শাওন মাহমুদ

১৯ আগস্ট, ২০১৮ ০২:৪৩

আমাদের জহির রায়হান

২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, সন্ধ্যায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। উদ্দেশ্য ২১ ফেব্রুয়ারির হরতালকে পণ্ড করা। ছাত্ররা সেদিন রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার ষড়যন্ত্রকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলো। ২০ ফেব্রুয়ারির রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল, ঢাকা হল ও সলিমুল্লাহ হলের ছাত্ররা মিটিং করে জানিয়ে দিলো যে সরকার রক্তচক্ষু দেখিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চাইলে তারা একতিলও ছাড় দিতে রাজি নয়। তারাও গর্জে ওঠতে জানে, চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলো "তবে হয়ে যাক ফয়সালা"। মুসলিম লিগের পাণ্ডারা ও একালার সর্দারেরা মহল্লায়-মহল্লার স্কুলে স্কুলে গিয়ে ভয় দেখিয়ে এলেও একুশে ফেব্রুয়ারি সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। রাজনৈতিক নেতাদের নির্দেশ অমান্য করে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভেঙে রাস্তায় মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত নেয়। সর্বপ্রথম যেই দশ জন ছাত্র মিছিল বের করেছিলেন তাদের একজনের নাম "জহির রায়হান"।

জহির রায়হান একটি অবিস্মরণীয় নাম। অন্যায়, অমানবিকতা, দুঃশাসন, সামাজিক আধিপত্য ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রামী চেতনার স্বাক্ষর রেখে গেছেন তাঁর কর্মক্ষেত্রের পরতে-পরতে। শিল্প-সাহিত্যের প্রতি ছাত্রাবস্থা থেকেই ছিলেন অনুরাগী। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে এবং জীবনস্পর্শী প্রতিবাদী সাহিত্য ধারায় জহির রায়হান এক বিশিষ্ট শিল্পী। চলচ্চিত্র প্রতিভার পরবর্তী আশ্রয়স্থল হলেও তার আবির্ভাব ঘটেছিল কথাসাহিত্যে। সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক, রাজনৈতিক কর্মী, চিত্রপরিচালক- নানা পরিচয়ে তার কর্মক্ষেত্রের পরিধি স্পষ্ট। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণের দ্বারা এদেশে সৎ শিল্পীর ভূমিকা কীরকম হবে- জীবন দিয়ে তিনি তার উদাহরণ হয়ে আছেন।

জহির রায়হানের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট। তৎকালীন নোয়াখালী জেলার ফেনী মহকুমার অন্তর্গত মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। প্রকৃত নাম আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। ডাক নাম জাফর। তার পিতামহ মোহাম্মদ এমদাদউল্লাহ নোয়াখালীতে আইন ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন। জহির রায়হানের মাতা সৈয়দা সুফিয়া খাতুনের জন্ম এক রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের। রক্ষণশীল হলেও প্রভাবশালী এই পরিবারে তৎকালীন জাতীয়তাবাদী এবং স্বদেশী আন্দোলনের স্পর্শ যে লাগেনি তা নয়। শোনা যায়, মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনকালে সুফিয়া খাতুন নিজ হাতে সুতো কেটে কাপড় বুনে পরতেন। তখন তিনি তেরো-চৌদ্দ বছরের কিশোরী।

স্পেন দেশের এক প্রবাদ আছে – ‘শৈশবের স্বপ্নকে অবহেলা করো না’ – জহির রায়হান ছিলেন ওই প্রবাদের একনিষ্ঠ সাধক। স্কুলে নিচের ক্লাসে পড়ার সময়েই প্রায়ই বোতাম থাকত না জন্যে একহাতে ঢোলা হাফপ্যান্ট কোমরের সঙ্গে ধরে রেখে ছাত্র ফেডারেশন ও কমিউনিস্ট পার্টির আত্মগোপনকারী সদস্যদের মধ্যে চিঠিপত্র আর খবর আদানপ্রদানের কাজ করেছেন তিনি, খোলা রাস্তায় বিক্রি করেছেন কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘স্বাধিকার’। প্রচণ্ড ও অহেতুক ভিড়ের মধ্যেও, প্রচুর আবর্জনা ও জঞ্জালের মধ্যেও জহির রায়হানের সাহিত্য ও চলচ্চিত্র (বিশেষত চলচ্চিত্র) শেষ পর্যন্ত একটি পরিণতি পেয়েছে।

জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৫৩ সালে আইএসসি পাস করেন জহির রায়হান। শিল্প-সাহিত্যে অসাধারণ অনুরাগ আর সৃষ্টিশীলতার অন্তর্গত অনুপ্রেরণার ফলে বিজ্ঞান ছেড়ে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা অনার্সে ভর্তি হন। নিপীড়িত মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল প্রগাঢ়। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং গ্রেপ্তার হন। ১৯৫৬ সালের শেষের দিকে চিত্রজগতে তাঁর সদর্প প্রবেশ। বদলে দিলেন পুরো চিত্রজগতের চেহারাটাই। তাঁর প্রথম ছবির নাম 'কখনো আসেনি'। তার পর থেকে একে একে তাঁর হাত দিয়ে যুগান্তকারী ছবিগুলো নির্মিত হয়, যা তখনকার রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপটে ছিল বৈপ্লবিক উত্থান।

এদেশে তিনিই প্রথম ইংরেজি ছবি ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ নির্মাণ করেন। তৎকালীন পাকিস্তানে প্রথম রঙিন ছবি ‘সঙ্গম’ তৈরি করেন জহির রায়হান, তার হাতেই প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি ‘বাহানা’র জন্ম। ১৯৬১ সালে তার প্রথম পরিচালিত ছবি ‘কখনো আসেনি’ মুক্তি লাভ করে। এরপর তিনি পরিচালনা করলেন ‘সোনার কাজল’ (১৯৬২), ‘কাঁচের দেয়াল’ (১৯৬৩), ‘সঙ্গম’ (উর্দু : ১৯৬৪), ‘বাহানা’ (১৯৬৫)’, ‘বেহুলা’ (১৯৬৬), ‘আনোয়ারা’ (১৯৬৭)’ এবং ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০)। তার ‘আর কতদিন’ উপন্যাসের ইংরেজি ভাষান্তরিত ছবি ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ সমাপ্ত হবার আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। তিনি চলে যান ওপার বাংলায়। সেখানে বাংলাদেশি সিনেমার এই প্রাণপুরুষ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচারকে কেন্দ্র করে তৈরি করেন প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও ‘বার্থ অব আ নেশন’। সেখানে তার তত্ত্বাবধানে বাবুল চৌধুরীর ‘ইনোসেন্ট মিলিয়ন’ এবং আলমগীর কবীরের ‘লিবারেশন ফাইটারস’ নামক প্রামাণ্যচিত্র দু’টি নির্মিত হয়।

পেশাগত জীবনে তিনি সাংবাদিকতা ও চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন। ১৯৫০ সালে "যুগের আলো" পত্রিকা দিয়ে তিনি সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত হন ও পরবর্তীতে বিভিন্ন পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। ১৯৫৬ সালে প্রবাহ পত্রিকায় জহির রায়হান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে জহির রায়হানের লেখা "একুশে ফেব্রুয়ারি" ও "আরেক ফাল্গুন" নামক উপন্যাস দুটি তার অনবদ্য রচনা। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছে: সূর্যগ্রহণ, শেষ বিকেলের মেয়ে, হাজার বছর ধরে, আর কতদিন, কয়েকটি মৃত্যু, বরফ গলা নদী, তৃষ্ণা প্রভৃতি।

জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাস ১৯৬৪ সালে ‘আদমজী পুরস্কার’ লাভ করে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে বিশিষ্ট অবদানের জন্য তাকে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে (মরণোত্তর) ভূষিত করা হয়। তৎকালীন পাকিস্তানে ১৯৬৫ সালে জহির রায়হান পরিচালিত ‘কাঁচের দেয়াল’ ছবিটি ‘নিগার পুরস্কার’ লাভ করে। এই ছবিটি ৭টি শাখায় পুরষ্কার জিতে নেয়। তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালকের সম্মান লাভ করেন। ১৯৭২ সালে তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে তার ‘জীবন থেকে নেয়া’ এবং ‘স্টপ জেনোসাইড’ ছবি দুটিকে বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হয়।

এ প্রতিভাবান মানুষটিকে আমরা বেশি দিন ধরে রাখতে পারিনি। স্বাধীনতার পরপরই কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। এসে শুনলেন বুদ্ধিজীবীদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এবং অগ্রজ শহীদুল্লা কায়সারের নিখোঁজ সংবাদ। অগ্রজকে খুঁজতে বের হয়েছিলেন তিনি, আর ফিরে আসেননি। ভাইকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিহারি ও রাজাকার অধ্যুষিত মিরপুর এলাকায় ডেকে নিয়ে তাঁকে সম্ভবত হত্যা করা হয়। এর পর থেকে তাঁর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

সাংবাদিক হারুনুর রশীদ খান ৩০ জানুয়ারি ১৯৯৩ সালে দৈনিক লাল সবুজ পত্রিকায় একটি নিবন্ধ লিখেন জহির রায়হানের ওপর। এতে তিনি বলেছেন, ‘সেই যে নিখোঁজ হলেন, আজও আমাদের কাছে নিখোঁজ। রহস্যজনক ঘটনা আরও ঘটলো। জহির রায়হানের মরিস মাইনর গাড়িটি দরজা ভাঙা অবস্থায় পাওয়া গেল। 'স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে নির্মল বাতাসে নিঃশ্বাস ফেলতে চেয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক খ্যাতিমান সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। সদ্য স্বাধীন দেশের রাজধানী ঢাকাতেই তিনি দিনের আলোতে হারিয়ে গেলেন।

  • শাওন মাহমুদ: শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদের কন্যা।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত