সিলেটটুডে ডেস্ক

২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ১৭:০৬

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ডা. দেওয়ান নুরুল হোসেন চঞ্চলের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ডা. দেওয়ান নুরুল হোসেন চঞ্চলের মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার কচুয়াবহর নোয়াটিলা গ্রামে ১৯৩৯ সালে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম দেওয়ান ইসহাক আলী, মাতা দেওয়ান কুলসুম বেগম। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়।

ডা. দেওয়ান নুরুল হোসেন চঞ্চল বর্ণিল ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী। তিনি আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ নির্লোভ-নির্মোহ-স্পষ্টবাদী ছিলেন।

তার শুভাকাঙ্ক্ষী ও সহকর্মীগনই তার ঘর সংসার। পরিবারের সদস্যদের মত সর্বোপরি দেশ ও জনগণই ছিলো তার দিবারাত্রির মহাকাব্য। তিনি প্রতিনিয়ত বিশ্বাস করতেন স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি পারে জনগণের কল্যাণ বয়ে আনতে। কখনও একজন রাজনৈতিক কর্মী কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা কিংবা পরশ্রীকাতরতায় আক্রান্ত হতে পারে না। বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতি মানুষকে উদার করে পরমতসহিঞ্চু করে বানায় দেশপ্রেমিক।

৫০ এর দশকে তিনি স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ১৯৬৬-এর ছয় দফা ও ৬৯-এর গণআন্দোলনে স্বাধীনতার চেতনা সে সময় সিলেটের ছাত্র ও যুবকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন তার দায়বদ্ধতা আছে দেশ-মাটি-মানুষের কাছে। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য দায়বদ্ধতা এড়ানোর কোন সুযোগ নেই কারোরই।

সংগ্রামী মানুষের ভেতরের মুক্তির দীপশিখাটি জাগিয়ে তুলতে তাই নিজের আলো অন্যের ভেতর ছড়িয়ে দিতে মাঠে ময়দানে কাজ করেছেন সংগ্রামমুখর দিনগুলোতে। তার মেধা মননে ছিলো বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক স্বপ্নের সোনার বাংলা।

১৯৭০ সালের গণপরিষদ নির্বাচনে তিনি কর্নেল ওসমানীর পক্ষে দিনরাত কাজ করেছেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে সিলেটে আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনায় সিলেটের কৃতিসন্তান মুক্তিবাহিনী প্রধান জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এম.এ.জি ওসমানী, প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ, প্রাক্তন মন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজী, আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট লুৎফুর রহমান, এম.এ রহিম, সৈয়দ আবু নসর অ্যাডভোকেট, আ ন ম শফিকুল হক, ইফতেখার হোসেন শামীম, সিরাজ উদ্দীন আহমদ, আব্দুল খালিক মায়নের সাথে একসাথে কাজ করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালোরাতে পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী হওয়ার আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র পুলিশের ওয়্যারলেসে জেলায় জেলায় প্রেরণ করা হয়েছিল। সিলেট জেলায় তা পৌঁছে যায় তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান ফরিদ গাজীর কাছে। ওয়্যারলেস বার্তার সংবাদ পেয়ে ডা. দেওয়ান নুরুল হসেন চঞ্চল আওয়ামী লীগসহ সিলেটের তৎকালীন সকল রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও জনসাধারণের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য প্রস্ততি নিতে বলেন। সিলেটের ছাত্র ও যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে সাহস যোগান। হাজার হাজার যুবকদের সংগঠিত করে মুক্তিবাহিনী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রেরণ করেন। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙ্গালী জাতির ৩০ লাখ শহীদদের রক্ত ও ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে হাজার বছরের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা লাভ করে।

ডা. দেওয়ান নুরুল হোসেন চঞ্চল সিলেট জেলা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, যুবলীগ কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের যুব আন্দোলনের নেতা হিসেবে ঘুরে বেড়িয়েছেন পুরো দেশ। তিনি স্বাধীনতা উত্তর সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। জননেতা ডা. দেওয়ান নুরুল হোসেন চঞ্চল স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে সিলেট জেলায় তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকারের দেশ গড়ার কাজে নির্লোভভাবে কাজ করে যান। তিনি সিলেটে রিলিফ অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ফুটবল খেলতে ও কবিতা লিখতেও ভালোবাসতেন।

১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের প্রতিবাদে জেনারেল ওসমানীকে সংসদ সদস্য পদ থেকে বহিষ্কার করলে সিলেট-৬ (ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ) আসনে উপনির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর সারা দেশে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর নেমে আসে জেল-জুলুম-নির্যাতন। সে সময়ের সামরিক সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সিলেটের মাটিতে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত করতে নিরলসভাবে কাজ করে যান তিনি। স্বৈরাচারী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ১০ দলীয় ঐক্য নেতৃত্বে দুর্বার আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তুলেন সিলেটের মাটিতে।

১৯৭৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারাদেশে বিএনপির জয়জয়কার হলেও ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ইনামুল হক চৌধুরী (বীর প্রতীক) ৩ হাজার ৫শত ৭ ভোটের ব্যবধানে বিএনপি প্রার্থী ফতেহ ইউনুস খাঁনকে হারিয়ে সংসদ নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে বিজয়ী করতে ডা. দেওয়ান নুরুল হোসেন চঞ্চল জীবন বাজি রেখে কাজ করেন সে সময়।

১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী জেনারেল এমএজি ওসমানীর পক্ষে ও ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনের পক্ষে কাজ করে যান ডা. চঞ্চল। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক শাসক এইচএম এরশাদের অবৈধ ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামে সামনের কাতারে থেকে ১৫ দলীয় ঐক্যজোটের পক্ষে সিলেটে নেতৃত্ব দেন ডা. নুরুল হোসেন চঞ্চল।

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ডা. দেওয়ান নুরুল হোসেন চঞ্চল ১৯৮৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান। বর্তমান প্রজন্ম জননেতা প্রয়াত ডা. নুরুল হোসেন চঞ্চলকে চিনে না। ডা. দেওয়ান নুরুল হসেন চঞ্চলের মতো সংগঠক যোদ্ধা, রাজনীতিবিদকে জানা অবশ্যই প্রয়োজন নতুন প্রজন্মের জন্য। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের সৈনিক হিসেবে আমৃত্যু কাজ কাজ করে গেছেন।

আওয়ামী লীগ সংগঠন ছিলো তাঁর ধ্যান, জ্ঞান, সাধনা। আমৃত্যু তিনি সংগঠনের সঙ্গে ছিলেন। এক মুহূর্তের জন্য বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে জলাঞ্জলি দেননি বরং তিলে তিলে একে ধারণ করেছেন। সিলেটের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাঁর দীর্ঘ উপস্থিতি এখানকার রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডকে উর্বর ও বিকশিত করেছেন। দেশ, মানুষ ও মানবতার কল্যাণে নিবেদিত প্রয়াত ডা. দেওয়ান নুরুল হোসেন চঞ্চলের মতো নেতার মৃত্যু নেই।

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, প্রভৃতি পরিচয়ে প্রয়াত ডা. দেওয়ান নুরুল হোসেন চঞ্চল অমর হয়ে থাকবেন চিরকাল। ৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার স্মৃতির প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত