপুর, পঞ্চগড়, রংপুর, দিনাজপুরসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পাইকারি ও খুচরো সাপ ক্রেতা-বিক্রেতারা এখানে ছুটে আসে প্রতিদিন। দাঁড়াশ, দুধরাজ ও পদ্মগোখরোর চাহিদাই বেশি। ভারত থেকে আসে লালবোড়া, চন্দ্রবোড়া, খইগোগড়াসহ নানা জাতের সাপ। এখানে আরো পাওয়া যায় সুতানলী, কাল কেউটে, গোমা, পক্সিখরাজসহ যত সব ভয়ঙ্কর সাপ।

রিকশা থেকে নেমেই বেদেপল্লীর প্রথম যে বাড়িটি চোখে পড়ল, সেখানে এক শিশু খালি গায়ে হাত-পা ছুড়ে খেলা করছে। শরীর ধুলোমাটিতে মাখামাখি। ক্যামেরা তাক করতেই কেঁদেকেটে সারা গ্রাম মাথায় তুলল। কী হয়েছে, সন্তানের মায়ায় তার মা’সহ অনেকেই বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। এবার ক্যামেরা মায়ের দিকে ঘোরাতেই, তার সে কি রাগ!


ভিড় পড়ে গেল বেদেদের। একা, সুমনা, পাতা, লাবনি, তৃষ্ণা, সুবর্ণা নামে একঝাঁক কিশোরীও ছুটে এলো। তাদের কৌতুহলও কম নয়। এবার তাদের দিকে ক্যামেরা। সবার শরীরে গহনার সাজ। তারা শাড়ি পরেছে খুব কায়দা করে। ঠোঁটে লিপস্টিক মাখা। চপচপে তেলসহ মাথার চুল পেছনে টেনে, সুন্দর করে খোঁপা করা। কারো কারো খোঁপায় নকল ফুলের মালা। নামগুলো জানা গেলো শ্যামাবরণ একার সঙ্গে কথা বলে।

গোখরোর দাঁত ফেলা : একা সাপের গ্রামে আমাদের পথপ্রদর্শক হলো। একাই বাতলে দিচ্ছিল পথ। তাকে অনুসরণ করে সামনে গিয়ে দেখি সাপের হাট। অন্যসব বাজারের মতোই হইচই, কোলাহল, মানুষের আনাগোনা। আশপাশে দোকানপাটও চোখে পড়ল বেশ। টুকু মিয়া নামে এক সাপুড়ের সঙ্গে পরিচয় হলো। তার কাছ থেকে জানা গেল এই হাটে দেশি সাপের পাশাপাশি বিদেশি সাপও পাওয়া যায়। প্রতিসপ্তাহে সাপের চালান আসে ভারত থেকে। এছাড়া কেউ খবর দিলে সাপুড়েরা সাপ ধরতে চলে যায়। এই হাটে প্রায় ৩০ প্রজাতির সাপ রয়েছে।


আমরা সাপ দেখতে চাইলে এক বয়স্ক সাপুড়ে বললেন, ‘টাকা দিলে সাপ দেখাব।’ আমি রাজি হয়ে গিয়েছিলাম প্রায়। হঠাৎ হাজির হলো নবীরউদ্দিন। আমাদের তার বাড়ি ডেকে নিয়ে গেলেন। ঝাঁপি খুলে একে একে দেখালেন বালুবোড়া, লাউডগা, সুতানলী আর পদ্মগোখরো। একা তখনো আমাদের সঙ্গে। এবার বেদেপাড়ার আরেক কিশোরী নবীনা খবর নিয়ে এলো, আমরা ছুটলাম সেই খবরের সন্ধানে। সেখানে আমরা এসে থেমে গেলাম এক জটলার কাছে। জটলা সরিয়ে ভেতরে যেতেই চোখ ছানাবড়া। এখানে সাপের বিষদাঁত কেটে ফেলা হচ্ছে। বিষদাঁত ফেলার কথা শুনেছি, দেখিনি কখনো; আজ দেখলাম। সাপের হাটে না এলে এমন অভিজ্ঞতা কখনো হতো না।

এবার একাকে বিদায় দিলাম। তবে বিদায়ে একার আকুতি। হাত ধরে টানাটানি করল, ‘আমাদের বাড়িতে ভাত খেয়ে যা, কেন যাবি না? তরা আমাদের ঘেন্না করিস?’ আমার মুখ দিয়ে শব্দ বের হলো না। আমি একাকে আমার বেদনার জায়গাটা বোঝাতে পারলাম না। সেখান থেকে দ্রুত চলে এলাম নামাবাজার হয়ে সাভার থানার কাছে বংশী নদীর তীরে। এরপরই তো মাঝি নুরুল ইসলামের নৌকায় চড়া। তার বাসায় গিয়েছিলাম কি না সেই গল্প আজ থাক।


সাপের পল্লী যাবেন কীভাবে : রাজধানী ঢাকার গুলিস্তান, ফার্মগেট, উত্তরা, গাবতলী থেকে বাসে সরাসরি যাওয়া যায় সাভার। সেখান থেকে রিকশায় পোড়াবাড়ি। পোড়াবাড়ি, ওমরপুর, কাঞ্চনপুর, বক্তারপুর নিয়ে হচ্ছে সাপের গ্রাম। তবে পুরোটা গ্রাম পোড়াবাড়ি নামেই খ্যাত। ঢাকা থেকে দিনে এসে দিনে ফিরে যাওয়া যায় সহজেই। দুপুরে খেতে চাইলে সাভার বাজারে ভালো রেস্তোরাঁ রয়েছে। ফেরার সময় সাভারের বিখ্যাত মিষ্টি নিয়েও ফেরা যায়। তবে ফেরার পথে বিকেলের রোদ থাকতেই বাস ধরলে ভালো হবে। সন্ধ্যার সময় ঢাকামুখী মানুষের ভিড় থাকে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত