রিপন দে

২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ১৯:১০

গুপ্তঘাতক ‘কালাচ’: যে সাপ নীরবে কামড়ায়

বাংলাদেশে শতাধিক প্রজাপতির সাপের দেখা মিলে। এই সাপদের বেশিরভাগের কামড়ে মানুষ মৃত্যু হয়না কারণ বিষ নেই। তবে কিছু সাপ আছে যাদের কামড়ে মৃত্যু হতে পারে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৩ প্রজাতির গোখরো, ২ প্রজাতির ঢোড়া, ৪ প্রজাতির বোরা, ৩/৪ প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ ও ২/১ প্রজাতির কোরাল সাপ এবং পাতি কেউটেসহ ৪ প্রজাতির কেউটে আছে, যা বিষধর।

এ বিষাক্ত সাপদের একটি হচ্ছে গুপ্তঘাতক বিষাক্ত কেউটে, এই সাপ কামড় দিলে বিষ প্রয়োগ হবেই। এটি একটি ফণাহীন সাপ। বাংলাদেশে এই কেউটে সাপ কালাচ নামেও পরিচিত।

এদের ইংরেজি নাম Common Krait বৈজ্ঞানিক নাম Bungarus caeruleus। ঘুমন্ত মানুষকে কামড় দেয় বলে এই সাপকে ঘামচাটা সাপও বলা হয় কারণ প্রচলিত আছে এই সাপ ঘুমন্ত মানুষের বিছানায় উঠে আসে ঘামের গন্ধ নিতে।

তবে এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক নানা মত থাকলেও বৈজ্ঞানিকভাবে সাপের ঘ্রাণ শক্তি আছে বলে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশের সব সবজায়গায় এই সাপ আছে কিন্তু মানুষের চোখে পড়েনা কারণ এরা নিশাচর। গভীর রাতে এরা বিচরণ করে। এরা খাড়া ভাবে উপরে উঠতে পারে। এবং উপরে উঠে মানুষের বিছানায় চলে যায়। বিছানায় গিয়ে মানুষের পাশেই অবস্থা করে বলেই একে ঘামচাটা সাপ বলা হয়। ঘুমন্ত অবস্থায় পাশ ফেরার কারণে মানুষের শরীরের নিচে চাপা পড়ে অথবা হাত পা নড়াচড়া করলে শিকার ভেবে নীরবে কামড় দিয়ে দ্রুত কেটে পড়ে।

এই সাপের সব চেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হচ্ছে এরা শত ভাগ বিষ প্রয়োগ করে। অন্যান্য বিষাক্ত সাপ কামড় দিলে তার ৬০ থেকে ৭০ ভাগ থাকে ড্রাইবাইট। ড্রাইবাইট হচ্ছে কামড় দেবে ঠিকই কিন্তু বিষ প্রয়োগ করবেনা। তবে কালাচের কামড়ে কোন ড্রাইবাইট নেই। সে কামড় দেওয়া মানেই বিষ প্রয়োগ হবে। তার সব চেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হচ্ছে এই সাপে কামড় দিলে মানুষ তা বুঝতেই পারেনা কারণ সাপটির দাঁত মশার হুলের মত তাই কামড়ে বেশিরভাগ সময় দাগ পড়েনা কোন রকম জ্বালা যন্ত্রণা হয় না, আক্রান্ত জায়গা ফুলেনা।

৯০% রোগী বুঝতেই পারেনা তাকে সাপে কামড়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগী ভোরবেলায় প্রচণ্ড তলপেট ব্যথা নিয়ে ঘুম থেকে উঠে, রোগীর চোখের পাতা পড়ে আসে, বমি বমি ভাব হয়, জ্বর হলে যেমন অস্বস্তি হয় তেমনটা হয়। সময়ের সাথে সাথে রক্ত জমাট বাঁধা শুরু করে তাই এ অবস্থায় রোগীকে চিকিৎসার জন্য মেডিকেল কলেজ বা জেলা সদরে নিতে হবে দ্রুত। সেখানে নিয়ে এন্টি স্নেক ভেনাম (এভিএস) প্রয়োগে চিকিৎসা না দেওয়া হলে রোগী ধীরে ধীরে শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাবে।

উপজেলা সদরে সাপের কামড়ের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভাল থাকলে বাংলাদেশে সাপের কামড়ের মৃত্যুর হার রোধ করা যেত। বাংলাদেশের মেডিকেল হাসপাতালগুলো ছাড়া অন্যান্য হাসপাতালে সাপে কামড়ের তেমন ভালো চিকিৎসা না থাকা এবং সর্বোপরি যানবাহন ও যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না থাকার কারণে এত বেশি রোগীর দুঃখজনক মৃত্যু হয়। তাই সাপে কামড় দিলে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিতে হবে।কালাচের প্রজনন মৌসুম মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত।

ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার ও গবেষক আদনান আজাদ আসিফ জানান, বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সাপ কালাচ ।সারাদেশেই এর বিচরণ। ঘুমন্ত মানুষ কে কামড় দেয় বলে এরা গুপ্ত ঘাতক। বেশিরভাগ সময়ে আক্রান্ত ব্যক্তি টেরই পায়না যে তাকে সাপে কেটেছে,কারণ এর কামড় ব্যথাহীন।

তিনি বলেন, বেশিরভাগ সাপের কামড়ে যেমন আমাদের মৃত্যু হয়না তেমনি যে সাপে বিষধর আছে তা নিয়ে বেশীর ভাগ মানুষের ধারনা নেই। যার কারণে কোন সাপের কামড়ে বিষ আছে বা নেই তা না জানার সাথে সাথে কিভাবে চিকিৎসা নিতে হবে তা জানেনা এর কারণে চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে সঠিক ধারনা নেই।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য সাপকে রক্ষা করতে এবং সাপের কামড় থেকে জীবন বাচাতে সচেতনতার বিকল্প নেই। এই সাপ থেকে বাচতে হলে যা করতে হবে ১. অবশ্যই মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হবে। ২. রাতে চলাচল করলে টর্চলাইট ব্যাবহার করতে হবে। ৩. সাপটিকে দেখলে তাকে মারতে না গিয়ে তাকে নিজের মত চলে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। ৪. বাড়ির আশেপাশের ঝোপঝাড় পরিস্কার রাখতে হবে; যোগ করেন তিনি।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক ড. মনোয়ার হাসান জানান, কালাচ একটি গুপ্তঘাতক সাপ এই সাপের বিষে প্যারালাইসিস হতে শুরু করে। এর একটি কামড়ে ২০ মি.লি বিষ শরীরে প্রবেশ করে। এর বিষ নিউরোটক্সিন। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করালে মৃত্যু নিশ্চিত।
অন্যান্য সাপের পর যদি  সাপের কামড়ে ৪৮ ঘণ্টা অতিক্রম করে কিন্তু কোন সমস্যা হয়না বুঝতে হবে আর কিছু হবার সম্ভাবনা নেই। তবে এই হিসেব কেউটে বা কালাচ সাপের বেলায় মিলবেনা কারণ এই সাপের কামড়ে বিষক্রিয়া হবেই কারণ এদের ড্রাইবাইট (কামড় দেবে কিন্তু বিষ ছাড়বেনা) বলে কিছু নেই ।

ছবি: আদনান আজাদ আসিফ

আপনার মন্তব্য

আলোচিত